বন্দর ব্যবস্থাপনায় প্রথম বিদেশী অপারেটরের কার্যক্রম শুরু শনিবার

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম ব্যুরো

ছবি : বণিক বার্তা ( ফাইল ছবি)

দেশে বন্দর ব্যবস্থাপনায় প্রথমবার কোনো বিদেশী প্রতিষ্ঠানের অধীনে টার্মিনাল পরিচালনা শুরু হতে যাচ্ছে শনিবার (৮ জুন)। ডেনমার্কভিত্তিক জাহাজ কোম্পানি মায়ের্সক লাইনের জাহাজ মায়ের্সক ড্যাভাও ভেড়ানোর মধ্য দিয়ে বন্দরের বিদেশী অপারেটর হিসেবে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালে (পিসিটি) এ পথচলা শুরু করবে সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনাল। এজন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পক্ষ থেকে গতকালই পিসিটিতে অপারেশন কার্যক্রম চালুর জন্য অনুমতি দেয়া হয়েছে। ছাড়পত্র না পাওয়ায় এতদিন অপারেশন কার্যক্রম চালু করা সম্ভব হয়নি।

এনবিআর বলছে, আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে সহায়তা, জাহাজজট কমানো এবং পণ্য পরিবহন-সংক্রান্ত খরচ ও সময় কমানোর উদ্দেশ্যে কাস্টমস-সংক্রান্ত আইনি বাধ্যবাধকতা ও আনুষ্ঠানিকতা পালন সাপেক্ষে শর্তসাপেক্ষে এ অনুমতি দেয়া হয়েছে। 

অপারেশন কার্যক্রম চালুর ব্যাপারে গতকাল এনবিআরের পক্ষ থেকে সাময়িক অনুমতি দেয়ার সঙ্গে আটটি শর্তও জুড়ে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম শর্তই হলো চট্টগ্রাম বন্দরের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে আরএসজিটি বাংলাদেশ লিমিটেডের অর্থায়নে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালে অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ডের সংযোগ স্থাপন-সংক্রান্ত সব আইটি ইকুইপমেন্ট ও অ্যাকসেসরিজসহ কাস্টমসের দাপ্তরিক কার্যক্রম, পরীক্ষণ পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সব লজিস্টিকস অপারেশন কার্যক্রম শুরুর আগেই নিশ্চিত করতে হবে।

দ্বিতীয় ও তৃতীয় শর্ত হলো বন্দরে অবতরণীয় পণ্য চালানের বিএলের (বিল অব লেডিং) কনটেইনার সেগমেন্টে পিসিটির জন্য বরাদ্দকৃত কনটেইনার লোকেশন কোড ব্যবহার এবং অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য বন্দরের ওয়ান স্টপ সলিউশন সেন্টারের মাধ্যমে বিদ্যমান ব্যবস্থার মতো বন্দর কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পিসিটি থেকে পণ্য খালাসকালে এক্সিট নোট ইস্যু করতে হবে। 

এনবিআরের বাকি পাঁচ শর্তে উল্লেখ করা হয়েছে শুল্ক-কর পরিশোধ ও কাস্টমসের আনুষ্ঠানিকতা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো পণ্য চালান পিসিটি থেকে সাউথ কনটেইনার ইয়ার্ডে না পাঠানো, স্ক্যানার স্থাপন না হওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে অফডক ও ইপিজেড গমনকারী কনটেইনার কায়িক পরীক্ষার মাধ্যমে পাঠানো, পিসিটিতে খালাসের অপেক্ষায় থাকা এলসিএল কার্গো-কনটেইনার শতভাগ কায়িক পরীক্ষা ও এফসিএল কার্গো-কনটেইনার কাস্টমস ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার আওতায় পরীক্ষণ, এ টার্মিনালে আসা সব পণ্য চালানের ক্ষেত্রে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার আওতায় কায়িক পরীক্ষণ নিশ্চিত করা এবং এনবিআর কর্তৃক প্রাইভেট পোর্ট অপারেটরদের বিষয়ে নীতিমালা চূড়ান্ত হলে এর আওতায় আরএসজিটি বাংলাদেশ লিমিটেডকে দ্রুত লাইসেন্স গ্রহণ করতে হবে। 

চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালে ৮ জুন আন্তর্জাতিক অপারেটর রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনালের পক্ষ থেকে অপারেশন কার্যক্রম শুরু হবে। একই দিনেই টার্মিনালটিতে মায়ের্সক লাইনের জাহাজ ভেড়ানো হবে। এজন্য এনবিআর থেকেও সাময়িক অনুমতি মিলেছে তাদের। মূলত এরই মধ্য দিয়ে দেশে বন্দর ব্যবস্থাপনায় ল্যান্ড লর্ড মডেলের ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ১ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত এ টার্মিনালটি চুক্তি অনুযায়ী ২২ বছর পরিচালনা করবে প্রতিষ্ঠানটি। টার্মিনালটিতে পণ্য সংরক্ষণাগার ও পণ্যের নিরাপত্তা বিধান করবে বন্দর কর্তৃপক্ষ।’

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, এ বন্দরে এখন তিনটি টার্মিনাল রয়েছে। জিসিবি, সিসিটি ও এনসিটি—এ তিন টার্মিনালেই এতদিন কনটেইনার ওঠানো-নামানোর কাজটি সম্পন্ন হতো। এখন নতুন করে বিদেশী অপারেটরের অধীনে পতেঙ্গা টার্মিনাল চালু হওয়ার মাধ্যমে এ সংখ্যা দাঁড়াল চারে।

চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর থেকে কর্ণফুলী নদী দিয়ে এনসিটি, সিসিটির নদীপথের দূরত্ব ১০ নটিক্যাল মাইলেরও বেশি। কিন্তু পিসিটির দূরত্ব মাত্র ৮ নটিক্যাল মাইল। পুরোদমে যন্ত্রপাতি সংযোজন করা গেলে বছরে প্রায় পাঁচ লাখ কনটেইনার ওঠানামা করানো সম্ভব হবে পিসিটিতে। যেখানে ১০ মিটার গভীরতার জাহাজও ভেড়ানো  যাবে।

সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) আওতায় সৌদি প্রতিষ্ঠান রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে জিটুজি ভিত্তিতে চুক্তি হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানের শতভাগ মালিকানা সৌদি আরব সরকারের। চুক্তি অনুযায়ী, সরবরাহ, পরিচালনা ও হস্তান্তরের ভিত্তিতে টার্মিনালটি পরিচালনা করবে কোম্পানিটি। নিজেদের অর্থে কিউজিসি, রাবার টায়ার্ড গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি কিনে ২২ বছরের জন্য এ টার্মিনাল পরিচালনার বিষয়টি চুক্তিতে রয়েছে।

গত বছরের ৬ ডিসেম্বরে এ বিষয়ে চুক্তির পরই সৌদি প্রতিষ্ঠানটি যন্ত্রপাতি এনে সংযোজন শুরু করে। জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানো-নামানোর জন্য গ্যান্ট্রি ক্রেন স্থাপন করার আগ পর্যন্ত জাহাজের ক্রেন দিয়ে কনটেইনার ওঠানো-নামানোর কার্যক্রম পরিচালনা করবে অপারেটরটি। নিজেদের অর্থে যন্ত্রপাতি কিনে টার্মিনাল পরিচালনা করবে প্রতিষ্ঠানটি। 

চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারকারী টিকে গ্রুপের পরিচালক মুস্তফা হায়দার এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নতুন এ টার্মিনাল চালু হওয়ার খবরটি আমদানিকারকদের জন্য বেশ আনন্দের। দেশের কনটেইনার পরিবহন খাতে এটি একটি নতুন অধ্যায়ও হলো যেটা বন্দরের অপারেশনাল দক্ষতা বাড়বে বলে মনে করি। কি গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ আধুনিক সব যন্ত্র যত দ্রুত সংযোজন করা হবে এ টার্মিনালে তত দ্রুত এর সুফল পাবে বন্দর ব্যবহ্নকারীরা ।’

চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, ১ হাজার ১৪৭ কোটি ৯৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০২২ সালের জুনে নির্মাণকাজ শেষ হয়। বঙ্গোপসাগরের কর্ণফুলী মোহনা থেকে একটু দূরে ড্রাইডক ও চট্টগ্রাম বোট ক্লাবের মাঝামাঝি জায়গায় পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়।

দেশের অন্যতম রফতানিকারক ফোর এইচ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গাওহার সিরাজ জামিল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পিসিটি আন্তর্জাতিক অপারেটর দ্বারা পরিচালিত হওয়ায় বন্দরের কার্যক্রমে আরো গতি আসবে নিশ্চয়ই। আমাদের জন্য স্বস্তি হলো, কত দ্রুত কাঁচামাল হাতে পাই। বেশি ড্রাফটের জাহাজ এখানে ভিড়তে পারবে, এটাও একটা ভালো খবর ব্যবসায়ীদের জন্য।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন