আলোকপাত

নয়া কৃষি বিপ্লব ও খাদ্যনিরাপত্তায় ন্যানো প্রযুক্তি

ড. মো. তোফাজ্জল ইসলাম

ছবি : বণিক বার্তা

ন্যানো প্রযুক্তিকে চলমান শিল্প বিপ্লবের সবচেয়ে শক্তিশালী চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ প্রযুক্তি গত অর্ধ শতাব্দীব্যাপী বিশ্বে ইলেকট্রনিকস এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির (আইটি) বিকাশে বিশাল অবদান রেখে আসছে। গত বছর ন্যানো কণা কোয়ান্টাম ডট আবিষ্কার এবং সংশ্লেষণ করার কৃতিত্বের জন্য বিজ্ঞানী মুঙ্গি জি বাউয়েন্ডি, লুইস ই ব্রুস এবং আলেস্কি ইয়েকিমভ রসায়নে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। কোয়ান্টাম ডট ন্যানো কণা নানা ইলেকট্রনিক প্রযুক্তি, ডিসপ্লে প্রযুক্তি, ইমেজিং এবং অনুঘটক হিসেবে প্রাণরাসায়নিক এবং রাসায়নিক বিক্রিয়ায় বহুল ব্যবহৃত হয়। শুধু কি ইলেকট্রনিকস ও আইটি, ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার কৃষি ও জীববিজ্ঞানের প্রসারে এক শক্তিশালী চালিকাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। 

‘ন্যানো’ শব্দটি গ্রিক ‘ন্যানোস’ শব্দ থেকে এসেছে, যার আভিধানিক অর্থ হলো ‘ডোয়ার্ফ’ বা খাটো। কিন্তু এটি একটি মাপের একক। আর ন্যানো মিটার স্কেল বিস্তৃত সব প্রযুক্তিকে সাধারণভাবে ন্যানো প্রযুক্তি বলা হয়। ১৯৬৫ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত যুক্তরাষ্ট্রের তাত্ত্বিক পদার্থবিদ রিচার্ড ফিলিপস ফাইনম্যানকে ন্যানো প্রযুক্তির জনক বিবেচনা করা হয়। তিনি ১৯৫৯ সালের ২৯ জানুয়ারি ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে অনুষ্ঠিত আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটির এক সভায় ‘‌There’s Plenty of Room at the Bottom’ শিরোনামে এক যুগান্তকারী বক্তৃতায় ন্যানো প্রযুক্তির ধারণা দেন। তারপর ন্যানো প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণার যাত্রা শুরু হয়। বিজ্ঞানী কমি এরিক ড্রেক্সলার ‘ন্যানোটেকনোলজি’ শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন। ন্যানো প্রযুক্তিকে সংক্ষেপে ন্যানোটেক বালা হয়। এটি পদার্থকে আণবিক পর্যায়ে পরিবর্তন ও নিয়ন্ত্রণ করার বিদ্যা।

প্রকৃতিতেও রয়েছে ন্যানো প্রযুক্তির অনেক বিস্ময়কর উদাহরণ। যেমন শুধু কাঠামোগত পার্থক্য থাকার কারণে কয়লা নরম, কাল এবং সস্তা, কিন্তু হীরক শক্ত এবং নানা বর্ণের। কয়লা ও হীরক উভয়ই কার্বন দিয়ে গঠিত। শুধু কার্বন অণু সজ্জিত হওয়ার ভিন্নতার জন্য পদার্থ দুটির এ বিস্ময়কর পার্থক্য। প্রতিটি জীবের ডিএনএতে চারটি অণু তথা এডেনিন, গুয়ানিন, সাইটোসিন এবং থায়মিন বৈচিত্র্যময় অনুক্রমে সজ্জিত থাকে। ডিএনএ অণু একটি ন্যানো পদার্থ। ডিএনএ অণু বৈচিত্র্যময় অণুক্রমে সজ্জিত হওয়ার ফলে প্রতিটি জীব অনন্য বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। প্রাকৃতিক ন্যানো পদার্থ ডিএনএ অণুর অনুক্রমে পার্থক্য থাকায় এ পৃথিবীর ৮০০ কোটি মানুষের প্রত্যেকেই স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। বিশ্বে করোনা মহামারী রোগের জীবাণু ভাইরাসও একটি ন্যানো কণা।

প্রয়োজনমাফিক নির্দিষ্ট আকার-আকৃতির বিশিষ্ট ন্যানো কণাগুলো তৈরির সুদক্ষ পরিচালনা ও এর ব্যবহারকে একত্রে ন্যানো প্রযুক্তি বলা হয়। ন্যানো কণা হলো ১ হতে ১০০ ন্যানো মিটার আকারের অতিসূক্ষ বস্তু যা, অণু এবং পরমাণুর সমন্বয়ে গঠিত। ন্যানো মিটার হচ্ছে, এক মিটারের এক কোটি ভাগের এক ভাগ। সেজন্য ন্যানো কণাগুলো আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না। এমনকি সাধারণ মাইক্রোস্কোপ দিয়েও ন্যানো কণাগুলোকে দেখা যায় না। ন্যানো প্রযুক্তি গবেষণায় তাই ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ আবশ্যক। ন্যানো প্রযুক্তিকে একবিংশ শতকের একটি সর্বাপেক্ষা কার্যকর প্রযুক্তি বলা হয়। কারণ এ প্রযুক্তি শিল্পে যেমন বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, বস্তু বিজ্ঞান, জ্বালানি ক্ষেত্র, ওষুধ শিল্প, জীবপ্রযুক্তি এবং কৃষি ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক এবং টেকসই উন্নয়নে চমকপ্রদ অবদান রাখতে সক্ষম। আধুনিক সব ইলেকট্রনিকসের সার্কিট ন্যানো কণাগুলো দিয়ে তৈরি। শুধু ইলেকট্রনিকস শিল্পেই নয়, ক্যান্সারসহ জটিল রোগ নির্ণয় ও নিরাময়, যথাস্থানে ওষুধ প্রয়োগ এবং চিকিৎসা ও জীববিজ্ঞানে ন্যানো প্রযুক্তি এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে।

গত শতাব্দীতে সবুজ বিপ্লবে যে প্রযুক্তিগুলো ব্যবহৃত হয়েছিল, তা শতকোটি মানুষের খাদ্যের জোগান দিয়েছে। সবুজ বিপ্লব এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশকে দুর্ভিক্ষের হাত থেকে রক্ষা করেছে। তবে এ বিপ্লবে ব্যবহৃত অত্যধিক মাত্রায় বাসায়নিক (সার ও বালাইনাশক), পানি সেচ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ পরিবেশ দূষণের মাধ্যমে পরিবেশকে বিপন্ন করে তুলছে। এছাড়া এটি স্পষ্ট যে, সবুজ বিপ্লবের হাতিয়ার কৃষি উপকরণহুলো অত্যধিক মাত্রায় প্রয়োগেও কৃষিতে ফলন বৃদ্ধি অতীতের তুলনায় কম হারে হচ্ছে। কৃষি ক্রমে অলাভজনক শিল্পে পরিণত হচ্ছে। ফলে বর্তমান কৃষি একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল এবং অধিকতর উপকরণ ব্যবহারে উল্লেখযোগ্য সাড়া না দেয়ায় এক সংকটাপন্ন অবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। উচ্চ উৎপাদন খরচ এবং পরিবেশের ওপর কৃষিতে ব্যবহৃত ক্ষতিকর রাসায়নিকের কুপ্রভাবের ফলে সবুজ বিপ্লবের উচ্চ উপকরণনির্ভর শস্য উৎপাদন প্রযুক্তিগুলো ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে কার্যত টেকসই হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে না। অন্যদিকে বিশ্বের জনসংখ্যা ২০৫০ সাল পর্যন্ত আট বিলিয়ন থেকে বেড়ে ৯ দশমিক ৭ বিলিয়ন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পরিবর্তিত জলবায়ুতে রোগবালাইয়ের প্রাদুর্ভাব এবং অজীবীয় অভিঘাতের কারণে ভবিষ্যৎ ফসল উৎপাদন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সব মানুষের খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করতে ২০৫০ সাল পর্যন্ত শস্য উৎপাদন বর্তমানের তুলনায় ৭০-১০০ শতাংশ বাড়াতে হবে। কৃষিতে নতুন চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করে খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে চাহিদার ভিত্তিতে নতুন ও অধিকতর কার্যকর প্রযুক্তির ব্যবহার করা প্রয়োজন। ন্যানো প্রযুক্তি তেমনি একটি ধারালোতম প্রযুক্তি।

কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়াতে ও খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে ন্যানো প্রযুক্তি একটি কার্যকর ও সম্ভাবনাময় কৌশল। ন্যানো কণার ব্যবহার নাটকীয়ভাবে উদ্ভিদ পুষ্টি উন্নয়ন, সার ব্যবহারের দক্ষতা বৃদ্ধি, ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি, খাদ্য প্রক্রিয়াজাত, পানি ব্যবস্থাপনা, রোগ নির্ণয়, বালাই দমন, খাদ্য মোড়কীকরণ, অজীবীয় অভিঘাত সহনশীলতা বৃদ্ধি এবং নিখুঁত (প্রিসিশন) কৃষি উন্নয়নে অবদান রাখতে সক্ষম। উদাহরণস্বরূপ, নতুন ন্যানো কণা কার্যকরভাবে শস্য সংরক্ষণের জন্য বালাইনাশকের কার্যকারিতা এবং নিরাপদ ব্যবহারে উন্নয়ন ঘটাতে পারে। অনুরূপভাবে, ন্যানো সার স্লো রিলিজ বা ধীরে ধীরে উদ্ভিদের গ্রহণ উপযোগী হওয়া ও ধীর অবক্ষয়ের মাধ্যমে কার্যকরভাবে সার ব্যবহারের দক্ষতার প্রভূত উন্নয়ন করতে পারে। ন্যানো কণার ব্যবহার অথবা ন্যানো বাহকের ভেতরে সারের উপাদান ব্যবহার শস্যের বৃদ্ধি ও উৎপাদনশীলতার উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে। 

কৃষি উন্নয়নে ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রগুলো হলো (১) ফসলের রোগ নির্ণয়, জাতভিত্তিক পুষ্টিচাহিদা নির্ণয়, পুষ্টি আহরণ ক্ষমতা বৃদ্ধি; (২) ন্যানো সেন্সর প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ভূমির গুণাগুণ পর্যবেক্ষণ ও উৎপাদন বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ এবং (৩) কৃষিতে ও কৃষি পরিবেশে ভারী ধাতুর উপস্থিতি শনাক্তকরণ ও শোধনসহ ন্যানো প্রযুক্তির সার, বালাইনাশক উদ্ভাবন ও ব্যবহারের মাধ্যমে উপকরণ দক্ষতা অর্জনের উদ্যোগ গ্রহণ। কৃষি গবেষণায় দেখা যায়, বর্তমানে ব্যবহৃত রাসায়নিক সারের ৫০ শতাংশের বেশি ও বালাইনাশকের ৯৮ শতাংশের বেশি নানাভাবে নন-টার্গেটেড জীব ও প্রতিবেশে অপচয় হয়। বর্তমানে এক কেজি চাল উৎপাদনে কয়েক হাজার লিটার পানি ব্যবহার হয়। অস্বাভাবিক হারে অদক্ষ কৃষি উপকরণের ক্রমবর্ধমান ব্যবহারে শুধু যে ফসল উৎপাদন খরচ ভয়ানকভাবে বাড়ছে তা নয়, সেচকাজে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন ও অব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থ পরিবেশ ও প্রতিবেশকে ক্রমে বিপন্ন করে তুলছে। 

জাতীয় কৃষি নীতিতে ন্যানো প্রযুক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করায় দেশে কৃষি শিক্ষা এবং গবেষণায় ন্যানো প্রযুক্তি অগ্রাধিকার পায়। উল্লেখ্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বশেমুরকৃবি) স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ন্যানো বায়োটেকনোলজি পড়ানো হয়। বশেমুরকৃবির ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং (আইবিজিই)-এর বিজ্ঞানীরা পৃথিবীতে প্রথম দিনের আলোতে রিচার্জেবল টাইটেনিয়াম ডাই-অক্সাইড ন্যানো ক্যাটালিস্ট আবিষ্কার করেছেন, যা গমের ব্লাস্ট রোগ দমনে কার্যকরী। বুয়েট ও বশেমুরকৃবির যৌথ গবেষণায় ন্যানো প্রযুক্তির মাধ্যমে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বহুলভাবে ব্যবহৃত সেলুলোজ দিয়ে তৈরি কাগজে জীবাণুরোধী গুণাবলি আরোপ করার কৌশল উদ্ভাবন করা হয়েছে। এ উদ্ভাবন আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির বিখ্যাত জার্নাল এসিএস সাসটেইনেবল কেমিস্ট্রি অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং-এ প্রকাশ হয়েছে। উদ্ভাবিত ন্যানো সিলভার কণা সংযোজিত কাগজ, কৃষিতে গুরুত্বপূর্ণ নানা রকম ব্যাকটেরিয়া ও ক্ষতিকারক ছত্রাক দমনে এটি খুবই কার্যকর হতে পারে। উদ্ভাবিত জীবাণুরোধী এ কাগজ মূল্যবান পণ্য, ওষুধ, খাদ্য ও কৃষিজ পচনশীল উৎপাদন যেমন মাছ, ফলমূল এবং সবজি পরিবহন ও সংরক্ষণে ব্যবহার করা যাবে। এছাড়া অস্ট্রেলিয়া, তাইওয়ান ও জাপানি বিজ্ঞানীদের সহযোগিতায় বশেমুরকৃবির বিজ্ঞানীরা অতি ছিদ্রবহুল ধাতব ন্যানো ক্যাটালাইটিক কনভার্টার উদ্ভাবন করেছেন, যা যানবাহনের জ্বালানি দহনের পর নির্গত বায়ুদূষক পরিশোধনে খুবই কার্যকর। এ গবেষণার ফল ২০১৭ সালে বিশ্বখ্যাত নেচার কমিউনিকেশন জার্নালে প্রকাশ হয়। এছাড়া বাংলাদেশের পাটের আঁশ ও পশুর হাড় থেকে অতি ছিদ্রবহুল ও উচ্চ পৃষ্ঠতলসম্পন্ন মেসো ও ন্যানো কার্বন তৈরি করা হয়েছে। এসব প্রাকৃতিক উৎস থেকে তৈরি ন্যানো ও মেসো কার্বন অতি মূল্যবান শিল্পসামগ্রী হিসেবে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন সম্ভব। বাংলাদেশে পাট ও পশুর হাড় পর্যাপ্ত পরিমাণে রয়েছে। সুতরাং উদ্ভাবিত ন্যানো কার্বন কণা প্রযুক্তিভিত্তিক শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে আরো চাঙ্গা করা সম্ভব। এছাড়া আমাদের বিজ্ঞানীরা পাট থেকে অত্যন্ত মূল্যবান সুগার মনোমার তৈরির কৌশল আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন। ন্যানো প্রযুক্তিবিষয়ক আমাদের গবেষণার ফলাফল বিশ্বখ্যাত নেচারস সায়েন্টিফিক রিপোর্টস, মাইক্রোপোরাস ও মেসোপোরাস ম্যাটেরিয়েলস, ম্যাটেরিয়াল কেমিস্ট্রি অ্যান্ড ফিজিকস, সাসটেইনেবল এনার্জি ফুয়েলস, জার্নাল অব ভিজুয়ালাইজড এক্সপেরিমেন্টস, জার্নাল অব ন্যানো সায়েন্স অ্যান্ড ন্যানো টেকনোলজি, জার্নাল অব ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি, ইউরোপিয়ান জার্নাল অব ইনঅর্গানিক কেমিস্ট্রি, ম্যাটেরিয়ালস লেটার ইত্যাদি সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। ক্লাইমেট-স্মার্ট এবং প্রিসিশন (নিখুঁত) কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে লাভজনক ও টেকসই কৃষি অর্জনে সীমিত ভূমি থেকে ভবিষ্যৎ খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে ন্যানো টেকনোলজির প্রয়োগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

কৃষিতে ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহারে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা সমাধানের জন্য গবেষণা করা প্রয়োজন। যেমন অধিকাংশ ন্যানো কণার বাণিজ্যিক উৎপাদন কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল। কৃষিতে ন্যানো কণা বাণিজ্যিকীকরণের আগে এর সম্ভাব্য ক্ষতিকারক দিকগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, শর্করাভিত্তিক ন্যানো কণার ন্যানোটক্সিক কার্যকারিতা নেই এবং ফলে তা সার, বালাইনাশক ও জৈব অনুঘটক ও ওষুধ ডেলিভারি প্রক্রিয়ায় বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা সম্ভব। 

বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশগুলোয় ন্যানো প্রযুক্তি যেসব ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গবেষণা এবং বাণিজ্যিক ব্যবহার করা প্রয়োজন, সেগুলো হলো উদ্ভিদপুষ্টি, শস্য সংরক্ষণ, রোগবিস্তার সংক্রান্ত বিষয় ও আবহাওয়ার পূর্বাভাস, রোগনির্ণয়, জীবপ্রযুক্তি, প্রাণিস্বাস্থ্য, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, পণ্য প্যাকেটজাত, পানি ব্যবহার দক্ষতা উন্নয়ন এবং নিখুঁত (প্রিসিশন) কৃষি কার্যক্রম। ন্যানো কণা ব্যবহারে আরো যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে তা হলো— (১) কিছু ন্যানো কণার পেটেন্ট রয়েছে, যার জন্য অনুমতি ব্যতিরেকে ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। (২) কৃষিতে ন্যানো কণা ব্যবহারের ক্ষেত্রে যথাযথ আইন ও নীতির অপ্রতুলতা রয়েছে। (৩) উন্নয়নশীল দেশগুলোয় ন্যানো কণার গবেষণায় সামর্থ্যের (মানবসম্পদ ও স্থাপনা) সীমাবদ্ধতা রয়েছে। (৪) ন্যানো বিষাক্ততা—কিছু ন্যানো কণা জিন বিবর্তন (মিউটেশন) করতে সক্ষম, ডিএনএ ধ্বংস করে এবং ন্যানো নন-টার্গেটেড জীবের প্রতি বিষাক্ততা তৈরি করতে পারে। সেজন্য কৃষিতে নতুন ন্যানো কণা সূচনার আগে এর যথযথ নিরাপদ ব্যবহারের ওপর গবেষণার যথেষ্ট প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও শিল্পের (ইন্ডাস্ট্রির) সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা পার্টনারশিপ খুবই দুর্বল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মৌলিক জ্ঞান সৃজনের লক্ষ্য নির্ধারণ এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে আবিষ্কৃত নতুন জ্ঞানের বাণিজ্যিকীকরণে রোডম্যাপ তৈরি আশু প্রয়োজন। 

বর্তমান বাংলাদেশ সরকার আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবান্ধব। কৃষিতে ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহারের অন্তর্ভুক্তি জাতীয় কৃষিনীতি ২০১৮ যে যথেষ্ট ভবিষ্যৎমুখী, তা প্রমাণ করে। যদিও বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে ন্যানো প্রযুক্তি কৃষকের মাঠ পর্যায়ে এখনো তেমন একটা শুরু হয়নি। বাংলাদেশে কৃষিতে ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে, রোগনির্ণয়, রোগবালাই ব্যবস্থাপনা ন্যানোপেস্টিসাইড, ন্যানোফার্টিলাইজার, ন্যানোহার্বিসাইড, অগ্রাধিকারভিত্তিক, ফুড প্যাকেজিং, ওষুধ সরবরাহ, মৃত্তিকা দূষণ নির্ণয় ও দূরীকরণ, ফসল উন্নয়ন (জাত), উদ্ভিদে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত সহনশীলতা বৃদ্ধি, ন্যানোসেন্সর, সেচের দক্ষতা বৃদ্ধি, প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষণ এবং নিখুঁত (প্রিসিশন) কৃষি। 

আমি মনে করি, দেশে ন্যানোটেক গবেষণার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে, ন্যানো কণা বৈশিষ্ট্যায়নের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাব। ন্যানো পদার্থের বৈশিষ্ট্যায়নের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, যেমন স্ক্যানিং টানেলিং মাইক্রোস্কোপ, ট্রান্সমিশন ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ, অ্যাটমিক ফোর্স-মাইক্রোস্কোপ ইত্যাদি কেন্দ্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করলে দেশে ন্যানো প্রযুক্তি গবেষণায় গতি সঞ্চার হবে। কৃষিতে ন্যানো প্রযুক্তির সফল প্রয়োগের লক্ষ্যে জরুরিভিত্তিক কিছু কর্মসূচি গ্রহণ প্রয়োজন। এগুলো হলো: (১) জীবপ্রযুক্তির ন্যায় দেশে ন্যানো প্রযুক্তিবিষয়ক একটি টাস্কফোর্স গঠন করা। (২) দেশে ন্যানো প্রযুক্তি বিষয়ে একটি সম্মেলন আয়োজন করা। এটা জাতীয়ভাবে ন্যানো প্রযুক্তিতে বিশেষজ্ঞ এবং কৃষি গবেষণায় অবদান রাখতে সক্ষম বিজ্ঞানীদের সামর্থ্য জানা যাবে। (৩) ন্যানো প্রযুক্তি বিষয়ে একটি স্বতন্ত্র গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ গ্রহণ এবং কেন্দ্রীয়ভাবে ভৌত সুবিধাদি প্রতিষ্ঠাকরণ। এক্ষেত্রে শ্রীলংকার SLINTEC নামক ন্যানো প্রযুক্তিবিষয়ক প্রতিষ্ঠানের সফলতার অভিজ্ঞতার অনুসরণ করা যেতে পারে। (৪) কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠক্রমে ন্যানো প্রযুক্তিবিষয়ক কোর্স ও বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্তকরণ। (৫) তরুণ গবেষকদের ন্যানো প্রযুক্তিবিষয়ক প্রশিক্ষণের আয়োজন। (৬) জাতীয় ও আন্তর্জতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানীদের নিয়ে ইন্টারডিসিপ্লিনারি গবেষক দল গঠন করে টার্গেট ওরিয়েন্টেড গবেষণার জন্য গবেষণা বরাদ্দ প্রদান। (৭) সরকারি প্রতিষ্ঠান ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে গবেষণার ফলাফলগুলো দ্রুত ব্যবহারোপযোগী শিল্প উপাদানে রূপান্তরে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং (৮) ন্যানো প্রযুক্তি বিষয়ক একটি জাতীয় পেশাজীবী সংগঠন প্রতিষ্ঠা। সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় সরকার দেশে ইনস্টিটিউট অব ন্যানোটেকনোলজি প্রতিষ্ঠার জন্য ৩৮০ দশমিক ৭৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করেছে। সব বাস্তবতার নিরিখে বাংলাদেশে একটি ন্যানোটেকনোলজি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা খুবই সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। তবে জাতীয়ভাবে অবদান রাখতে হলে প্রতিষ্ঠানটি ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ন্যানোটেকনোলজি’ (BINTech বা বিনটেক) হওয়া সমীচীন বলে মনে করি, যেখানে কৃষি, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, জ্বালানি ও অন্যান্য বিষয়ে শিল্পের বিকাশে মাল্টিডিসিপ্লিনারি গবেষণা করবে এবং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশের চাহিদামাফিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করবে। জাতীয়ভাবে ন্যানোটেকনোলজি বিষয়ে শিক্ষা, গবেষণা, প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং শিল্পোন্নয়নের লক্ষ্যে জাতীয় ন্যানোটেকনোলজি নীতি প্রণয়ন জরুরি। 

ড. মো. তোফাজ্জল ইসলাম: অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ফুলব্রাইট ফেলো এবং বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমির স্বর্ণপদক বিজয়ী কৃষিবিজ্ঞানী

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন