বিআইডিএসের সেমিনার

শতবছরের সহিষ্ণুতা হারিয়ে সমাজে বিভাজন বাড়ছে

নিজস্ব প্রতিবেদক

উপমহাদেশের শতবছরের ইতিহাসে ধর্মীয় বহুত্ববাদ ও পারস্পরিক সহাবস্থানের বিষয়টি স্পষ্টভাবেই পাওয়া যায়। কিন্তু ঐতিহ্যের এ ধারা এখন আর টিকছে না। সাম্প্রদায়িকতার পাশাপাশি যেকোনো ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণুতার বিষয়গুলো উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি রোধ ও ঐতিহ্যে ফিরতে ইতিহাস জানা ও চর্চা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত এক পাবলিক লেকচারে গতকাল এসব বিষয়ে বক্তব্য উঠে আসে। ‘আমরা কে? ধর্মীয় বহুত্ববাদ ও বাংলার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য’ শীর্ষক বই নিয়ে আলোচনা করেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক আবদুল মমিন চৌধুরী। এতে সভাপতিত্ব করেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন। 

মূল আলোচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবদুল মমিন চৌধুরী বলেন, ‘বাংলা পৃথিবীর দ্বিতীয় মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা। যদিও এখানে হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের শক্ত অবস্থান ছিল। তবু সুলতানদের উদার মানসিকতা ও সুফি-দরবেশদের মধ্যস্থতায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় ইসলাম। ইসলামের উদারতা ও সাম্য ভাবনা স্থানীয়দের আকৃষ্ট করেছিল। ফলে বৌদ্ধ ধর্মের আদিরূপ বেশি দিন টেকেনি এখানে। কিন্তু ইসলাম আসার আগেও এখানে হিন্দু ও বৌদ্ধদের সহাবস্থান ছিল। পরবর্তী সময়ে সুলতান আলাউদ্দীন হুসেন শাহর আমলে হিন্দুদেরও উচ্চপদে আসীন হতে দেখা যায়। অর্থাৎ এখানে এক ধরনের ধর্মীয় বহুত্ববাদের দৃষ্টান্ত ছিল। যদিও ঔপনিবেশিক আমলে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িকতা ছিল সাময়িক, যা সময়ে সময়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। আর এটা প্রতিরোধে দরকার অতীতের ঐতিহ্য নিয়ে সচেতনতা ও দৃঢ় আত্মোপলব্ধি।’ 

আলোচনায় পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘শুধু ধর্মীয় বিভাজন না, বর্তমান সমাজে ভিন্নমতের প্রতি চরম অসহিষ্ণুতা দেখতে পাচ্ছি, যা দিনে দিনে উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আর ঔপনিবেশিক আমলের বিভাজন ক্ষণস্থায়ী ছিল না, বরং তার প্রভাব এখন আরো সুদৃঢ় হচ্ছে।’ 

তিনি বলেন, ‘বহুত্ববাদ বাঙালি জাতির অন্যতম বড় বৈশিষ্ট্য। তবে এ বহুত্ববাদের পেছনে বাস্তববাদী চিন্তাও একটি কারণ হতে পারে। অর্থাৎ তারা পরিস্থিতির ওপর বিবেচনা করে বিভিন্ন সময়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে অবস্থান পরিবর্তন করত। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের জন্য আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে সঠিক ইতিহাসের চর্চা না হওয়া। বিশেষ করে পাঠ্যপুস্তকে তো ইতিহাসের চর্চা নেই বললেই চলে। এ বিষয়ে আমাদের সচেতনতা বাড়াতে হবে।’

আলোচনায় সভাপতির বক্তব্যে ড. বিনায়ক সেন বলেন, ‘সমাজে বিভিন্নতা থাকলেও আমাদের একটি সহাবস্থান ছিল। ঝগড়া যেন দাঙ্গায় না গড়ায় সেজন্য সে সময়ে রাষ্ট্র খুব সচেতন ছিল। সামাজিকতার ভিত্তিতে অনেক সমস্যার সমাধান করা হতো। বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক সমাধান আলোচনার মাধ্যমে না হয়ে যদি নির্দিষ্ট মাঠে গড়ায়, তখনই রক্তারক্তি হয়। ইতিহাস থেকে এটা আজও আমাদের জন্য শিক্ষা।’ 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. পারভীন হাসান বলেন, ‘আমরা আগে থেকে একসঙ্গে থাকলেও সবাই ভিন্ন ছিলাম। এখানে পার্থক্য ছিল এবং এটা থাকবে। এখন সবাই শুদ্ধতা খুঁজছেন। জ্ঞান বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিভাজন বাড়বে। তবে অন্যকে সহ্য করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে আমাদের।’ 

আলোচনায় অংশ নিয়ে বেশ কয়েকজন ভিন্নমত তুলে ধরেন। সমাজে সহযোগী মনোভাব থাকলে বর্তমানে কেন এর দুরবস্থা কিংবা ঐতিহ্য দুর্বল ছিল কিনা সেসব প্রশ্নও উঠে আসে আলোচনায়। সে সময় আসলেই সহাবস্থান ছিল কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন কয়েকজন। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক শহিদুল হাসান বলেন, ‘এখানে আদি ও মধ্যযুগের ইতিহাসচর্চায় বহুমাত্রিকতা অন্বেষণে সীমাবদ্ধতা ছিল। অনেকেই সে সীমাবদ্ধতা পাশ কাটিয়ে ভিন্ন উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেন।’

প্রশ্নোত্তর পর্বে আবদুল মমিন চৌধুরী বলেন, ‘এখানে ইতিহাস নিয়ে এ ধরনের লেখালেখি খুব কম হয়। একটি ধর্মের জায়গায় আরেকটি ধর্ম কীভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করল এটার উত্তর খোঁজা দরকার। তবে সব প্রশ্নের উত্তর ইতিহাস থেকে পাওয়া যাবে না। দ্বিমত ও বহুমতের মাধ্যমেই কেবল জ্ঞানের প্রসার ঘটে।’  


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন