অপরিশোধিত পানিতে তৃষ্ণা মেটাচ্ছে ঘষিয়াখালীর মানুষ

আলী আকবর টুটুল, বাগেরহাট

বাগেরহাটে জাহাজ থেকে পানি সংগ্রহ করছেন ঘষিয়াখালীর বাসিন্দারা ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

ঘূর্ণিঝড় রেমাল আঘাত হানার আগ থেকেই জোয়ারের পানি উঠতে শুরু করে বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার বহরবুনিয়া ইউনিয়নে। ঝড়ের রাতে পুরো ইউনিয়ন ডুবে যায় তিন পাশের কেওড়া, মানিক ও পানগুছি নদীর জলোচ্ছ্বাসে। ইউনিয়নের ঘষিয়াখালী বাজারের পাশেই রয়েছে জেলা পরিষদের পুকুর। এটি মিঠাপানির একমাত্র উৎস। সেটিও লবণ পানিতে প্লাবিত হয়েছে। জাহাজ থেকে সংগ্রহ করা অপরিশোধিত পানিতেই তৃষ্ণা মেটাচ্ছে এ অঞ্চলের মানুষ।

ঘষিয়াখালী বাজারে গিয়ে দেখা যায়, পুকুরটির দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ১০০ ফুটের বেশি পাড় ভেঙে গেছে। দক্ষিণ পাড়ের মাঝ দিয়েও প্রায় ৫০ ফুট ভেঙেছে। পাড়ে থাকা কংক্রিটের খুঁটি উপড়ে পড়েছে। অথচ পুকুরটির পাড় মেরামতের কোনো উদ্যোগ নেয়নি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর।

ঘষিয়াখালী বাজারের ব্যবসায়ী আজাদুল ইসলাম জানান, ঘষিয়াখালী বাজারের ১৩১টি দোকান ও দুই শতাধিক ব্যবসায়ী রয়েছেন। তারা সবাই পুকুরের পানি পান ও প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করতেন। ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি ঘষিয়াখালী ও আশপাশের অন্তত পাঁচ হাজার মানুষ এ পুকুরের পানি পান করে, কিন্তু পুকুরের পানি লবণাক্ত হয়ে যাওয়ায় সমস্যায় পড়েছেন তারা।

ঘষিয়াখালী বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি জাহিদুল ইসলাম খলিফা বলেন, ‘স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে কেউ পুকুরটি মেরামতের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। কেউ দেখতেও আসেনি।’ দ্রুত এ এলাকায় সুপেয় পানি সরবরাহ ও পুকুর মেরামতের দাবি জানান এই ব্যবসায়ী নেতা।

বাজার থেকে একটু পূর্ব দিকে গেলেই মোংলা বন্দরের ঘষিয়াখালী চ্যানেল। চ্যানেলের পাড়ে গেলে চোখে পড়ে দুই যুবক ট্রলারে কলস নিয়ে চ্যানেলের মাঝখানে একটি জাহাজের দিকে যাচ্ছেন। ট্রলারচালক রবিউল বলেন, ‘ঝড়ের পর থেকে জাহাজের পানিতেই তারা তৃষ্ণা মেটাচ্ছেন। জাহাজের মাস্টার ও নাবিকদের অনুরোধ ও মাঝেমধ্যে উপঢৌকন দিয়ে জাহাজ থেকে পানি নিতে হয়।’

কয়েক মিনিটে কলস নিয়ে জাহাজে পৌঁছান রবিউল ও তার সহযোগী। জাহাজে উঠে নাবিকদের অনুমতি নিয়ে রিজার্ভার থেকে পানি ভরেন কলসে। এ সময় কথা হয় জাহাজের ক্যাপ্টেন শাহজাহানের সঙ্গে। তিনি জানান, মেঘনা নদী থেকে রিজার্ভারে পানি ভরে নিয়ে আসেন তারা। তাদের রিজার্ভারে পাঁচ-ছয় হাজার লিটার পানি ধরে। একবারের ট্রিপে সব পানি ব্যবহার হয় না। তাই ঘষিয়াখালীতে যখন জাহাজ নোঙর করে, তখন স্থানীয়রা কলস নিয়ে এলে তাদের পানি দেন।

জাহাজ থেকে পানি সংগ্রহ করা যুবক রবিউল বলেন, ‘মোংলা বন্দর ও খুলনা-নওয়াপাড়া রুটে চলাচল করা জাহাজ ঘষিয়াখালীতে নোঙর করে। আগেও বিভিন্ন সময় জাহাজ থেকে পানি সংগ্রহ করেছি। তবে ঝড়ের পর জাহাজের পানিই একমাত্র ভরসা। বেশির ভাগ মানুষ এখন জাহাজ থেকে পানি নেয়। কেউ কেউ বিনামূল্যে নেয়, আবার কেউ ছোটখাট খাদ্যপণ্য যেমন— কচু, তালশাঁস, সিগারেট ও মুরগির বাচ্চার বিনিময়েও পানি নেয়। তবে কেউ কেউ লঞ্চে করে বাগেরহাট সদর ও রামপালের সন্ন্যাসী বাজার থেকে বোতলের পানি ক্রয় করে আনে। সে সামর্থ্য এলাকার অধিকাংশ মানুষের নেই।

শুধু ঘষিয়াখালী নয়, বহরবুনিয়া ইউনিয়নের সর্বত্রই সুপেয় পানির সংকট রয়েছে। মোরেলগঞ্জ, শরণখোলা, মোংলা ও কচুয়া উপজেলার অধিকাংশ এলাকায় সুপেয় পানির সংকট রয়েছে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ঘূর্ণিঝড় রেমালে জেলায় ২০ হাজার ২২৬টি সুপেয় পানির উৎস্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে নলকূপ, রেইন ওয়াটার হার্বেস্টিং ট্যাংক, পন্ড স্যান্ড ফিল্টার (পিএসএফ) ও পুকুর রয়েছে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর বাগেরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী জয়ন্ত মল্লিক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ঝড়ের ফলে জেলার অধিকাংশ পানির উৎস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। সংকট মেটাতে মোংলা, মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলায় তিনটি ভ্রাম্যমাণ ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট দিয়ে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে, যা থেকে প্রতিদিনি প্রায় ৭ হাজার লিটার পানি পাচ্ছেন দুর্গতরা। বহরবুনিয়া ইউনিয়নেও তীব্র পানির সংকট রয়েছে। ইউনিয়নটিতে সরাসরি সড়ক পথে কোনো যানবাহন যায় না। এ কারণে এখন পর্যন্ত সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা যায়নি। তবে দ্রুত সে ব্যবস্থা করা হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন