পরিবেশ দূষণে অকালমৃত্যু, ক্ষয় জিডিপির

টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে পরিবেশ দূষণ রোধ করতে হবে

ছবি : বণিক বার্তা

অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হলো জনবল। জনমিতিক লভ্যাংশ অর্জিত হয় কর্মক্ষম জনসংখ্যার মাধ্যমে। জনগণকে কর্মক্ষম রাখতে হলে সুস্থ জীবনের নিশ্চয়তা প্রদান করা জরুরি। একই সঙ্গে মানসম্মত কর্মপরিবেশও নিশ্চিত করতে হবে। নয়তো অর্থনৈতিক উন্নয়ন কখনো টেকসই হবে না। তবে এর বিপরীতে রয়েছে নির্মম সত্য। অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিবেশ দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বায়ু, পানি, মাটি দূষণ করে চলছে। শিল্পায়নের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার শুরু হলে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন বাড়তে থাকে। অর্থাৎ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন শুরু হয় এবং ক্রমেই পরিবেশ দূষিত হতে থাকল। বর্তমানে এ দূষণ উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের ‘দ্য বাংলাদেশ কান্ট্রি এনভায়রনমেন্ট অ্যানালাইসিস (সিইএ)’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণের ফলে বছরে ২ লাখ ৭২ হাজার মানুষের অকালমৃত্যু হচ্ছে। এর মধ্যে শুধু বায়ুদূষণে ৫৫ শতাংশের মৃত্যু হচ্ছে। পাশাপাশি অনিরাপদ পানি, নিম্নমানের স্যানিটেশন ও হাইজিন এবং সিসা দূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ২০১৯ সালে পরিবেশ দূষণের ফলে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে মোট জিডিপির ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ। এতে বায়ুদূষণের অবদান ছিল ৮ দশমিক ৩২ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে মানুষ বায়ুদূষণের কারণে। অথচ স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের জন্য সবচেয়ে অপরিহার্য পরিবেশগত উপাদান হলো বিশুদ্ধ বায়ু।

২০২২ সালে বেসরকারি স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) কর্তৃক প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দেশে ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫৪টি জেলারই বায়ুর মান আদর্শ মাত্রার চেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে। পাশাপাশি অতিরিক্ত দূষিত হিসেবে চিহ্নিত করা হয় দেশের ১৮টি জেলাকে। সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার ‘বৈশ্বিক বায়ুমান প্রতিবেদন ২০২৩’ প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, সর্বোচ্চ বায়ুদূষণের তালিকায় ২০২৩ সালে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। যেখানে ২০২২ সালের প্রতিবেদনে সর্বোচ্চ বায়ুদূষণের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল পঞ্চম।

বায়ুদূষণের অন্যতম উপাদান ‘পিএম ২.৫ বা অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার উপস্থিতি হিসাব করেই মূলত বায়ুমান নির্ণয় করা হয়। ২০২৩ সালে বাংলাদেশে প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার উপস্থিতি ছিল ৭৯ দশমিক ৯ মাইক্রোগ্রাম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্যমতে, প্রতি ঘনমিটার বাতাসে এ অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণ ৫ মাইক্রোগ্রামের বেশি হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। সুতরাং গত বছরে বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার উপস্থিতি ছিল ডব্লিউএইচওর আদর্শ মানদণ্ডের প্রায় ১৬ গুণ।

বায়ুমণ্ডলের অতিক্ষুদ্র ধূলিকণা সহজেই মানবদেহে প্রবেশ করে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আক্রান্ত করে। বায়ুদূষণ থেকে যেসব স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি হয়, এর মধ্যে গুরুতর হলো শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসের সংক্রমণ, নির্দিষ্ট কিছু ক্যান্সার, অ্যালার্জি, প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস ইত্যাদি। বাতাসে সিসার অতিরিক্ত উপস্থিতিতে শিশুদের বুদ্ধিমত্তা লোপ পাচ্ছে, মস্তিষ্ক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আবার শুধু মানবশরীরের ক্ষতি হচ্ছে এমন নয়, বায়ুদূষণে পানিও দূষিত হয়। ক্ষুদ্রাকার কণাগুলো বাতাসে ভেসে বেড়ায় এবং একসময় অ্যাসিড বৃষ্টির সূত্রপাত ঘটায়, পানির বিভিন্ন উৎস দূষিত হয়।

সত্তরের দশকের আগে দেশে সুপেয় পানির প্রধান উৎস ছিল ভূপৃষ্ঠ বা পুকুর, নদী-খাল, বৃষ্টি আর জমিয়ে রাখা পানি। সত্তরের দশকের শুরুতে কৃষিকাজের জন্য দেশে প্রথম ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার শুরু হয়। আশির দশকে তা ব্যাপকতা পায়। নিত্য প্রয়োজন থেকে শুরু করে কৃষি ও শিল্পপণ্য উৎপাদনসহ নানা কাজে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হয়েছে সবাই। যদিও নিরাপদ নয় ভূগর্ভস্থ পানিও। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের দুই শিক্ষকের করা রিভিউ গবেষণায় দেশের অন্তত আট জেলার ভূগর্ভস্থ পানিতে লেড, ক্রোমিয়াম, নিকেলসহ বেশকিছু ভারী ধাতুর অস্তিত্ব মিলেছে। পানিতে মিশে থাকা এসব ধাতু মানবশরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ক্ষতিকর ভারী ধাতু ও দূষিত পদার্থ মিশ্রিত পানি পান করায় মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে সাধারণত অগভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করা হয়। অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের ফলে এখন বছরের একটা সময়ে, বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে পানি পাওয়া যায় না। কিন্তু কলকারখানার বর্জ্য, হাসপাতালের বিষাক্ত বর্জ্য, কৃষিজমিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থ ইত্যাদি মাটিতে মিশে ভূ-উপরিস্থ পানি দূষণ বাড়িয়েছে। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমানো সম্ভব হয় না। বায়ু ও পানি দূষণের সঙ্গে মাটি দূষণও বেড়েছে। 

জাতিসংঘের প্রতিবেদন মতে, শিল্প দূষণ, খনি, কৃষিকাজ ও দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা মাটিকে বিষিয়ে তুলছে। দূষণকারী পদার্থের মধ্যে রয়েছে নানা ধরনের ধাতু, সায়ানাইড, ডিডিটি ও নানা ধরনের কীটনাশক এবং পিসিবির মতো দীর্ঘস্থায়ী জৈব রাসায়নিক পদার্থ। দূষণের কারণে খাদ্য ও পানি অনিরাপদ হওয়ার পাশাপাশি ফসল উৎপাদনের ক্ষমতা কমে যাচ্ছে মাটির। বিভিন্ন প্রয়োজনে প্রতি বছর শিল্পে রাসায়নিকের ব্যবহার বাড়ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে রাসায়নিকের ব্যবহার দ্বিগুণ হতে পারে। অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল, প্লাস্টিকসহ নতুন নতুন দূষণকারী পদার্থ সম্পর্কে সতর্ক থাকা জরুরি।

দেশে মাটির গুণগত মান দুর্বল হয়ে পড়ছে। মাটিতে রাসায়নিক উপাদানের পরিমাণ কমে আসছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে খাদ্য উৎপাদনে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) তথ্যমতে, সারা দেশের মাটিতেই প্রয়োজনের তুলনায় নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সালফার, দস্তা ও বোরনের ঘাটতি রয়েছে এবং অঞ্চলভেদে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ও ম্যাঙ্গানিজের ঘাটতি রয়েছে।

পরিবেশের এ বিপর্যয় জীববৈচিত্র্য এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্তরায়। মানুষের অকালমৃত্যু একদিকে মানবসম্পদ কমিয়ে আনবে, অন্যদিকে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বাড়াবে। পরিবেশ দূষণ হ্রাসে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদন মতে, বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে যথাসময়ে পদক্ষেপ নিলে বছরে ১ লাখ ৩৩ হাজারের বেশি মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব।

দূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরকে সক্রিয় হতে হবে। এক প্রতিবেদন মতে, ২০২১-২২ সালে প্রায় দুই হাজার ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হলেও মাত্র ৪৮ শতাংশ জরিমানা আদায় করা হয়। সংশ্লিষ্টদের মতে, পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকবল বাড়ানো উচিত। তবে পরিবেশ দূষণ মোকাবেলা করতে সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। নীতি প্রণয়নকারী ও বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে এ কাজের সমন্বয় থাকতে হবে। দূষণে দায়ী খাতগুলোকে কঠোর নজরদারির আওতায় আনতে হবে। বায়ুদূষণ রোধে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো উচিত। আবর্জনা পোড়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে এবং প্লাস্টিকের বিকল্প প্রয়োজন। সর্বোপরি দূষণ রোধে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় মনোযোগী হওয়া আবশ্যক। জনসাধারণকেও এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে।

পরিবেশ ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন পারস্পরিক জড়িত। পরিবেশের ক্ষতি করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যদিও-বা হয়, দীর্ঘমেয়াদে তা টিকবে না। শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির গতিপথ টেকসই রাখতে এবং মানুষের জীবনমানের উন্নতি করতে পরিবেশের দূষণ রোধ নিশ্চিত করতে হবে। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন