ভাটির মানুষের জলরঙের নদী

ওয়াহিদ সুজন

শ্যামবাজার ছবি: গ্যালারি কায়া

হামিদুজ্জামান খান। ভাটি অঞ্চলে তার জন্ম। কিশোরগঞ্জ থেকে ১৯৬০-এর দশকের শুরুতে ঢাকায় আসেন। তারপর এ ঢাকায় থিতু হয়ে ঘুরেছেন দেশ-বিদেশ। তার তারুণ্যে দেখা রাজধানীর বুক চিরে বয়ে যেত নদী। এখানকার ব্যস্ত এলাকায় দেখেছেন বাহারি বড় নৌকা। নৌকা; হামিদুজ্জামানের মতে ‘চলমান ভাস্কর্য’। হামিদুজ্জামান অবশ্যই স্মৃতিকাতর হন। তবে স্মৃতিকে সংগোপন রেখে বর্তমানকে হাজির করেছেন তার সাম্প্রতিক প্রদর্শনী ‘রিভারাইন’-এ। তার রঙতুলি এ বর্তমানকে নিতে চায় সুন্দর ভবিষ্যতে। যেখানে নদী সেরে উঠবে, মানুষ ও নগর সেরে উঠবে।

নদী। জীবন্ত, প্রবহমান, সদা তরুণ ও সৃজনশীল সত্তা। গ্রিক দার্শনিকের ভাষা, ‘এক নদীতে দ্বিতীয়বার অবগাহন করা যায় না।’ মানুষ তার আবির্ভাবের কাল থেকে নদীকে আশ্রয় করেছে। শতশত নদীর দেশ এ বাংলার যতটুকু সমৃদ্ধি তার সবই নদীর দান। নদীই তাকে করেছে অজেয়। সে নদীকে আমরা কোন হালে রেখেছি এ বাংলাদেশে। ৫০টি চিত্রকর্ম নিয়ে আয়োজিত ‘রিভারাইন’-এ প্রশ্নটি আছে। বারবার। আছে একজন শিল্পীর স্বপ্ন ও কল্পনা; যার একটি যৌথ রূপ নিশ্চয় আছে। কিন্তু আমরা শিল্পীর কাছে যাই, যে কারণে তিনি অনন্য, সে রূপ-রসের সন্ধান আছে। সেখানে আমাদের যৌথ নদী আপাত অর্থে আলাদা বাঁক নেয়। কিন্তু তার শিল্পকর্ম নতুন স্বপ্নও জাগায়।

উত্তরার গ্যালারি কায়ায় গতকাল পর্দা নামে ৫০টি চিত্রকর্মের এ প্রদর্শনীর। বেশির ভাগই জলরঙে করা, অল্পক’টি স্কেচও আছে। ভাস্কর্যের ত্রিমাত্রিক জগতে হামিদুজ্জামানের খ্যাতি অনেক। যতদূর জানা যায়, ক্যানভাসের দ্বিমাত্রিক তলে জলরঙের ত্রিমাত্রিক আবহ ফুটিয়ে তোলায় তার যে নৈপুণ্য, তা একদম শুরুতেই চিনেছেন ওস্তাদরা। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের এমন জবান মশহুর যে, ‘হামিদ, তোমার হাতে জলরঙে আঁকা ছবি ভালো হয়। জলরঙ কখনো ছেড়ে দেবে না। দেখবে এ জলরঙ তোমাকে একদিন বহুদূর নিয়ে যাবে।’

অন্যদিকে, সাম্প্রতিক প্রদর্শনীকে শিল্প সমালোচক মইনুদ্দীন খালেদ ‘হামিদুজ্জামানের ভাস্কর্যপ্রতিম জলরং’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ-বিষয়ক লেখায় তিনি বলছেন, ‘‌সাম্প্রতিক সময়ে আঁকা হামিদের জলরং ছবি নিয়ে ‘‌‘‌গ্যালারি কায়া’’ যে প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে, তাতে শিল্পীর উপলব্ধির রূপান্তর দর্শক করতে পারবেন। বাতাসে কম্পমান হালকা-পলকা বর্ণপর্দার চিত্রায়ণে এবার শিল্পী প্রকৃতির রহস্য অবমুক্ত করেননি। বর্ণ প্রয়োগে তিনি জলরঙের নতুন বর্ণমালা রচনায় সৃজনশীলতা পরখ করে দেখেছেন। যদিও জলের চাঞ্চল্য এবার তাকে অধীর করেনি, তবু এ বস্তু পৃথিবীর চেনা রূপলোক থেকে মুক্তি অন্বেষণ করেছেন বর্ণচ্ছটার পৌনঃপুনিক প্রয়োগে। রঙের তারল্যের স্বভাব গ্রাহ্য না করে গুরুত্ব দিয়েছেন বর্ণের ঘনতর ক্বাথে। বর্ণের পুরুত্বে বিষয়ের ভিন্নতর গুরুত্ব অনুধাবন করেছেন হামিদ। যদিও বর্ণের ফোঁটার বিরামহীন প্রয়োগ যুক্ত হয়েছে তার কাজে, ধ্বনিময়তা-অভিজ্ঞতাকে উত্তীর্ণ করতে চেয়েছেন সংগীতের সমধর্মে, তবু জমাট বর্ণপ্রস্থ অধিকার করে রেখেছে শিল্পীর চিত্রের জমিন। জলরঙে রহস্যময় প্রকৃতির যে অধরা মাধুরীর ব্যঞ্জনা ইশারাময় থাকে সে পথে এবার হামিদ তুলি সঞ্চালন করেননি। কয়েকটি ছবি অবশ্য ব্যতিক্রম; সেখানে এখানো সচল বর্ণময়তা ও বর্ণশূন্যতার দোলাচলে অনন্তকে পরিমেয় করে তোলার আকাঙ্ক্ষা।’

হামিদুজ্জামান খানের নদী মানুষের নিশানাময়। মানুষ তার জীবনদায়ী ও সভ্যতার আঁতুড়ঘরের কী হাল করেছে তা তুলে ধরেছেন। জলের রঙ পাল্টেছে। এমন নয় যে প্রাকৃতিক কোনো ঘটনা তুলে ধরেছেন। মানুষ ও নদীর বৈরী যূথতা এর উপলক্ষ। যেখানে নদীর ভূমিকা নিছকই ভুক্তভোগীর। হামিদুজ্জামান বলছিলেন, বুড়িগঙ্গা, তুরাগে নৌকা ভ্রমণের কথা। কী দুর্বিষহ কালো জলের ভেতর এগোচ্ছিলেন। আবার বর্ষার কথায় প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠলেন। কী স্বচ্ছ জল, সব ধুয়ে-মুছে দিচ্ছিল। উনি বলছিলেন, নদীর পানি সবসময় প্রবহমান, তুমি তাকে কখনো স্থির দেখবে না।

হামিদুজ্জামান খান ঢাকা শহরের প্রান্ত ছুঁয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী ও তুরাগের নানা সময়ের মুহূর্ত ধারণ করেছেন। স্কেচ ও জলরঙে মূর্ত হয়েছে নদী পারের জীবন, গোধূলি, জ্যোৎস্না, নিকষ কালো রাত, বৃষ্টি, নৌকা-মাঝি-যাত্রী, নারায়ণগঞ্জ বন্দর, নদীর পাড় ঘেঁষা আকাশ, বসতবাড়ি, ডকইয়ার্ড, নদী পারাপার ও ইটভাটা। এসেছে আহসান মঞ্জিল, ফরাশগঞ্জ, শ্যামপুর, বছিলা, বাবুবাজার ব্রিজ ইত্যাদি। এ ছবিগুলো নদীর তীরে ঢাকার গড়ে ওঠা নির্দেশ করে। সরব স্মৃতি বলতে এটুকুই। বিশেষ করে আহসান মঞ্জিলের তিন-চারটি ছবি রয়েছে চিত্রকর্মে। নানা আঙ্গিক থেকে ঢাকার ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত এ ভবনকে দেখানো হয়েছে। একটি ছবিতে বিস্তৃত খোলা প্রান্তর রেখে সেখানে চারদিকে স্থাপন করেছেন সবুজ।

প্রতিটি চিত্রকর্মের সুনির্দিষ্ট শিরোনাম রয়েছে। কিছু চিহ্ন দিয়ে নদীও হয়তো ধরা যায়। ‘হুবহু’ কিছু তুলে ধরেননি। হামিদুজ্জামান ইম্প্রেশনিস্ট ধারার আশ্রয় নিয়েছেন। রঙ প্রলেপের ওপর প্রলেপ বুলিয়ে একেকটি আকার দিয়েছেন। তিনি কিছু সুনির্দিষ্ট করতে চাননি, আবার কোনো কিছুই অস্তিত্বগতভাবে অনিশ্চিত নয়। বরং নদীর গতিশীলতার মতো এগিয়ে গেছে তার ব্রাশ। যেভাবে ঢেউয়ের ওপর ঢেউ আছড়ে পড়ে। কোথাও কোথাও ওপর থেকে সাদা রঙ ছেড়ে দিয়েছেন। যেন যতটা গড়িয়ে যেতে পারে। উনিও বলছিলেন, এটা ছবিকে বিশেষত্ব দিয়েছে। আমার মনে হলো, দেখার যে জগৎ সেখানে শুধু বস্তু কী আছে, কেমন আছে তা নয়, আমাদের অভ্যস্ততার ভেতরও অনেক কিছু একটা আকার লাভ করে। অভ্যস্ততার বাইরে যা হারিয়ে যায় তা কি আমরা কখনো পাই? হামিদুজ্জামানের সাদা সে রঙ শুধু নদীর নিজস্বতা নয়, বরং আমাদের আড়ালে পড়ে যাওয়া নানা মুহূর্ত। যার কারণে একটা নদী হয়ে ওঠে বা এখনো সে নদী হয়ে আছে। এবং থাকবে। একই সঙ্গে ভাস্কর্যের ত্রিমাত্রিক স্বভাবকে ধারণের চেষ্টা করেছেন তিনি। ব্রাশের ওভারল্যাপিং, রেখার ভিন্ন দিক থেকে মিলেমিশে যাওয়ায় একটি নতুন অস্তিত্ব জানান দেয়।

হামিদুজ্জামানের কাজে অপূর্বভাবে উঠে এসেছে রাতের নদী। জ্যোৎস্না ফেটে পড়ছে চারদিকে। আর মানুষ সওয়ার হয়েছে নৌকায়। নদীর ওপর মেঘের উপস্থিতিতে আলো-আঁধারের যে অপূর্ব মেলবন্ধন, যে স্বর্গীয় আলোকচ্ছটা, মুহূর্তের জন্য হলেও থমকে দেবে। হামিদুজ্জামানের একাধিক ছবিতে রাতের নিসর্গ, ধ্যানী মুহূর্তের প্রভাব অনেক উজ্জ্বল। একই সঙ্গে নদীর দিকে ধেয়ে আসা ইট-কাঠের শহর নিয়ে খুবই সচেতন। সচেতন স্কাইলাইন ফুঁড়ে যাওয়া বিদ্যুতের সুউচ্চ খুঁটি নিয়েও।

‘রিভারাইন’ স্মৃতিকাতরতা ও গ্রামবাংলায় আটকে রাখার পুরনো সাংস্কৃতিক খাসলতের চেয়ে আলাদা, যা আমাদের এ সময়, নগর ও যাপনকে তুলে ধরেছে। এটাও হয়তো বুঝেছি, নদী প্রাচীন কোনো গল্প নয়; চিরবর্তমান। এ বর্তমানের ভেতরই সম্ভব প্রবহমানতার লালন। ভাটির মানুষের জলরঙে এতটুকু বোঝা গেল।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন