অভিমত

যানজট নিরসনে সম্মিলিত উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন

আনোয়ার ফারুক তালুকদার

ছবি : বণিক বার্তা

মতিঝিল থেকে ধানমন্ডির দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটার। এ দূরত্ব পার হতে ১ থেকে ৩ ঘণ্টা সময় লাগে। অথচ স্বাভাবিক নিয়মে গাড়ি চললে ১২ থেকে ১৮ মিনিট সময় লাগে। আর মেট্রোরেলে তো মতিঝিল থেকে শাহবাগ যেতে লাগে ৯ মিনিট। মেট্রোরেলের এ যুগেও ঢাকা শহরের এ অসহনীয় আপদের নাম যানজট। রমজান মাসে মনে হয় এটি আরো অসহনীয় হয়ে উঠেছে। এটি শুধু আমাদের ঢাকা শহরের সমস্যাই নয়। বিশ্বের অনেক দেশ এ সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে এবং কিছুটা হলেও তারা সমাধান করতে পেরেছে। যেমন ভারতের কলকাতা শহর। আসুন জেনে নিই একটি আদর্শ শহর কেমন হওয়া উচিত। একটি দেশের ভূমি ব্যবস্থাপনায় মোট আয়তনের ২৫ ভাগ যেমন বনভূমি থাকা প্রয়োজন, ঠিক তেমনি শান্তিপূর্ণ ও স্বস্তিদায়ক চলাচলের জন্য একটি আধুনিক শহরে মোট আয়তনের ২০-২৫ ভাগ সড়ক থাকা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের মেগাসিটি ঢাকায় সড়ক আছে মাত্র ৭-৮ ভাগ। অর্থাৎ প্রয়োজনের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ সড়ক আছে। ঢাকা শহরের মোট এলাকা ১ হাজার ৩৫৩ বর্গকিলোমিটার আর ঢাকার বর্তমান রাস্তার আয়তন ২ হাজার ২০০ কিলোমিটার, যার মধ্যে ২১০ কিলোমিটার প্রধান সড়ক। ট্রাফিক বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, সেই সড়কের প্রায় ৩০ ভাগ বা তার বেশি দখল হয়ে আছে অবৈধ পার্কিং, হকারসহ এবং নানা ধরনের দখলদারদের হাতে। এছাড়া ফুটপাত হকারদের দখলে থাকায় প্রধান সড়কের ওপর দিয়ে হেঁটে চলেন নগরবাসী। ফলে যানজটের সঙ্গে তৈরি হয় জনজট সমস্যা। গাড়ি সামনে আছে কিনা তা দেখার সুযোগ থাকে না আমাদের পথচারীদের। প্রায়ই দেখা যায় গাড়ি চলার জন্য সবুজ সংকেত যখনই পাওয়া যায় তখনই আমরা রাস্তা পারাপার শুরু করি। এটিও যানজটের জন্য অন্যতম কারণ। 

রাজধানী ঢাকায় যানজটের কারণে প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। ফলে রাষ্ট্র ও জনগণের সম্মিলিত আর্থিক ক্ষতি হয় বছরে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। এ তথ্য বিশ্বব্যাংকের। ২০৩৫ সাল নাগাদ ঢাকার উন্নয়ন সম্ভাবনা নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এ তথ্য এসেছে। টাকার অংক ছাড়া শারীরিক, মানসিক ক্ষতি হিসাবে নিলে জীবন হয়ে ওঠে আরো দুর্বিষহ। গাড়িতে বসে থাকতে থাকতে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে যাত্রী। চিন্তাশক্তি লোপ পাচ্ছে। পারিবারিক সময় কমে যাচ্ছে। সন্তানরা কম সময়ের জন্য বাবা-মাকে পাচ্ছে। পরবর্তী দিনের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার সময় কেড়ে নিচ্ছে যানজট। এ ভয়াবহ যানজটের আর্থিক ক্ষতি ছাড়াও সামাজিক, মানবিক ক্ষতি অনেক অনেক বেশি। যানজটের কারণে নির্ধারিত সময়ে ঢাকার মধ্যে যেকোনো গন্তব্যে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়েছে।

রাজধানী ঢাকায় যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে অতিরিক্ত প্রাইভেটকারের উপস্থিতি। রাস্তার যানবাহনের প্রায় ৮০ শতাংশ প্রাইভেটকার। কোনো কোনো পরিবারের তিন-চারটি প্রাইভেটকার রয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রাইভেট গাড়ি মাত্র একজন যাত্রী পরিবহন করে থাকে। একটি রিপোর্টে দেখা যায় যে, রাজধানীর মোট রাস্তার ৫৪ দশমিক ২ শতাংশ জায়গা দখলে রাখে প্রাইভেটকার। বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, ঢাকা শহরে এখন ঘণ্টায় গড়ে প্রায় সাত কিলোমিটার গতিতে চলছে যানবাহন। যানবাহনের পরিমাণ যদি বাড়তে থাকে তাহলে ২০২৫ সালে এ শহরে যানবাহনের গতি হবে ঘণ্টায় চার কিলোমিটার, যা মানুষের হাঁটার গতির চেয়ে কম। মানুষের হাঁটার গড় গতি ঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটার বলে মনে করা হয়। সঠিক পরিকল্পনা না থাকায় নগরীতে গাড়ির সংখ্যা বাড়লেও গণপরিবহন খাতে বিদ্যমান বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা যানজটের একটি বড় কারণ।

আমরা যারা পরিবহন বিশেষজ্ঞ নই, তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে ঢাকা শহরের যানজট সমস্যা থেকে মুক্তির কিছু উপায় নিয়ে আলোচনা করতে চাই। সাধারণ জনগণ যারা প্রতিদিন এ যানজটের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হন তাদের কাছ থেকে শোনা কিছু পরামর্শ যানজট নিরসনে কিছুটা হলেও কাজে লাগতে পারে। স্বল্পমেয়াদে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো নিলে সুফল পাওয়া যেতে পারে। যানজট কমাতে প্রথমেই যে গুরুত্বপূর্ণ কাজে হাত দেয়া প্রয়োজন তাহলো মেট্রোরেল আমাদের যে শিক্ষা দিচ্ছে তা থেকে শিক্ষা নিয়ে গণপরিবহনের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা। গণপরিবহন ব্যবস্থাকে গুচ্ছ মালিকানা ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসা। মেট্রোরেলের মতো যাত্রার স্থান এবং সর্বশেষ গন্তব্য নির্ধারণ করে প্রতিটি রাস্তায় গণপরিবহন নির্দিষ্ট সময় মোতাবেক ছেড়ে আসবে, প্রতিটি স্টপেজে নির্দিষ্ট সময় দাঁড়াবে তারপর ছেড়ে চলে যাবে। এভাবে ক্রমান্বয়ে চলতে থাকবে। যাত্রীর জন্য মেটোরেলের মতো সময় বেঁধে দেয়া থাকবে। যাত্রী কমবেশি যা-ই হোক বাস সময়মতো ছেড়ে যাবে। একই রুটে একই কোম্পানির গাড়ি চলাচল করবে। ফলে রাস্তায় নৈরাজ্য, যাত্রী নিয়ে টানাটানির মতো ঘটনা ঘটবে না। চালক ও সহযোগীদের বেতন নির্দিষ্ট করে দেয়া। পরিবহন মালিক ও সরকার এদিকে নজর দিলে এখনই যানজটের তীব্রতা কিছুটা কমিয়ে আনা সম্ভব। জোড়-বিজোড় সংখ্যায় নিবন্ধিত প্রাইভেট গাড়ি একদিন পরপর চলাচল করবে। সঙ্গে সঙ্গে গণপরিবহনের সংখ্যা এবং সুযোগ-সুবিধা বাড়লে প্রাইভেট গাড়ি এমনিতেই কমে আসবে। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় অটো সিগন্যাল বাতিতে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। সবুজ বাতির বদলে ট্রাফিক পুলিশের হাত যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করা থেকে বিরত রাখা উচিত। রেল ক্রসিংগুলোয় ওভারব্রিজ তৈরি করলে যানজট অনেকাংশে নিরসন হবে। ভিআইপি চলাচলের সময় রাস্তায় অন্য গাড়ির স্বাভাবিক চলাচল বিঘ্নিত না করা। কর্মদিবসে যেকোনো রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা। অফিস শুরু এবং শেষের সময় বিবেচনায় কিছু সমান্তরাল সড়কে একমুখী যান চলাচল ব্যবস্থা চালু করলে সুফল পাওয়া যেতে পারে। ইউলুপ নির্মাণ করা। যেখানে সেখানে গাড়ি ডানে, বায়ে চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা। একই সড়কে যান্ত্রিক বাহন এবং অযান্ত্রিক যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা। তার আগে রিকশাচালকদের জন্য সড়ক নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। যদিও এখন কিছু কিছু এলাকায় এ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এটি বিস্তৃত করা যেতে পারে। নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে যেখানে সেখানে গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। পার্কিংয়ের নিয়ম ভঙ্গ করলে উচ্চ হারে জরিমানা আরোপ করা যেতে পারে। মানুষ হেঁটে চলার জন্য ফুটপাত হকার মুক্ত করে দিতে হবে। হকারদের জন্য হলিডে মার্কেট চালু করা যেতে পারে। এখন যেসব এলাকায় সাপ্তাহিক বন্ধের দিন আছে সেসব এলাকায় ওইদিন হকারদের বসার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। স্বল্প দূরত্বে নাগরিকদের হেঁটে চলার জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। বৃত্তাকার নৌপথ ব্যবহারের জন্য যাত্রীদের উৎসাহিত করা দরকার। 

যানজট নিরসনে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেয়া যেতে পারে। রফতানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে পর্যায়ক্রমে ঢাকার বাইরে স্থানান্তর করা। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে যেসব পণ্য আমদানি ও রফতানি হয় সেগুলোর যাবতীয় কাজ যাতে চট্টগ্রাম থেকে ওয়ান স্টপ সেবার মাধ্যমে সম্পন্ন করা যায় তার ব্যবস্থা করা। প্রাথমিক পর্যায়ের বিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা নিজ ওয়ার্ড এলাকার বিদ্যালয়ে যাতে পড়াশোনা করতে পারে সে ব্যবস্থা করা, তেমনি মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ থানায় অবস্থিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে। ঢাকা শহরের চতুর্দিকে বৃত্তাকার রেলপথ নির্মাণ করা যেতে পারে। যানজট নিরসনে রাজধানীর রাস্তাগুলো প্রশস্তকরণ, ফ্লাইওভার নির্মাণ, বিদ্যমান ফ্লাইওভারগুলোকে আরো বিস্তৃত করা যায়। যেমন মগবাজারের ফ্লাইওভার সোনারগাঁওয়ের সার্ক ফোয়ারা পার করে দিলে ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুরগামী অনেক গাড়ি চলাচলে যানজট এড়ানো সম্ভব হতো। ফ্লাইওভারগুলোর নির্মাণ ত্রুটি দূর করা। সর্বোপরি এ নগরীকে বাসযোগ্য রাখতে প্রয়োজন ব্যাপকভিত্তিক পরিকল্পনা ও এর বাস্তবায়নের উদ্যোগ। এজন্য সরকারের সদিচ্ছা এবং দৃঢ় মনোবল দরকার। আমরা নিম্ন মধ্যম আয় এবং উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছে গেছি। ২০৪১ সাল বেশি দূরে নয়। যে লক্ষ্যে আমরা এগোচ্ছি তা বাস্তবায়ন করতে গেলে আর সময়ক্ষেপণ না করে এখনই যানজট নিরসনে সম্মিলিত উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। 

আনোয়ার ফারুক তালুকদার: ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন