ইসামু নোগুচির ভাস্কর্য বাগানে একদিন

আলম খোরশেদ

নিউইয়র্কের প্রায় যাবতীয় বিখ্যাত মিউজিয়ামের অবস্থানই ম্যানহাটানজুড়ে। এর ঠিক বুকের মাঝখানে গজিয়ে ওঠা বিশাল নিসর্গ উদ্যান সেন্ট্রাল পার্কের পূর্ব দিক ঘেঁষে যাওয়া ফিফথ এভিনিউর মাইল খানেক জুড়ে রাস্তার দুই পাশে কেবল মিউজিয়াম আর মিউজিয়াম। তাই ওই জায়গাটার নামই হয়ে গেছে ‘মিউজিয়াম মাইল’। কিন্তু সেসবের বাইরে ইমিগ্র্যান্ট অধ্যুষিত এলাকা, বিশেষত বাঙালি বসতি বলে খ্যাত এস্টোরিয়ার এক জনবিরল অঞ্চলে রয়েছে এক আশ্চর্য জাদুঘর। এর প্রতিষ্ঠাতা বিখ্যাত জাপানি ভাস্কর ও স্থপতি ইসামু নোগুচির (১৯০৪-৮৮) নামে যার নাম রাখা হয়েছে ইসামু নোগুচি স্কাল্পচার গার্ডেন অ্যান্ড মিউজিয়াম। এখানে উল্লেখ্য, ইসামু নোগুচি ছিলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর ভাগ্নি, বিখ্যাত লেখক নয়নতারা পণ্ডিতের দীর্ঘদিনের বন্ধু ও প্রেমিক। সে যাক, নোগুচির কর্মজীবনের সিংহভাগ কেটেছে যুক্তরাষ্ট্রে, বিশেষ করে নিউইয়র্কে। প্রথমে তিনি আর সব শিল্পীর মতোই ডেরা বেঁধেছিলেন শিল্পনগর ম্যানহাটানে। কিন্তু স্বভাবে প্রকৃতিপ্রিয় ও নিভৃতচারী মানুষ নোগুচি অল্পদিনেই হাঁপিয়ে উঠলেন সেই কংক্রিটের অরণ্যে। 

তাই একদিন পাততাড়ি গুটিয়ে নদী পেরিয়ে চলে এলেন এস্টোরিয়ায়। ইস্ট রিভারের তীরে কিনে নিলেন গাছপালাঘেরা বিশাল এক বাড়ি। সেই বাড়িটিকে ঘিরেই তিল তিল করে গড়ে তুললেন এক আশ্চর্য শিল্পের ভুবন, কালক্রমে যার নাম দাঁড়িয়েছে ‘ইসামু নোগুচির ভাস্কর্য বাগান’, যা এখন যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পরসিকদের প্রধান একটি তীর্থক্ষেত্র। জায়গাটি তিনি কিনেছিলেন ১৯৭৫ সালে এবং তারপর ধীরে ধীরে সেটিকে গড়ে তোলেন তার নিজস্ব শিল্পকর্মগুলোর একটি স্থায়ী সংগ্রহশালারূপে। আর তার চারপাশে সযত্নে নির্মাণ করেন জাপানি ঐতিহ্যের একটি জল-পাথরের উদ্যান, যার মাঝখানে তিনি ছড়িয়ে দিলেন তার যাবতীয় ছোট-বড় ভাস্কর্যগুলো। তার মৃত্যুর বছর তিনেক আগে ১৯৮৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হওয়া জাদুঘরটি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে কোনো জীবিত শিল্পীর নামে প্রথম একটি সংগ্রহ স্থাপনা। তো সেই ঐতিহাসিক ভাস্কর্য বাগানে কাটানো আমার এক আনন্দময় বিকালেরই সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন এ লেখাখানি।

বোস্টন আইভিলতায় ছেয়ে যাওয়া উঁচু দেয়ালঘেরা বাড়িটাকে বাইরে থেকে দেখেই মন ভরে যায় আর ভেতরে ঢুকে তার অন্য রকম বাসিন্দাদের সান্নিধ্যে এসে রীতিমতো অভিভূত হতে হলো। প্রথম তলায় প্রায় মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় দুর্গ পাতালের মতো শীতল, প্রাচীন পরিবেশে ছড়ানো-ছিটানো বিশালাকার সব পাথরের শিল্পকর্ম। নোগুচি পাথরকে নিয়ে নানাভাবে খেলেছেন; তাকে ভেঙেছেন, বাঁকিয়েছেন, জুড়েছেন, রাঙিয়েছেন এবং এভাবে তার গায়ে তুলে দিয়েছেন নতুন এক ভাষা। সে ভাষায় বলা আদিম পাথুরে কবিতা ও সংগীতভুবনের পালা সাঙ্গ করে একপর্যায়ে পা রাখি তার স্বপ্নের বাগানে। ঐতিহ্যবাহী জাপানি উদ্যানের মতো সুচারু, পরিপাটি রূপে সাজানো নয়, প্রকৃতিকে তিনি স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠতে দিয়েছেন সেখানে। কেবল তার মাঝখানে যেন বা অযত্নেই বসিয়ে দিয়েছেন কিছু মর্মরমূর্তি। নানা ঢঙের, নানা রঙের, নানা ভঙ্গি ও বিন্যাসে। কোথাওবা সাদা দুটো পাথর প্রায় যুগলের মতো আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে বসে আছে। কোথাওবা কালো এক পাথরখণ্ডের গা বেয়ে নিঃশব্দে, নিরন্তর গড়িয়ে পড়ছে অমরাবতীর ধারাজল। 

সেই বাগানের বুক চিরে রাঙা মাটির একটি পথ চলে গেছে সংগ্রহশালার অন্য প্রান্ত অবধি। শ্বেত বার্চ, ক্রন্দসী চেরি, মোহন ম্যাগনোলিয়া, আর জুনিপার বৃক্ষ থেকে ঝরে পড়া পাতাদের দল সেই পথ ছেয়ে রেখেছে। পথপার্শ্বে পরিশ্রান্ত পথিকের জন্য নোগুচি নির্মাণ করে রেখেছেন কিছু বিশ্রাম আসন। সেখানে ক্ষণকাল তিষ্ঠে অতঃপর আমরা পথের শেষে অপেক্ষমাণ বাড়িটির অপর বাহুতে পৌঁছাই। সেইখানে কাঠের সিঁড়ি আমাদের নিয়ে যায় দোতলায়, নোগুচি যেখানে তার সতীর্থ স্থপতি শোজি সাদাতকে নিয়ে নির্মাণ করেছেন প্রকৃতির অপার আলো-হাওয়ায় ভেসে যাওয়া এক গভীর গ্যালারি। সেখানে তার ছোট ছোট কাজ; পাথর, কাঠ, কিংবা প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি করা, গভীর প্রশান্তিতে নিজেদের মেলে রেখেছিল যেন। একদা বিশ্ববিখ্যাত ভাস্কর কালডর, ব্রাঙ্কুচির শিষ্য নোগুচির এই প্রথমদিককার ভাস্কর্যগুলোয় বিমূর্ত ও পরাবাস্তব ধারার প্রভাব লক্ষ করা যায় স্পষ্ট। প্রতিটি কাজই বড় যত্নে করা আর ভীষণ মমতায় সাজানো। গ্রানাইটের প্রতি নোগুচির আকর্ষণ যেন দুর্মর। কালো গ্রানাইটের বুক কুঁদে কত যে বিচিত্র রূপ আর রহস্য তিনি আবিষ্কার করেছেন তার ইয়ত্তা নেই।

অক্লান্ত কর্মী নোগুচি অবশ্য কেবল ছকবাঁধা ভাস্কর্য করেই তৃপ্ত ছিলেন না। পাশাপাশি একদিকে যেমন করেছেন নাটক ও নৃত্যের মঞ্চসজ্জা, অন্যদিকে উদ্যান ও পার্ক পরিকল্পনা এবং আসবাব নির্মাণের কাজও। আমেরিকার আধুনিক নৃত্যের পুরোধা ব্যক্তিত্ব মার্থা গ্রাহাম, জন কেজ, মার্স কানিংহাম প্রমুখের অনেক প্রধান নৃত্য ও নাট্য প্রযোজনারই মঞ্চপরিকল্পক ছিলেন নোগুচি; ছিলেন নিউইয়র্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের অপরাপর রাজ্যের বেশকিছু আধুনিক উদ্যানের নকশাকার। সেসব কাজের, বিশেষ করে তার নকশাকৃত জনপ্রিয় আসবাবগুলোর কিছু নমুনা ও ঐতিহ্যবাহী জাপানি কাগজবাতি আকারি ঘরানায় তৈরি তার নানা রকম ঝুলবাতি ছিল জাদুঘরের অপর প্রধান আকর্ষণ। আর ছিল বিখ্যাত ট্রি অব হ্যাভেন নামের ৬০ বছর বয়সী সেই প্রাচীন বৃক্ষটি, যাকে ঘিরেই মূলত নোগুচি গড়ে তুলেছিলেন তার এই শিল্পের আশ্রমখানি। সব মিলিয়ে নোগুচির ঘটনাবহুল দীর্ঘ কর্মজীবনের তিনশরও অধিক শিল্পকর্মের এক অবিশ্বাস্য সুন্দর ও শিল্পিত সমাবেশ সংগ্রহশালাটি। তার সঙ্গে জড়াজড়ি করে মিশে রয়েছে অদ্ভুত মায়াময় এক নাগরিক নির্জন নিসর্গ। একজন মেধাবী ও ধ্যানমগ্ন শিল্পীর স্বনির্মিত শিল্পের উদ্যানে প্রায় তিন দশক আগেকার সেই আশ্চর্য ভ্রমণের স্মৃতিটুকু এখনো অম্লান আমার চেতনায় ও অনুভবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন