অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ডাবল লাইন রেলপথ নির্মাণ

৮৯৭ কিলোমিটার লক্ষ্য থাকলেও চার বছরে হয়েছে কেবল ৮৫ কিলোমিটার

শামীম রাহমান

ছবি : বণিক বার্তা

দেশজুড়ে সাড়ে চার হাজার কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ের। এর মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ বাদে প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ রেলপথই সিঙ্গেল লাইনের। এসব পথে ট্রেন চলে আবার সক্ষমতার চেয়েও বেশি। ফলে যাত্রাপথে লাগে বাড়তি সময়। প্রায়ই এলোমেলো হয় সময়সূচি। এ প্রেক্ষাপটে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০২০-২৫) দেশের ব্যস্ততম ৮৯৭ কিলোমিটার পথকে ডাবল লাইনে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে রেলওয়ে। এ পরিকল্পনার চার বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত কেবল ৮৫ দশমিক ৫১ কিলোমিটার রেলপথকে ডাবল লাইনে উন্নীত করতে পেরেছে সংস্থাটি।

রেলওয়ে কর্মকর্তারা বলছেন, ডাবল লাইনের রেলপথ তৈরিতে বড় অংকের বিনিয়োগ প্রয়োজন। মূলত এ বিষয়ে জটিলতার কারণেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছে। যদিও যোগাযোগ অবকাঠামো বিশেষজ্ঞরা রেলের উন্নয়ন দর্শনেই ভুল দেখছেন। তারা বলছেন, বর্তমানে দেশের ব্যস্ততম রেলপথগুলো ডাবল লাইন করার বিকল্প নেই। অথচ রেলওয়ে হাঁটছে উল্টোপথে। ডাবল লাইন রেলপথ তৈরির বদলে সংস্থাটি এমন সব প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে, যার খুব একটা সুফল সাধারণ মানুষ পাচ্ছে না। দেশের অর্থনীতিতেও এসব প্রকল্প অবদান রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। 

উদাহরণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা ঈশ্বরদী-পাবনা-ঢালারচর, গোপালগঞ্জ-কাশিয়ানী-ভাটিয়াপাড়ার মতো রেলপথগুলোর কথা বলছেন। এসব রেলপথ নির্মাণে কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ হলেও সেভাবে ব্যবহার হচ্ছে না। বিপরীতে সক্ষমতার দ্বিগুণেরও বেশি ট্রেন চলাচল করছে সিঙ্গেল লাইনের জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী রেলপথে। একই অবস্থা জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ-জামালপুর, খুলনা-দর্শনা, আখাউড়া-সিলেট, আব্দুলপুর-পার্বতীপুর, রাজশাহী-আব্দুলপুরের মতো রেলপথগুলোর। 

অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আখাউড়া-লাকসামের ৭২ কিলোমিটার রেলপথ, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের ১২ কিলোমিটার, ঢাকা-টঙ্গী-জয়দেবপুরের ৫০ দশমিক ৮, খুলনা-দর্শনার ১৪০ দশমিক ৬৫, ঈশ্বরদী-জয়দেবপুরের ১৮৭ দশমিক শূন্য ১, জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ-জামালপুরের ১৪৪ দশমিক ৭, আখাউড়া-সিলেটের ৮৫, আব্দুলপুর-পার্বতীপুরের ৭০ ও রাজশাহী-আব্দুলপুরের ৪৩ কিলোমিটার রেলপথ ডাবল লাইনে উন্নীত করার পরিকল্পনা ছিল। আর সেই পরিকল্পনায় ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪৫ কিলোমিটার, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩৩, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২২৯ দশমিক শূন্য ৮, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২০৬ দশমিক ৭ ও ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১৯০ দশমিক ৬৬ কিলোমিটার ডাবল লাইন রেলপথ নির্মাণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। অথচ গত ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র ৮৫ দশমিক ৫১ কিলোমিটার বাস্তবায়ন করতে পেরেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।

দেশের ব্যস্ততম রেলপথগুলো আরো আগেই ডাবল লাইনে উন্নীত করা উচিত ছিল বলে মনে করেন যোগাযোগ অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সামছুল হক। এ প্রসঙ্গে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌রেলকে লাভজনক করতে গেলে ট্রেন পরিচালনায় যথেষ্ট পরিমাণ কৌশলী হতে হয়। আর কৌশলী ট্রেন পরিচালনার জন্য দরকার ডাবল লাইন রেলপথ। এতে যেমন অধিকসংখ্যক ট্রেন পরিচালনা করা যায়, তেমনি ট্রেন চলাচলের সময়ও কমিয়ে এনে উন্নত যাত্রীসেবা দেয়া যায়। রেলের উন্নয়নে সরকারের নানা পরিকল্পনা-মহাপরিকল্পনা থাকে, কিন্তু এগুলো কেবল কাগজে-কলমেই। এখানে উন্নয়ন হয় প্রকল্পকেন্দ্রিক। আর প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংস্থা হিসেবে রেলওয়ের পেশাদারিত্বে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে।’

রেলপথ মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের ব্যস্ততম ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথটি ডাবল লাইন হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ২০১৭ সালে ঠিকাদার নিয়োগ করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। যদিও মাত্র ১২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ রেলপথের কাজ এখন পর্যন্ত শেষ করতে পারেনি সংস্থাটি। প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়িয়ে নেয়া হয়েছে ২০২৬ সাল পর্যন্ত। একইভাবে ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায় চলমান রয়েছে ঢাকা-টঙ্গী-জয়দেবপুর রেলপথ সম্প্রসারণের কাজ।

অন্যদিকে খুলনা-দর্শনা রেলপথটি ডাবল লাইন করার জন্য ২০১৮ সালে একটি প্রকল্প পাস হলেও তা মাঠ পর্যায়ে প্রস্তুতিমূলক কাজেই থমকে রয়েছে। একই অবস্থা ঈশ্বরদী-জয়দেবপুর, জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ-জামালপুর রেলপথের।

অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় থাকা আখাউড়া-লাকসামের ৭২ কিলোমিটার রেলপথের কাজ কেবল সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এটি ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের অংশ। আখাউড়া-লাকসাম অংশ চালুর মধ্য দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রামের পুরো ৩২১ কিলোমিটার রেলপথ ডাবল লাইনে উন্নীত হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা ডাবল লাইন রেলপথ নির্মাণে রেলওয়ের পেশাদারত্বের ঘাটতি দেখলেও সংস্থাটির কর্মকর্তাদের দাবি, পর্যায়ক্রমে গুরুত্বপূর্ণ রেলপথগুলো ডাবল লাইন করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্বে) সরদার সাহাদাত আলী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌পর্যায়ক্রমে দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ রেলপথ ডাবল লাইনে উন্নীত করা হবে এবং এর জন্য বিভিন্ন প্রকল্প চলমান আছে। এর মধ্যে কোনোটি আলোচনার পর্যায়ে আছে, কোনোটি সমীক্ষা পর্যায়ে আছে, কোনোটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব তৈরির পর্যায়ে আছে। সব প্রকল্প তো আর লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী হবে না। কারণ এখানে বড় ধরনের বিনিয়োগের বিষয় রয়েছে। এজন্য এডিবি, বিশ্বব্যাংক, জাইকার মতো উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর ওপর আমাদের নির্ভর করতে হয়। লক্ষ্য অনুযায়ী আমরা ডাবল লাইন রেলপথ তৈরির কাজগুলো এগিয়ে নিতে পারিনি এটা ঠিক, তবে ভবিষ্যতে আমরা লক্ষ্য অনুযায়ীই কাজগুলো করব।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন