শিল্পীর তুলি যেখানে সংগ্রামের হাতিয়ার

নিজাম আশ শামস

সুলাইমান মনসুরের আঁকা চিত্রকর্মে বিভিন্ন প্রতীকের ব্যবহার ছবি: সুলাইমান মনসুরের ফেসবুক

পাবলো পিকাসো লিখেছিলেন, ‘চিত্রকর্ম ঘর সাজানোর জন্য আঁকা হয় না। এটি শত্রুকে আক্রমণ করা ও শত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধ করার একটি হাতিয়ার।’ ফিলিস্তিনের চিত্রকর্মগুলো যেন পিকাসোর এ কথার আক্ষরিক উপস্থাপনা। ফিলিস্তিনি চিত্রশিল্পীরা রঙতুলি দিয়ে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছেন অন্তরে প্রতিনিয়ত গুমরে মরা প্রতিবাদ ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। ইসরায়েলি বাহিনীর প্রতি পুঞ্জীভূত ক্ষোভ তারা প্রকাশ করেছেন চিত্রভাষায়। তাই এক যুগ আগে (২৭ জুন, ২০১১) চমৎকার একটি শিরোনাম করেছিল ‘দি ইকোনমিস্ট’ পত্রিকা—‘এম সিক্সটিনের চেয়ে বেশি শক্তিশালী শিল্পীর তুলি।’

ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি হামলা চলমান। এর সূচনা হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। ফিলিস্তিনিদের উৎখাত করা হয়েছিল তাদের ভূখণ্ড থেকে। চালানো হয়েছিল ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ। ইতিহাসে তা ‘নাকবা’ নামে পরিচিত। আরবি শব্দটির অর্থ বিপর্যয়। এ বিপর্যয় মোকাবেলা করতে ফিলিস্তিনে তৈরি হয়েছে স্বাধীনতাকামী সংগঠন। ইসরায়েলি আক্রমণের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী মানুষের এ অসম লড়াই দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে সেখানকার চিত্রশিল্পীদের। নাকবা ও নাকবা পরবর্তী শিল্পীদের চিত্রকর্মে তাই ঘুরেফিরে এসেছে শত্রুর আক্রমণ, ধ্বংসযজ্ঞ, ফিলিস্তিনিদের প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও স্বাধীনতার প্রত্যাশা। এ চিত্রকর্মগুলোকে তাই ‘লিবারেশন আর্ট’ বলে আখ্যায়িত করেছেন ফিলিস্তিনের চিত্রশিল্পী সামিয়া হালাবি। লিবারেশন আর্ট ধারার চিত্র এঁকে খ্যাতি অর্জন করা শিল্পীদের অন্যতম আবদুর রহমান আল মুজায়েন। ১৯৪৩ সালে ফিলিস্তিনের কুবাইবা নামের এক গ্রামে তার জন্ম। নাকবার সময় গ্রামটি পরিত্যক্ত হয়েছিল। পরিবারের সঙ্গে গাজা উপত্যকার খান ইউনিস রিফিউজি ক্যাম্পে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন শিশু আল মুজায়েন। শৈশবের সে বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার আলোকে ১৯৬৬ সালে তিনি এঁকেছেন ‘দ্য ম্যাসাকার অব ডেয়ার ইয়াসিন’ শিরোনামের একটি চিত্র। ১৯৪৮ সালের ৯ এপ্রিল অতর্কিত আক্রমণে জেরুজালেমের নিকটবর্তী ডেয়ার ইয়াসিন গ্রামের ১০৭ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছিল ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। নিহতদের মধ্যে অনেক নারী ও শিশুও ছিল। ১৯৬৭ সালে আল মুজায়েন ‘প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)’-তে যোগ দেন। তিনি পিএলওর সাংস্কৃতিক শাখায় কাজ করতেন। ফিলিস্তিনের সাংস্কৃতিক ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে বক্তৃতা দিয়ে তিনি ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করতেন। ১৯৬৮ সালের ২১ মার্চ জর্ডানের আল কারামা শহরে পিএলও ও জর্ডান সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনী ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করে। ইতিহাসে এটি ‘আল কারামার যুদ্ধ’ হিসেবে পরিচিত। এ যুদ্ধকে ক্যানভাসে চিত্রিত করেছেন আল মুজায়েন। ১৯৬৮ সালে আঁকা চিত্রকর্মটির নাম ‘আল কারামা’। এ চিত্রে ফিলিস্তিনিদের সুদৃঢ় ও অবিচল মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। আরবি প্রতিশব্দে যাকে বলা হয় ‘সুমুদ’। আল কারামার যুদ্ধ নিয়ে ১৯৬৯ সালে একই শিরোনামে ছবি এঁকেছেন আরেক ফিলিস্তিনি চিত্রশিল্পী মুস্তাফা আল হাল্লাজ। আল মুজায়েনের মতো তিনিও নাকবার কারণে নিজের জন্মভূমি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। ১৯৩৮ সালে জন্ম নেয়া এ শিল্পী মাত্র নয় বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে হেঁটে ফিলিস্তিনের সালামা গ্রাম থেকে মিসরে চলে যান। তার বিখ্যাত চিত্রকর্মগুলোর প্রায় সবক’টিতেই স্বাধীনতার জন্য ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। তিনি বিশ্বাস করতেন, চিত্রকর্মের মাধ্যমে ইসরায়েলি নিপীড়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ফিলিস্তিনি চিত্রশিল্পীদের কর্তব্য। তবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের প্রতিবাদ তীব্রভাবে ফুটে উঠেছে আল মুজায়েনের আঁকা ‘ইন্তিফাদা: অ্যাগেইনস্ট ফ্যাসিজম’ চিত্রে।

আবদুর রহমান আল মুজায়েন ও তার সমসাময়িক ফিলিস্তিনি চিত্রশিল্পীদের চিত্রে বারবার কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে এসেছে ফিলিস্তিনি নারীদের মুখ। তাদের চিত্রকর্মে নারী মাতৃভূমির প্রতীক। এর মাধ্যমে ফিলিস্তিনের চিত্রশিল্পীরা এ প্রত্যয় জানাতে চেয়েছেন যে ফিলিস্তিনিরাই সেখানকার আদি বাসিন্দা। তাদের ভূখণ্ডে ইসরায়েলের জাতীয়তাবাদী দাবির বিরুদ্ধে এসব চিত্রকর্ম যেন শৈল্পিক প্রতিবাদ। চিত্রকর্মে মাতৃভূমির প্রতীক রূপে নারী চরিত্র উপস্থাপনে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন চিত্রশিল্পী সুলাইমান মনসুর। তার আঁকা একটি চিত্রের নাম ‘গাজা’। তেলরঙে আঁকা চিত্রটিতে কফিনের ওপর মাথা রেখে ফিলিস্তিনি এক নারীকে শুয়ে থাকতে দেখা যায়। এখানে কফিন যেন দুর্দশাগ্রস্ত ফিলিস্তিনিদের প্রতীক। সন্তানকে আঁকড়ে ধরে তাই ডুকরে কাঁদছে দেশমাতৃকা। ২০১৬ সালে ‘মাই নেম ইজ প্যালেস্টাইন অ্যান্ড আই উইল সারভাইভ’ শিরোনামের একটি চিত্র আঁকেন সুলাইমান মনসুর। চিত্রে এক নারী ফিলিস্তিনের পতাকা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। চিত্রকর্মটিতে ফিলিস্তিনের প্রতিটি মানুষের মনে প্রতিনিয়ত ধ্বনিত হওয়া স্বাধীনতার অনন্ত আশাবাদ তীব্রভাবে ফুটে উঠেছে। ২০২১ সালে সুলাইমান মনসুর আঁকেন ‘ফ্রম দ্য রিভার টু দ্য সি’। তেলরঙে আঁকা চিত্রকর্মটিতে দেখা যায় গাজা উপত্যকায় এক নারী নতজানু হয়ে একটি গাছকে জড়িয়ে ধরে আছে। গাছটির এক পাশের পাতা ও ডাল বিবর্ণ। অন্য পাশ সবুজ ও সতেজ। তাতে ধরে আছে সুদৃশ্য ফল। নারীর মাথা হেলে আছে সে দিকটিতেই। অর্থাৎ, নারীটিকে যদি মাতৃভূমি ধরা হয়, তবে তার যাত্রা সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে।

ফিলিস্তিনি চিত্রশিল্পীদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রভাব রাখা ঘটনা হলো ১৯৪৮ সালের নাকবা। ১৯৪৮ সালের আগের অধিকাংশ ফিলিস্তিনি চিত্রশিল্পী ছিলেন স্বশিক্ষিত। তারা সাধারণত প্রকৃতি ও ধর্মীয় বিষয়কে আধেয় করে চিত্রকর্ম তৈরি করতেন। তাদের কাজে ইউরোপীয় শিল্পীদের ছাপ ছিল স্পষ্ট। সে সময়ের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী হলেন খলিল হালাবি, নাহিল বিশারা, জামাল বাদরান প্রমুখ। নাকবা পরবর্তী সময়ে ফিলিস্তিনি চিত্রশিল্পীদের চিত্রকর্মে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত এবং তাকে কেন্দ্র করে ভূরাজনীতিই মুখ্য হয়ে ওঠে। ইসমাইল শামাউত, নাজি আল আলি, আবদুল হাই মুসাল্লামের চিত্রকর্মের বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে নাকবার মর্মন্তুদ স্মৃতি। ধ্বংসযজ্ঞ, শরণার্থী সমস্যাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয়ের ওপর তারা আঁকতে শুরু করেন। নিজেদের ভূখণ্ড থেকে উৎখাত হওয়া ফিলিস্তিনি জনগণের পরিচয় সংকট প্রকট হয়ে ধরা দেয় তাদের ক্যানভাসে। ফিলিস্তিনি চিত্রশিল্পী ও চিত্রশিল্পবিশারদ কামাল বোলাতার পর্যবেক্ষণ অনুসারে, নাকবা পরবর্তী সময়ে ফিলিস্তিনি চিত্রশিল্পীদের চিত্রকর্মে স্থানের ধারণা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। মাতৃভূমির সঙ্গে দূরত্বজনিত হাহাকার তাদের রঙতুলির আঁচড়ে প্রাণ পেতে থাকে। ১৯৪৮ সালের আগ পর্যন্ত ইসরায়েলে বাস করা ফিলিস্তিনি চিত্রশিল্পীদের চিত্রকর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল ইসরায়েল। অধিকাংশ চিত্রকর্মই ছিল ফিগারেটিভ। কিন্তু নাকবার সময় ফিলিস্তিনি চিত্রশিল্পীরা ইসরায়েল থেকে উৎখাত হন। তারা শরণার্থী হিসেবে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেন। সে কারণে তাদের মনের গহিনে প্রতিনিয়ত চলতে থাকা যন্ত্রণা ও টানাপড়েন যথাযথভাবে প্রকাশ করতে তারা অ্যাবস্ট্রাক্ট চিত্র আঁকতে শুরু করেন। ফিলিস্তিনি চিত্রশিল্পে এটি এক উল্লেখযোগ্য বিবর্তন, যার গতিপথ নির্ধারণ করে দিয়েছিল নাকবা।

ফিলিস্তিনি চিত্রশিল্পে বেশকিছু প্রতীক গুরুত্বপূর্ণ। ঘোড়া সেখানে বিপ্লবের প্রতীক। চলমান প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের সুরকে প্রতীকায়িত করতে এসেছে বাঁশি। চাবি দিয়ে বোঝানো হয়েছে হারানো ভূখণ্ডে ফিরে যাওয়ার অধিকার। স্বাধীনতার প্রতীক সূর্য। বন্দুকের ওপর বসা পায়রা দিয়ে বোঝানো হয়েছে, স্বাধীনতা সংগ্রামের পরেই আসে শান্তি। আর ফিলিস্তিনিদের দৃঢ় মনোবলের প্রতীক হিসেবে চিত্রশিল্পীদের ক্যানভাসে ফুটে উঠেছে ক্যাকটাস।

ফিলিস্তিনের চিত্রশিল্পকে নিছক শিল্প হিসেবে উপভোগ করা যেতেই পারে। কিন্তু ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত ও তাকে কেন্দ্র করে ভূরাজনীতির স্পষ্ট পাঠ ব্যতিরেকে এর সঠিক মর্মার্থ অনুধাবন করা সম্ভব নয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন