সময়ের ভাবনা

এবারের বাজেটের প্রধান তিন চ্যালেঞ্জ

ড. আশেক মাহমুদ

বাজেট মানে রাষ্ট্র পরিচালনার অর্থনৈতিক পরিকল্পনা। প্রতি বছরের মতো এবারো রুটিনমাফিক বাজেট উপস্থাপন হবে। এ বাজেটই আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থার গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে একটা ধারণা দেয়। বাজেট থেকে জানতে পারি দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও সংকট কতটুকু। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এমনিতেই অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সংকটের মধ্যে রয়েছে। সে কারণে আসন্ন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট সেসব সংকট কতটুকু মোকাবেলা করতে পারবে, তা জানার আগ্রহ নাগরিকদের মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান তিনটি চ্যালেঞ্জ (উচ্চমূল্যস্ফীতি, ব্যাংক খাতে অব্যবস্থাপনা ও নির্ভরশীল অর্থনীতি) কীভাবে সরকার মোকাবেলা করবে তা গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। 

১. উচ্চমূল্যস্ফীতি 

গত এক বছরে মূল্যস্ফীতি এতটাই অনিয়ন্ত্রিত যে আয় বৃদ্ধি করে আশু সমাধান মিলছে না। মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বা আয় বৃদ্ধির হার পুরো বছরেই কম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, গত এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ, অথচ মজুরি বৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। এদিকে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত সংলাপে বলা হয়েছে, দেশের মানুষের আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আয়বৈষম্যও বেড়েছে। এর অংকটা খুবই স্বাভাবিক। মূল্যস্ফীতির তুলনায় আয় বাড়ার হার কমে গেলে আয়বৈষম্য বাড়বে। কেননা পণ্যের দাম উচ্চহারে বাড়লে ওইসব পণ্যকেন্দ্রিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মুনাফা বাড়ে, কিন্তু ক্রেতাদের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে যায়। আয়বৈষম্যের আরেকটি কারণ অনানুষ্ঠানিক আয়ের ওপর নির্ভরতা। বিবিএসের হিসাবে, বাংলাদেশে ৮৬ শতাংশ মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে আয় করে। এর মানে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা থেকে তাদের আয় বিচ্ছিন্ন। এ বিচ্ছিন্নতার কারণে বাজারে চলমান মূল্যস্ফীতি অনুযায়ী তাদের সংসার চালাতে হয়। সংসারের খরচ কমানো, সঞ্চয় ভেঙে চলা বা ধারদেনা ছাড়া অন্য উপায় পায় না। একদিকে অনানুষ্ঠানিক খাতে উপার্জনকারীদের আয় কম ব্যয় বেশি, অন্যদিকে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে উপার্জনকারীদের আয় ও ব্যয় বেশি। ফলে আয়বৈষম্য হবে অনিবার্য পরিণতি। 

এ ধরনের মূল্যস্ফীতি ও আয়বৈষম্যের জন্য আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ কারণ দায়ী। প্রথমত বলা হয়, ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি পুরো বৈশ্বিক বাজারকে অস্থির করে তুলেছে। এর প্রভাব অনেক দেশের ওপর পড়েছে সত্য, কিন্তু অনেক দেশ সেই প্রভাবকে মোকাবেলা করে মূল্যস্ফীতির মাত্রা কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের মূল্যস্ফীতি বর্তমানে ৫ শতাংশের নিচে, যা গত এক বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। তাহলে আমরা কেন কমাতে পারছি না। 

মূল্যস্ফীতির জন্য সাধারণ অর্থে নিত্যপণ্যের আমদানিনির্ভরতাকে দায়ী করা হয়। ডলারের দাম বাড়ার ফলে আমদানি খরচ বেশি গুনতে হয়। এদিকে চলমান ডলার সংকটের কারণে আমদানির সীমা নির্ধারণ করা হয়। এলসিতে (ঋণপত্র) কড়াকড়ি আরোপের ফলে আমদানির ব্যয় কমেছে, কিন্তু চাহিদার তুলনায় পণ্যের জোগান কমে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে গেছে। এ ধরনের নিয়ন্ত্রণ বাজার ব্যবস্থার স্বাভাবিক গতি মন্থর করে। ফলে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। সবচেয়ে বোধগম্য বিষয় হলো, জ্বালানি খাতে দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পুরো আর্থিক খাতের ওপর পড়েছে। এর প্রভাবে কৃষি ও শিল্প খাতে উৎপাদন খরচ অতিমাত্রায় বেড়ে যায়। তখনই মুদ্রাস্ফীতি স্বাভাবিক যুক্তিতে পরিণত হয়। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতিকে কমিয়ে আনতে বাজেটে এর কৌশল নির্ধারণের পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থাপনাকে সরকারিভাবে কঠোর নিয়ন্ত্রণে আনা অত্যাবশ্যক। 

২. ব্যাংক খাতে অব্যবস্থাপনা

আর্থিক উন্নয়নে ব্যাংক খাতে দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও সমন্বয় অতি গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চমাত্রার খেলাপি ঋণ সংকটের গভীরতা বাড়িয়ে দেয়। খেলাপি ঋণের পরিমাণের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শ্রীলংকার পরই। ২০০৯ সালে আমাদের দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা; ২০২৩ সালে এর অংক বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য খেলাপিদের বিশেষ সুবিধা ও ঋণ অবলোপনে (মন্দঋণ নাম দিয়ে যে ঋণ আদায়ের আশা নেই তা ব্যালান্স শিট থেকে বাদ দেয়া) বিশেষ ছাড় দেয়া হয় ২০১৫ সাল থেকে। তবু দেখা গেছে, খেলাপি ঋণের প্রবাহ আরো বেড়ে গেছে। খেলাপি ঋণের এ ঊর্ধ্বগতি জাতীয় অর্থনীতির জন্য একটি অশনিসংকেত। বিভিন্ন দেশ ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে খেলাপি ঋণের দক্ষ ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে খেলাপি ঋণের মাত্রা কমাতে সক্ষম হয়। চীনে ঋণখেলাপিরা বিমান ও রেলের টিকিট পায় না। শাস্তির ব্যবস্থা ছাড়াও সম্পদ ব্যবস্থাপনা কমিটির মাধ্যমে এমনকি খেলাপি ঋণকে শেয়ারে রূপান্তর করে সংকট কমানো হয়। আসন্ন বাজেটে খেলাপি ঋণকে জাতীয় সংকট আখ্যায়িত করে সফল দেশগুলোর মানদণ্ড ব্যবহার করে খেলাপি ঋণ আদায়ের কার্যকরী উদ্যোগ ঘোষণা করতে হবে। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের ভয়ানক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য রূপরেখা প্রণয়ন ও কর্মপন্থা পেশ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। 

৩. নির্ভরশীল অর্থনীতি 

একটা দেশের নির্ভরশীল অর্থনীতির জন্য তিনটি প্রধান কারণ বিজড়িত: ১) আমদানিনির্ভর অর্থনীতি, ২) অপ্রতুল রাজস্ব আয় ও ৩) বিদেশী আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর দায়বদ্ধতা। অর্থনীতিতে বিদেশনির্ভরতার মাত্রা যত বেশি হবে তত বেশি দুর্বল হয়ে পড়বে আমাদের আর্থিক ব্যবস্থাপনা। স্বনির্ভর অর্থনীতি ও বিদেশনির্ভর অর্থনীতির হার না কমে এলে আমাদের আর্থিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। স্বনির্ভর অর্থনীতিতে রফতানি আয় আমদানি ব্যয়ের চেয়ে অধিক; এর বিপরীতে, বিদেশনির্ভর অর্থনীতিতে আমদানি ব্যয় রফতানি আয়ের চেয়ে বেশি। এক কথায় বাণিজ্য ঘাটতি যত বেশি হবে, ততই দুর্বল হবে আমাদের অর্থনীতি। 

আমাদের আর্থিক খাতে কম রফতানিমুখিতার প্রধান কারণ কৃষি ও শিল্প খাতে অনগ্রসরতা। আমরা ধান উৎপাদনে স্বনির্ভর হতে পারিনি বিধায় এখনো চাল আমদানি করতে হয়। আমাদের বাজারকে যেভাবে বিদেশী কোম্পানির পণ্যসামগ্রীর বাজারে পরিণত করেছি সে তুলনায় দেশী কোম্পানির বাজার হয়েছে সংকুচিত। এর প্রধান কারণ বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে যাওয়া। বিবিএসের তথ্য বলছে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট জিডিপির তুলনায় বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ এখন তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ডিএসই ও কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রকারান্তরে উৎপাদন ও সেবা খাতের ২০৪টি কোম্পানির মধ্যে ১১৯টির মুনাফা গত বছরের তুলনায় কমেছে। এতে কোম্পানিগুলোয় কর্মরত কর্মী ছাঁটাইয়ের ঝুঁকি বেড়ে গেছে। মুনাফা কমে যাওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ গ্যাস ও বিদ্যুতের অত্যধিক মূল্যবৃদ্ধি, বিদেশ থেকে আমদানীকৃত কাঁচামালের জন্য আমদানি খরচ বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির জন্য চাহিদা হ্রাস। 

নির্ভরশীল অর্থনীতির আরেকটা দিক হলো বিদেশী আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর দায়বদ্ধতা। আমরা ধরেই নিয়েছি যে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের কাছ থেকে প্রাপ্ত ঋণের ওপর নির্ভর করেই চলতে হবে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদের আর্থিক সামর্থ্য কম, এ ধারণার বশবর্তী হয়ে আমরা নির্ভরশীলতাকে উন্নয়নের শর্ত বানিয়েছি। নির্ভরশীলতার প্রতি এ ঝোঁক রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার প্রবণতা কমিয়ে দেয়। শুধু তা-ই নয়, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের কিস্তি শোধ করতে গিয়ে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক পরিণতি এনে দেয়। বর্তমানে সরকারকে ঋণের বোঝা বহন করতে হচ্ছে প্রায় ১৬৭ বিলিয়ন ডলার। ঋণের দায় মেটাতে চলতি বাজেটের হিসাব অনুযায়ী, ১৮ শতাংশ (বাজেটের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ) ব্যয় বরাদ্দ রাখা হয়। এতে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও উৎপাদন খাতে বাজেট বরাদ্দ কমিয়ে দিতে হয়। 

উপর্যুক্ত খাতগুলোয় বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য বড় আকারের রাজস্ব আয় বাড়ানো অত্যাবশ্যক। সমস্যা হলো আইএমএফের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২৩ সালে দেশে সরকারের ঋণ-জিডিপির অনুপাত ৪২ শতাংশ, অথচ রাজস্ব আয়-জিডিপির অনুপাত হয়েছে ৮ দশমিক ৭ শতাংশ এবং শুধু কর-জিডিপির অনুপাত ৭ দশমিক ৮ শতাংশ (সূত্র: দৈনিক বণিক বার্তা, এপ্রিল ৩০, ২০২৩)। এ থেকে স্পষ্ট, আমাদের নিজস্ব আর্থিক সক্ষমতা ঋণ বা নির্ভরশীলতার তুলনায় কত কম! করপোরেট আয়কর কমিয়ে দেয়া, আয়কর রিটার্নের কার্যকরী জবাবদিহিতা না থাকা এবং আয়কর ফাঁকি দেয়াকে শাস্তির আওতায় না আনার ফলে ই-টিন প্রাপ্ত করদাতাদের এক-তৃতীয়াংশ এখনো আয়করের আওতায় আসতে পারেনি। আয়করকে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উত্তরণের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো না হলে বিপদ সামলানো মুশকিল হয়ে যাবে। আসন্ন বাজেটে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কার্যকর উপায় বের করা জরুরি। রাজস্বকে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য সম্পৃক্ত করতে হবে, এমনকি বিদেশী সংস্থার ওপর ঋণনির্ভরতার হার কমাতে রাজস্ব ব্যয়ের কৌশল নিয়ে আসতে হবে। 

জাতীয় স্বার্থের দিক বিবেচনায় বাজেট রচিত হোক এবং সে অনুযায়ী যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হোক, এটাই জনগণের দাবি। উচ্চমূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনাকে সুশাসনে নিয়ে আসতে হলে প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট রূপরেখা। সবচেয়ে বড় প্রয়োজন স্বনির্ভর অর্থনীতির জন্য সুসংগঠিত পদক্ষেপ। জনগণের সম্পদ কীভাবে জনগণের কল্যাণে কাজে লাগানো যায়, তার বাস্তবধর্মী রূপরেখা দেখতে চায় জনগণ। কেননা জনগণের সন্তুষ্টি ও প্রত্যাশা প্রতিফলিত হয় নির্বাচন প্রক্রিয়ায় স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মধ্যে। 

ড. আশেক মাহমুদ: সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন