আইএমএফ মিশন শুরু ২৪ এপ্রিল

রিজার্ভ ছাড়া সব শর্ত পূরণ করেছে বাংলাদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি : সংগৃহীত

ঋণের তৃতীয় কিস্তি ছাড়ের আগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) রিভিউ মিশন ২৪ এপ্রিল শুরু হবে। চলবে আগামী ৮ মে পর্যন্ত। মিশনটি ঋণ কর্মসূচির আওতায় থাকা বিভিন্ন মানদণ্ড, লক্ষ্যমাত্রা ও মাপকাঠি পূরণের পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্কার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি পর্যালোচনা করবে। এ মিশনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বাংলাদেশের জন্য তৃতীয় কিস্তির অর্থ ছাড় করবে আইএমএফ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, নিট রিজার্ভ ছাড়া আইএমএফের বাকি সব শর্তই বাংলাদেশ পূরণ করতে পেরেছে।

এর আগে দুবার আইএমএফের রিভিউ মিশনের নেতৃত্বে ছিলেন সংস্থাটির এশীয় ও প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দ। এবারের মিশনে তিনি থাকছেন না। তার পরিবর্তে নেতৃত্ব দিতে পারেন সংস্থাটির ডিভিশন চিফ ক্রিস পাপাইওরগিও কিংবা ডেপুটি ডিভিশন চিফ পিয়াপর্ন নিক্কি সোদশ্রিবিবুন। আইএমএফ মিশনের কর্মকর্তারা অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ (এনবিআর) সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে ঋণ কর্মসূচির বিভিন্ন দিকসহ সামষ্টিক অর্থনীতি, রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি ও ব্যাংক খাতের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করবেন বলে জানা গেছে।

আইএমএফের ঋণ কর্মসূচি অনুসারে কোয়ান্টিটেভ পারফরম্যান্স ক্রাইটেরিয়া (কিউপিসি) বা পরিমাণগত সক্ষমতার মানদণ্ড, ইন্ডিকেটিভ টার্গেটস (আইটি) বা নির্দেশক লক্ষ্য ও স্ট্রাকচারাল বেঞ্চমার্ক (এসবি) বা কাঠামোগত মাপকাঠি পূরণের শর্ত রয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বেঁধে দেয়া এসব শর্ত পূরণের বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখবে আইএমএফ। এর মধ্যে নিট ইন্টারন্যাশনাল রিজার্ভ (এনআইআর), প্রাইমারি ব্যালান্স ও এক্সটার্নাল পেমেন্টস অ্যারিয়ার্সসংক্রান্ত শর্তগুলো কিউপিসির অন্তর্ভুক্ত। এক্ষেত্রে নিট রিজার্ভসংক্রান্ত শর্ত পূরণ করতে পারেনি বাংলাদেশ। গত বছরের জানুয়ারিতে ঋণ অনুমোদনের সময় আইএমএফ বাংলাদেশকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে ২৬ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলারের নিট রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছিল। যদিও দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের সময় এ লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ১৭ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করে দেয় সংস্থাটি। তবে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা অনুসারেও রিজার্ভ সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ। এ বছরের মার্চে ১৯ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলারের নিট রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ করা যায়নি। তবে কিউপিসির অন্তর্ভুক্ত প্রাইমারি ব্যালান্স ও এক্সটার্নাল পেমেন্টস অ্যারিয়ার্সসংক্রান্ত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পেরেছে বাংলাদেশ। 

আইএমএফের নির্দেশক লক্ষ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে রিজার্ভ মানি, কর রাজস্ব, সামাজিক খাতে সরকারের ব্যয় ও সরকারের মূলধনি বিনিয়োগ। দ্বিতীয় কিস্তির সময় আইএমএফের লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে রাজস্ব আহরণ করতে পারেনি এনবিআর। তবে এবার গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত আইএমএফের বেঁধে দেয়া লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হয়েছে। 

কাঠামোগত মাপকাঠির ক্ষেত্রে গত বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে বেশকিছু বিষয় বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছিল আইএমএফ। এর মধ্যে রয়েছে কাস্টমস ও ভ্যাট উইংসে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ইউনিট করা, সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ নিট দেশজ অর্থায়নের এক-চতুর্থাংশের নিচে নামিয়ে আনা, জ্বালানির দাম নির্ধারণে সময়ভিত্তিক পদ্ধতি চালু করা, ট্রেজারি সিঙ্গেল অ্যাকাউন্টের (টিএসএ) বাইরে থাকা ব্যাংক হিসাবগুলোকে একত্রিত করতে নীতি প্রণয়ন ও প্রান্তিক ভিত্তিতে জিডিপির তথ্য প্রকাশ। এর সবগুলোই বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, দ্বিতীয় কিস্তির সময় নিট রিজার্ভ ও রাজস্ব আহরণসংক্রান্ত দুটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত পূরণ করা সম্ভব হয়নি। এবার শুধু নিট রিজার্ভ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সামান্য পরিমাণে পিছিয়ে ছিল। সব ধরনের চেষ্টার পরও বৈশ্বিক কারণে রিজার্ভ পরিস্থিতির আশানুরূপ উন্নতি হয়নি। আইএমএফও বিষয়টি বোঝে। ফলে তৃতীয় কিস্তির অর্থছাড়ে সমস্যা হবে না।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নিট রিজার্ভের শর্ত পূরণ করতে না পারলেও তৃতীয় কিস্তির অর্থছাড়ে তেমন সমস্যা হবে বলে মনে হয় না। তবে আইএমএফ মিশনের পক্ষ থেকে রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হতে পারে। বিনিময় হার নিয়ে আলোচনা হবে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে কোথায় অগ্রাধিকার দেয়া হবে এবং রাজস্ব নীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে আইএমএফের কর্মকর্তারা আলোচনা করবেন। ব্যাংক একীভূতকরণের বিষয়টিও আলোচনায় আসতে পারে। সামনে মুদ্রানীতিতে কোন বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়া হবে, সেটিও আলোচনায় উঠে আসতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘আইএমএফের ঋণ কর্মসূচি শেষ হবে ২০২৬ সালে। সেক্ষেত্রে ২০২৫-২৬ অর্থবছর আমাদের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ঋণ কর্মসূচির শেষ পর্যায়ে কিছু লক্ষ্য থাকে, যেগুলো অর্জনের জন্য আইএমএফ জোর দেবে।’

গত বছরের ৩০ জানুয়ারিতে আইএমএফের নির্বাহী বোর্ডের সভায় বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন হয়। সাত কিস্তিতে ৪২ মাসে এ ঋণ পাবে বাংলাদেশ। ঋণের গড় সুদের হার ২ দশমিক ২ শতাংশ। ৪৭০ কোটি ডলারের মধ্যে দুই ধরনের ঋণ রয়েছে। বর্ধিত ঋণ সহায়তা বা বর্ধিত তহবিল (ইসিএফ অ্যান্ড ইএফএফ) থেকে পাওয়া যাবে ৩৩০ কোটি ডলার। ১৪০ কোটি ডলার মিলবে রেজিলিয়্যান্স অ্যান্ড সাসটেইনিবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) আওতায়। ২০২৬ সাল পর্যন্ত এ ঋণ কর্মসূচি চলাকালীন বাংলাদেশকে বিভিন্ন ধরনের শর্ত পরিপালন ও সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার এবং গত বছরের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বেঁধে দেয়া লক্ষ্যমাত্রা ও শর্ত পরিপূরণ এবং সংষ্কার বাস্তবায়ন মূল্যায়ন করে আগামী মে মাসে তৃতীয় কিস্তির অর্থছাড় হতে পারে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন