শিল্পকর্মে সাঁওতাল জীবন ও সংগ্রাম

মাহমুদুর রহমান

সফিউদ্দিন আহমেদের ‘‌ময়ূরাক্ষীর ধারে’

সাঁওতালদের সম্পর্কে কিছু প্রচলিত ধারণা ছড়ানো আছে জনপ্রিয় ধারায়। প্রথমেই আসে সাঁওতালদের নাচ, তাদের জীবনযাপনের খোলামেলা ধারা, মদ্যপান ইত্যাদি। এর বাইরে সাঁওতালদের জীবনকে কাছ থেকে দেখার ক্ষেত্রে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম আসে সর্বাগ্রে। ‘‌অরণ্যবহ্নি’ উপন্যাসে তিনি সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রসঙ্গ এনেছিলেন। সাঁওতাল ও সাঁওতাল জীবনকে গভীরভাবে অনেক শিল্পী দেখার চেষ্টা করেছেন। তাদের একটি বড় অংশ ছিলেন চিত্রকর ও ভাস্কর। তারা তাদের চিত্র ও ভাস্কর্যে সাঁওতাল, সাঁওতাল জীবন, যাপন ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছেন। 

শুরুটা করা যায় যামিনী রায়কে দিয়ে। বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড় গ্রামের এ সন্তান সাঁওতাল জীবনকে দেখেছিলেন খুব কাছ থেকে। সেখান থেকেই চিত্রকর্মে সাঁওতালদের নিয়ে আসেন তিনি। যামিনী রায় ১৯২১-২৪ সাল পর্যন্ত সাঁওতালদের নিয়ে কাজ করেন। তিনি পটচিত্রের ধরনে ছবি আঁকা শুরু করেছিলেন। সাঁওতালদের নিয়ে আঁকা ছবিও সে ঘরানারই। তার বিখ্যাত ছবি ‘‌সাঁওতাল মা ও ছেলে’। কালিঘাটের পটচিত্রের প্রভাব দেখা যায় এ ছবিতে। তবে সাঁওতালদের পোশাক, গহনার উপস্থিতি এ ছবিতে লক্ষণীয়। এর বাইরেও তিনি বেশকিছু ছবি এঁকেছেন সাঁওতালদের নিয়ে। এসব ছবিতে সাঁওতাল নারীরা প্রাধান্য পেয়েছেন। একটি ছবিতে সাঁওতাল নারীর চুল বাঁধা দেখা যায়। আছে ‘‌সন্তানের সঙ্গে সাঁওতাল নারী’র একাধিক ছবি।

যামিনী রায়ের পর পরই নাম নিতে হয় রামকিঙ্কর বেইজের। তিনি ১৯৩৮ সালে একটি ভাস্কর্য তৈরি করেছিলেন, যা তাকে ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাস্করের আসনে বসিয়ে দেয়। ভাস্কর্যটি ছিল একটি সাঁওতাল পরিবারের। খুবই সাধারণ একটি বিষয়কে ভাস্কর্যে রূপ দিয়েছিলেন বেইজ, কিন্তু তার নির্মাণের গুণে সেটি হয়ে উঠেছিল অসাধারণ। ভাস্কর্যে একটি সাঁওতাল পরিবারের বাড়ি ফেরা দেখা যায়। সাঁওতাল দম্পতি বাড়ি ফিরছে যেখানে নারীটির কাঁধে একটি দড়ির খাঁচা এবং সেখানে ঝোলানো রয়েছে একটি শিশু। তাদের সঙ্গে আছে প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি এবং সঙ্গে চলছে একটি পোষা কুকুর। শান্তিনিকেতনে ভাস্কর্যটি তৈরি করতে রামকিঙ্কর ব্যবহার করেছিলেন সিমেন্ট, খোয়াই নদীর মোটা বালি ও কাঁকর, পাথরের কুঁচি ও রড।

সাঁওতাল জীবন টেনেছিল শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকেও। তার একটি বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘‌সাঁওতাল রমণী’। এ ছবিতে দুজন সাঁওতাল নারীকে দেখা যায়। ১৯৬৯ সালে ছবিটি এঁকেছিলেন জয়নুল আবেদিন। এটি ক্যানভাসে আঁকা তৈলচিত্র। ছবিটির আকার ৮ বাই ২৭ ইঞ্চি। নাতিদীর্ঘ আকারের এ ছবিতে জয়নুল আবেদিনের ডিটেইলিং দৃষ্টিগ্রাহ্য। ২০১৮ সালে চিত্রকর্মটি নিউইয়র্কে নিলাম হয়। নিলামে চিত্রকর্মটি ১ লাখ ৮৭ হাজার ডলারে বিক্রি হয়েছিল। এছাড়া শিল্পাচার্য সাঁওতালদের নিয়ে ছবি এঁকেছেন যার মধ্যে সাঁওতাল দম্পতির ঘরে ফেরার ছবিটি অন্যতম।

বাংলাদেশের আরেক খ্যাতনামা শিল্পী সফিউদ্দিন আহমেদকেও টেনেছিল সাঁওতাল জীবন। ছাপচিত্রের জনক হিসেবে পরিচিত এ শিল্পীও তার ছবিতে এনেছিলেন সাঁওতাল নারীকে। তার ‘‌ময়ূরাক্ষীর ধারে’র (১৯৪৮) দুই নারীর সঙ্গে জয়নুল আবেদিনের ছবির মিল পাওয়া যায়। এছাড়া তিনি এঁকেছিলেন ‘‌বনপথে দুই সাঁওতাল নারী’, ‘‌দুমকা চিত্রমালা’ ও ‘‌সাঁওতাল মেয়ে’। মূলত ছবি আঁকতে প্রাকৃতিক পরিবেশের খোঁজে বাইরে বেরিয়ে তিনি দুমকায় তা পেয়েছিলেন। সাঁওতাল পরগনার দুমকার পরিবেশ ও মানুষ তাকে প্রভাবিত করেছিল। তিনিও তাই সাঁওতাল জীবনকে ধরে রেখেছিলেন নিজের ছবিতে।

সাঁওতাল নারী ও দম্পতি নিয়ে ছবি এঁকেছেন অনেক শিল্পী। এর মধ্যে সুরেন্দ্রনাথ করের আঁকা ১৯৪৮ সালের ‘‌সাঁওতাল দম্পতি’ অন্যতম। সাঁওতাল জীবন, ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে এখনো আঁকছেন শিল্পীরা। ২০১৭ সালে লালমাটিয়ায় আয়োজন হয়েছিল প্রদীপ ঘোষের একক চিত্র প্রদর্শনী ‘‌সাঁওতালনামা’। শিল্পীর ২১টি ছবি নিয়ে হয়েছিল এ প্রদর্শনী। কালো রঙে আঁকা ছবিগুলোয় সাঁওতালদের জীবন, আন্দোলন ও সংগ্রামকে শিল্পী ফুটিয়ে তুলেছিলেন রেখায়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন