নিরাকার আত্মার অভিব্যক্তি

ওয়াহিদ সুজন

শরীর মানে হলো অভিব্যক্তিময় শরীর। যেহেতু এখানে মানুষ বা শরীর নির্বিশেষ কোনো বিষয় নয়, সেই অর্থে এ অভিব্যক্তি পরিপার্শ্বকেও চিহ্নিত করে। সাবজেক্টিভ জায়গা থেকে এ পরিপার্শ্ব মানুষের শরীরের এক্সটেশন হিসেবে কাজ করে। মানুষ তার পরিপার্শ্বের ওপর কর্তৃত্বের দাবি ছাড়তে পারি না। এ দাবি ও তার কার্যকারিতা দুনিয়ার বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছে। খোদ মানুষেরও।

আচ্ছা, এমন শরীরী ব্যাপারের ভেতর মন কোথায় থাকে বা আধুনিক মানুষ কি অদৌ মনের হদিস পায়? আরেকটু এগিয়ে বললে আত্মার খবর কী! শারদ দাশের চিত্রকর্মে স্পষ্টত শরীর আছে এবং মন আছে, আত্মাও আছে। তাকে খুঁজে নিতে হয় অভিব্যক্তি ও পরিপার্শ্বের জটিল অন্তরঙ্গতার ভেতর। তবে শরীরে মনের অধিষ্ঠান নিয়ে সন্দেহ জাগে যখন শহরের ইট-কাঠের নির্মাণের একহারা জমিনে মানুষগুলোকে ক্রমেই নিজেকে ছাড়িয়ে দূরে কোথাও যেতে দেখি বা স্রেফ তারা দুরবিন দিয়ে দেখে। মানুষ নিজেকে দেখছে না, মন বা আত্মাকে সে কোথায় খুঁজে পাবে। এ অভিব্যক্তি থেকেই নিরাকার আত্মাকে খুঁজে নিতে হয়।

রাজধানীর লালমাটিয়ার কলা কেন্দ্রে চলছে শারদ দাশের ‘দি আর্কাইভিং বডি’ শিরোনামের এ প্রদর্শনী। কিউরেটর হয়ে আছেন শার্মিলি রহমান। শরীরের দ্বিধাগ্রস্ত নানা মুহূর্ত, সমাজ-সংস্কার ও সময়ের সঙ্গে সম্পর্ক উঠে এসেছে ৪৫টি চিত্রকর্মে। আর প্রদর্শনীর স্পেস ব্যবহার অনবদ্য, ইনস্টলেশনে রূপ নিয়েছে পুরো আয়োজন। শিরোনামের সঙ্গে সংগতি ও সম্মতির চমৎকার সম্মিলন ঘটেছে, যা দর্শকের মাঝেও সংক্রমিত হয়। 

শারদ তার চিত্রকর্মের বড় একটা অংশে আবহ হিসেবে শহরের ম্যাপ ফুটিয়ে তুলেছেন। যেখানে আমরা পাই কথিত ‘উন্নয়ন’ ও প্রযুক্তি আক্রান্ত মানুষদের। যারা বাহাস করছে, ক্লান্ত হচ্ছে, যারা চোখে ঠুলি পরে বা চোখ বুজে সত্য খুঁজতে চায়। যারা প্রকৃতি ধ্বংস করেছে আবার সেই ধ্বংসস্তূপের ওপর বসে প্রকৃতিকে দেখতে চায়। প্রকৃতির স্বাভাবিকতা যেখানে অস্বাভাবিক পরিপ্রেক্ষিত, যার প্রভাব দেখি চিত্রকর্মের বিষয়বস্তুতে। যেখানে পাশাপাশি বসে যখন দুজন মানুষ কথা বলে, তারা মুখের দিকে তাকায় না। কোনো না কোনো ডিভাইসের মাধ্যমে কথা পরস্পরের কানে পৌঁছে। এমন এক পরিস্থিতিতে মানুষ তার আত্মা ছুঁতে পাবে! 

স্থান ও সময়ের পরিসরে বিবর্তিত মানুষকে চিত্রকর্মে সংরক্ষণ করেছেন শারদ। মূলত আত্মপ্রতিকৃতির মাধ্যমে অভিব্যক্তিময় আধুনিক সময়কে ধরতে চেয়েছেন। যে কারণে এ সময়ের মানুষ একাত্ম ও আত্মস্থ করতে পারে। যে মানুষে নিরন্তন নিজেকে খোঁজার মতো ছদ্মবাসনা বিদ্যমান। চিত্রকর্মগুলো যতটা শরীরের নানা ভঙ্গিমানির্ভর, তার মাঝে অভিব্যক্তির ভিন্নতা খুব একটা নেই। সম্ভবত যেভাবে আমরা আমাদের চারপাশ তৈরি করছি, তাতে বৈচিত্র্যের স্থান দিন দিন আরো ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ছে। নির্ভার মানুষের দেখা মেলে না। সে এখন অপর হয়ে আছে নিজের কাছে। 

শারদের দূরের কোথাও স্থাপিত প্রতিকৃতি থেকে নিজেকে বুঝতে চলেছে যেন। আত্মদহন দেখা যায়, শারদ নিজেও নিজেকে হাজির করেছেন বড় ক্যানভাসে। যেখানে প্রযুক্তিশাসিত বিশ্বে তার অবস্থান ফুটিয়ে তুলেছেন। একই ক্যানভাসে ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যমে ব্যবহার করেছেন। এমনকি ছোট ছোট যন্ত্রাংশ স্থাপন করে দেখিয়েছেন এ সময়ের মানুষ কীভাবে আধামানব-আধাযন্ত্রে পরিণত হচ্ছে। অর্থাৎ খোদ শরীরও হচ্ছে বিপন্ন। শরীর দিয়ে যে জগৎ আমরা বুঝতে চাই, তাতেও দূষণ ঘটছে। সামগ্রিক এক বিষণ্ন ও বিপন্নতার মাঝে আশাবাদ যে নেই তা তো নয়। তবে শারদ তার সময়কে চিহ্নিত করেছেন আশাবাদের বিপরীতে। যে সময়ে মানুষকে নানা ছলে-বলে-কৌশলে মেপে নিচ্ছে অন্য কেউ। কিন্তু এই কি মানুষের নিয়তি? সম্ভবত না। অন্তত এতটুকু আশাবাদ তো চাই। যেখানে নিজেদের ও অপরকে বুঝতে চায়। মানুষের যৌথতায় ফুটে উঠবে আরো অভিব্যক্তিময়, বৈচিত্র্য এক বিশ্ব। 

অদ্ভুতভাবে শারদের চিত্রকর্ম ও বয়ানে মানুষ আতঙ্ক ও নিঃসঙ্গতা নিয়ে এক হচ্ছে। সংবাদমাধ্যমের বরাতে জানতে পারি প্রদর্শনী শুরুর দিন তিনি বলেছেন, ‘করোনা মহামারী বিশ্বের সব প্রান্তের মানুষকে শরীর নিয়ে একই রকম ধারণা দিয়েছে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত কোনো গ্রামের একজন মানুষ যেভাবে এতে আতঙ্কিত হয়েছে, তেমনি আমেরিকায় বসে থাকা একজনেরও একই অনুভূতি ছিল।’

অনুভূতির এ নৈকট্য, নিঃসঙ্গতা, প্রকৃতির ওপর খোদকারি, ডিজিটাল দুনিয়ার প্রভাব, মন-মগজের অপ্রয়োজনীয় বোঝা হয়ে ওঠার মাধ্যমে শারদ দাশ এ সময়ের কাটাছেঁড়া করেছেন। কিন্তু নৈকট্য যে ভীষণ রকম ফাঁপা, এরই মধ্যে বুঝতে পেরেছি। যা ভীষণ ভাবায়, চোখেও লেগে থাকে এবং অনুপস্থিত সত্ত্বেও বিপন্ন শরীরে নিরাকার আত্মা আরো অভিব্যক্তিময় হয়ে হাজির থাকে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন