ভর্তুকির বন্ডে সুদ ব্যয় সমন্বয়

বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি মানুষের ভোগান্তি বাড়াবে

নাগরিক সুবিধার জন্য সরকারকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতে জোর দিতে হয়। এ কারণে প্রয়োজনীয় ভর্তুকিও সরকার বহন করে। কিন্তু সম্প্রতি নগদ অর্থের সংকটে ভর্তুকির অর্থ পরিশোধে সরকার ব্যর্থ হচ্ছে। এতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বিপুল অংকের বিল বকেয়া পড়েছে।

বণিক বার্তায় প্রকাশ, বিদ্যুতে ভর্তুকির অর্থের বিপরীতে বিশেষ ট্রেজারি বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে দায় পরিশোধ কিছু সময়ের জন্য বিলম্বিত করা হয়েছে। এ বন্ডের সুদ ও পুঞ্জীভূত ভর্তুকির অর্থ পরিশোধে আরেক দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কথা ভাবছে সরকার। চলতি শীত মৌসুমেই আরেক দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। 

বর্তমান সময়ে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট হচ্ছে। সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে। বিদ্যুৎ যেহেতু আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সে হিসেবে নিকট অতীতে দেখা গেছে, বিদ্যুতের সামান্য মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনকে বিষিয়ে তোলে। কারণ বিদ্যুতের দাম বাড়লে সব ধরনের পণ্যের দামই বেড়ে যায়। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বিদ্যুৎ সরাসরি ভূমিকা রাখে। যে কারণে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে তার প্রভাব সর্বত্র পড়ে। সবচেয়ে বড় কথা, সিস্টেম লসসহ যেসব ক্ষেত্রে দুর্নীতি হচ্ছে তা বন্ধ না করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়টি অপ্রত্যাশিত। তাছাড়া যেহেতু জনস্বার্থ জড়িত রয়েছে, সে হিসেবে বিদ্যুতের ভর্তুকির অর্থ কেন স্বাভাবিকভাবে দেয়া যাচ্ছে না, সেটিও বিবেচ্য বিষয়। বিদ্যুৎ বিভাগের দাবি, এ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ছে। এ ভর্তুকির চাপে সরকারের অর্থ সংকটও বাড়ছে। একদিকে ভর্তুকির অর্থ পরিশোধ হচ্ছে না, অন্যদিকে বিল বকেয়া থাকায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও বিদ্যুৎ খাতে ঋণ দেয়া ব্যাংকগুলো বিপাকে পড়েছে। এ অবস্থায় ভর্তুকির বিপরীতে বন্ড ইস্যু করে আপাতত সরকারের দায়ের বিষয়টি কিছু সময়ের জন্য বিলম্বিত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে বন্ডের সুদ বাবদ সরকারকে অর্থ পরিশোধ করতে হবে। পাশাপাশি পুঞ্জীভূত ভর্তুকির অর্থও পরিশোধ করা হবে। সব মিলিয়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো ব্যতীত কোনো উপায় দেখছে না সরকার। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে এর প্রভাব সব খাতেই পড়বে। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্যের ওপর এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। এরই মধ্যে মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষ জর্জরিত। এ অবস্থায় নতুন করে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি মূল্যস্ফীতিকে আরো উসকে দেবে। বিষয়টি সরকারের চিন্তায়ও আছে। এক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসার পর বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। তবে এক্ষেত্রে একবারে দাম না বাড়িয়ে ধাপে ধাপে বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।

উল্লেখ্য, গত ১৪ বছরে দেশে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে নয়বার। এ সময় বিদ্যুতের দাম পাইকারি পর্যায়ে ১১৮ শতাংশ বেড়েছে। আর গ্রাহক পর্যায়ে বেড়েছে ৯০ শতাংশ। সর্বশেষ গত বছরের ১২ জানুয়ারি সরকারের এক নির্বাহী আদেশে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা দেয়া হয়। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম নির্ধারণে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু করা হবে। এদিকে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণের চাপও রয়েছে সরকারের ওপর। আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশ সরকার সংস্থাটির কাছে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যয় ও ভর্তুকি যৌক্তিকীকরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। 

গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের জন্য ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ ছাড়ের সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছে আইএমএফের পর্ষদ। সে সময় সংস্থাটির প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুতের দাম সমন্বয় ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুক্তি নবায়নের সময় ক্যাপাসিটি চার্জ অন্তর্ভুক্ত না করার বিষয়ে আইএমএফের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও একটি বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে সারে ভর্তুকির বিপরীতে সরকারের বন্ড ইস্যু কার্যক্রমের সূচনা হয়েছে। সামনে সার ও বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকির বিপরীতে আরো বন্ড ইস্যু করা হবে। বন্ড ইস্যুর ফলে সরকারের ঋণ ও দায় আরো বাড়বে। তবে এ মুহূর্তে অর্থ সংকটের ফলে সরকারের কাছে আর কোনো বিকল্প নেই। 

জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যমতে, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে এর সম্ভাব্য কী ধরনের প্রতিঘাত আসতে পারে সেটি নিয়ে চিন্তাভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। অতি উচ্চমূল্যের কারণে বাজারে একটি বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আবার বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের ডলারের সংকট দূর করা সম্ভব হবে না। কারণ ডলারের অভাবে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো প্রয়োজন অনুসারে ফার্নেস অয়েল আমদানি করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এ সংকট দূর করার ক্ষেত্রে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। তাছাড়া ধরে নেয়া হচ্ছে, বিদ্যুতের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে গেলে মানুষ হয়তো এর ব্যবহার কমিয়ে ব্যয় সাশ্রয় করবে। এতে বিদ্যুতের চাহিদা কমবে এবং অব্যবহৃত সক্ষমতার পরিমাণ আরো বাড়বে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে যারা ব্যবহার কমাবে না, তাদের মধ্যে বিদ্যুৎ চুরির প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এজন্য বরং বিদ্যুতের দাম কমানোর প্রতি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। পরিচালন দক্ষতা বাড়ানোর মাধ্যমে উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে। তাছাড়া কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতের মাধ্যমেও ব্যয় কমানো সম্ভব। এ রকম ব্যয় সাশ্রয়ী বিকল্প পন্থা অবলম্বন করা যেতে পারে। মোদ্দাকথা, মূল্যস্ফীতি সহনীয় অবস্থানে আসার আগে বিদ্যুতের দাম বাড়ালে তাতে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই সাধারণ মানুষের কথা ভেবেই সরকারকে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এক্ষেত্রে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সময়োপযোগী ভূমিকাই কাম্য। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন