লোকসানে বন্ধ সৌরবিদ্যুৎ প্লান্ট

রাজশাহীর চর আষাড়িয়াদহের ৩৫ হাজার মানুষ বিদ্যুৎহীন

ফয়সাল আহমেদ, রাজশাহী

ছবি : সংগৃহীত

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় পদ্মার পারে চর আষাড়িয়াদহ ইউনিয়নে প্রায় ৩৫ হাজার মানুষের বাস। এ অঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে নয় বছর আগে স্থাপন করা হয় সৌরবিদ্যুৎ প্লান্ট। ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের (ইডকল) কারিগরি সহযোগিতায় প্লান্টটি স্থাপন করেছিল বেসরকারি সংস্থা আভা। শুরু থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও রোজার আগে শুরু হয় লোডশেডিং। পূর্বঘোষণা ছাড়াই বৃহস্পতিবার থেকে গ্রিডটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে চর আষাড়িয়াদহের ৩৫ হাজার মানুষ।

আভার কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের ‘টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ (স্রেডা) প্লান্টটি স্থাপনে প্রণোদনা দেয়। কারিগরি সহায়তা করে সরকারের আরেক সংস্থা ইডকল। সংস্থাটি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে সমীক্ষাও করেছিল। সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, প্লান্টটি চালালে প্রতি মাসে ১৫ লাখ টাকা করে লাভ করতে পারবে আভা। কিন্তু এখন পর্যন্ত লাভের মুখ দেখা যায়নি। সব মিলিয়ে লোকসান হয়েছে কয়েক কোটি টাকা। প্লান্টে ৫৯৪টি সৌরবিদ্যুতের প্যানেল রয়েছে। এগুলোর বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বলা হয়েছিল ১৪৮ দশমিক ৫০ কিলোওয়াট। তবে প্যানেলের কার্যক্ষমতা কমে বর্তমানে ৬০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছিল, যা দিয়ে প্রায় ১ হাজার ৩০০ গ্রাহকের মিটারে সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছিল না। এ কারণে বৃহস্পতিবার গ্রিডটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

আভা মিনি-গ্রিড প্রজেক্টের প্লান্ট ব্যবস্থাপক হিসেবে শুরু থেকেই কর্মরত ছিলেন মিল্লাত হোসেন। এছাড়া আরো দুজন কর্মচারী সেখানে কর্মরত। তবে বৃহস্পতিবার মিল্লাত চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে প্লান্ট বন্ধ করে চলে আসেন।

যোগাযোগ করা হলে মিল্লাত হোসেন বলেন, ‘চাহিদা ১২০ কিলোওয়াটের। আর আমরা সরবরাহ করতে পারছিলাম মাত্র ৬০ কিলোওয়াট। প্লান্টটিতে বেশ সমস্যা রয়েছে। অন্যদিকে লোকজনের কথা শুনতে হচ্ছিল। তাই চাকরি ছেড়ে প্লান্ট বন্ধ করে চলে এসেছি। এছাড়া আমার করার কিছু ছিল না।’

এ ব্যাপারে আভার মহাব্যবস্থাপক শালেউদ্দীন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চাকরি ছাড়তে হলে অন্তত এক মাস আগে জানাতে হবে। তাহলে কর্তৃপক্ষ সেখানে নতুন লোক দেবে এবং কার্যক্রম চালু রাখবে। কিন্তু মিল্লাত চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে প্লান্ট বন্ধ করে চলে এসেছেন। চাহিদামতো বিদ্যুৎ দিতে না পারার কারণে লোকজন মন্দ কথা বলত। তাই হয়তো মিল্লাত চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন।’

শালেউদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘প্লান্টটি আসলে চালানো সম্ভব নয়। ২৪ ঘণ্টার ভেতরে ছয়-সাত ঘণ্টা বিদ্যুৎ দিয়েও প্রতি মাসে প্রায় ১ লাখ টাকা লোকসান হচ্ছিল। অথচ কার্যক্রম শুরুর আগে ইডকল যাদের দিয়ে সমীক্ষা করিয়েছিল, তারা বলেছিল মাসে ১৫ লাখ টাকা লাভ হবে। লাভ তো দূরের কথা, জেনারেটর চালিয়েও চাহিদামতো বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যায়নি।’

আভার মহাব্যবস্থাপক জানান, সবকিছু পর্যালোচনা করে দুই বছর আগে নর্দার্ন ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির (নেসকো) সঙ্গে আভার চুক্তি হয়েছে। কথা ছিল, সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে নেসকো পদ্মার ওপারের চরে বিদ্যুৎ নিয়ে যাবে। তারপর তারাই চরবাসীকে চাহিদামতো বিদ্যুৎ দেবে। আর সৌর প্লান্টে যেটুকু বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে সেটা আভা নেসকোর কাছে বিক্রি করবে। এটাও কথা ছিল যে, এ চুক্তির ছয় মাসের মধ্যে নেসকো তাদের কার্যক্রম শুরু করবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত নেসকো কার্যক্রম শুরু করেনি।

তবে নেসকোর নির্বাহী পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) মোহাম্মদ শহীদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সৌরবিদ্যুৎ কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। এটি যুগ যুগ চলবেও না। দুর্গম অঞ্চলে বিদ্যুৎ দিতে সরকারের অগ্রাধিকার ছিল বলে নেসকো বিনামূল্যেই আভাকে সহযোগিতা করেছে। নদীর ওপারে সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ নিয়ে যাওয়া সহজ কাজ নয়। আভা কর্তৃপক্ষ যা বলেছে তা সত্য নয়। আভার সঙ্গে এ রকম কোনো চুক্তি ছিল না। আভা সৌরবিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ার আগে তা আমাদের জানানো উচিত ছিল।’

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, প্রায় নয় বছর আগে সৌরবিদ্যুৎ প্লান্টটি চালু হয়। প্রথম দিকে বিদ্যুৎ সরবরাহ ভালোই ছিল। তবে ধীরে ধীরে গ্রাহক বাড়ায় লোডশেডিংও বাড়তে থাকে। রোজার আগ থেকে লোডশেডিংয়ের মাত্রা বাড়তে থাকে। দিনে মাত্র ৫-৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ করত প্লান্ট কর্তৃপক্ষ। কোরবানি ঈদের পর ম্যানেজার চাকরি ছেড়ে প্লান্ট বন্ধ করে চলে গেছেন।

চর আষাড়িয়াদহ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আশরাফুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ইউনিয়নে ৫ হাজার ২০০টি হোল্ডিং রয়েছে। প্রায় ৩৫ হাজার মানুষের বাস এখানে। তাদের জীবন প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। আমি নিজেই জন্মনিবন্ধন, মৃত্যু সনদসহ অন্যান্য সরকারি কাজ করতে পারছি না। কোরবানি ঈদে মানুষ মাংস নিয়ে চরম বিপাকে। আমার নিজের বাড়িতে থাকা কেজি দশেক মাংস একেবারে রান্না করতে হয়েছে। উপজেলা চেয়ারম্যান বিষয়টি সমাধানের আশ্বাস দিয়ে গেছেন। তবে আমরা এর স্থায়ী এবং দ্রুত সমাধান চাই।’

এ ব্যাপারে গোদাগাড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান বেলাল উদ্দিন সোহেল বলেন, ‘ঘটনাটি জানার পর আমি ওই ইউনিয়নে গিয়েছি। দ্রুত যেন প্লান্টটি চালু করা হয়, সেজন্য সংশ্লিষ্ট মহলে যোগাযোগ করার চেষ্টাও করছি।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন