বিশ্লেষণ

শিক্ষাই শক্তি শিক্ষায় মুক্তি

ড. শামসুল আলম

এক যুগেরও বেশি সময় ধরে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ধারাবাহিক উন্নয়নের ফলে বাংলাদেশের কিছু উল্লেখযোগ্য মাইলস্টোন অর্জন হয়েছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকগুলোর ধারাবাহিক ইতিবাচক পরিবর্তনের ভিত্তিতে গত দশককে বাংলাদেশের উন্নয়নের স্বর্ণযুগ বলা যেতে পারে। বাংলাদেশ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার বেশির ভাগই অর্জন করতে সক্ষম হয়। ফলে বাংলাদেশ ডজনের বেশি আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়। গত দশকে কভিড-১৯-এর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ বিশ্বে দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতিগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল। পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ মাথাপিছু আয় ও সামাজিক সূচকগুলোর মধ্যে প্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে দারিদ্র্য নিরসনে অসামান্য অর্জন। 

বাংলাদেশে মাথাপিছু আয়, শিশু মৃত্যুহার হ্রাস, অপুষ্টির ব্যাপকতা হ্রাস, বিদ্যালয়ে ভর্তির হার বৃদ্ধি, স্বাক্ষরতার হার, প্রত্যাশিত গড় আয়ু, জেন্ডার সমতা, মাথাপিছু আয় প্রভৃতি সূচকে ভারত ও পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে। এর প্রতিফলন দেখা গেছে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়নের জন্য জাতিসংঘ অনুমোদিত সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশন নেটওয়ার্কের এসডিজি সূচকের র‍্যাংকিংয়ে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লীগ টেবিল’-এর ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৩১-৩২ সালেই বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ট্রিলিয়ন ডলার হবে এবং ২০২২ সালের ৩৪তম অবস্থান থেকে ১৪ ধাপ এগিয়ে ২০৩৭ সালে ২০তম বৃহত্তম অর্থনীতি হবে। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অর্জনকে উন্নত দেশের সমপর্যায়ে পৌঁছানোর জন্য আমাদের প্রয়োজন শিক্ষাকে সর্বস্তরে গুরুত্ব দেয়া। 

দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তি নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার মতে, শিক্ষা হলো সবচেয়ে বড় অস্ত্র যা পৃথিবীকে বদলে দিতে ব্যবহার করা যাবে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে শিক্ষা অর্জনের (শিক্ষা বছর) সঙ্গে উপার্জন বৃদ্ধি নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। অর্থাৎ যারা শিক্ষার পেছনে বেশি সময় (বছর) ব্যয় করেছেন গড়পড়তা যারা কম সময় ব্যয় করেছেন তাদের তুলনায় গড় আয় বেশি। যুক্তরাষ্ট্রে আজকে শিক্ষা ও গবেষণার যে মান তা সহজে অর্জন হয়নি। শিক্ষা ও গবেষণায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ ছাড়া এ অর্জন সম্ভব হতো না। দেশটির আজকের এ বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি হওয়ার পেছনে শিক্ষার বিনিয়োগের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। মৌলিক শিক্ষায় শিক্ষিত আংশিক দক্ষ কর্মশক্তিই বাংলাদেশকে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে শিল্পে কাঠামোগত রূপান্তরে ভালোভাবে সহায়তা করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ২০৩১ অর্থবছরের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের মর্যাদা অর্জনের লক্ষ্য রেখে প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত ও আরো উন্নতির জন্য কাজ করছে। বাংলাদেশের তথাকথিত ‘মধ্যম আয়ের ফাঁদ’ অতিক্রম করার জন্য বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেখা যায়, যে দেশগুলো শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে, তারা দ্রুত ‘মধ্যম আয়ের ফাঁদ’ এড়াতে সক্ষম হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে জনমিতিক লভ্যাংশ বা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড চলমান রয়েছে। সরকারের লক্ষ্য শিক্ষা খাতে ব্যয় বর্তমানে ২ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশে উন্নীত করা। 

বাংলাদেশ প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চতর শিক্ষায় প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে। কিন্তু শিক্ষার গুণগত মান বিবেচনা করলে এটি চিন্তার বিষয়। শিক্ষার বিকেন্দ্রীকরণ আশানুরূপ হয়নি। মাদ্রাসা শিক্ষা মূলধারার শিক্ষা থেকে আলাদা রয়ে গেছে। দক্ষতা উন্নয়নে কিছুটা অগ্রগতি হলেও তা এখনো পিছিয়ে আছে। আমাদের শিক্ষার আরো একটি বড় সমস্যা হলো বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার সঙ্গে শিল্পের যোগাযোগের অভাব। আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা আছে—‘দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি সাধনের জন্য শিক্ষাকে সৃজনধর্মী, প্রয়োগমুখী ও উৎপাদন সহায়ক করে তোলা; শিক্ষার্থীদের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে তোলা এবং তাদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলির বিকাশে সহায়তা প্রদান করা’।

বাংলাদেশ ২০০৯-২১ সময়ে উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যায় ব্যাপক প্রবৃদ্ধি দেখেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ২০০৮ সালের ৮২টি থেকে বেড়ে ২০২১ সালে হয়েছে ১৬০টি। এর মধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা একই সময়ে ৫১ থেকে দ্বিগুণ বেড়ে হয়েছে ১১০। সেই ধারাবাহিকতায় বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে অনেক। ২০০৯ সালে যা ছিল শূন্য দশমিক ৪ মিলিয়ন, তা ২০২১ সালে হয়েছে ১ দশমিক ২ মিলিয়ন। এ ইতিবাচক ধারা ধরে রাখতে বাংলাদেশ সরকার উচ্চশিক্ষার জন্য কৌশলগত পরিকল্পনা ২০১৭-৩১ অবলম্বন করেছে। উচ্চশিক্ষায় ভর্তির হার ২০ শতাংশ। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ছাত্রীদের ভাগ ৪৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ। মানবসম্পদ উন্নয়ন ও শিক্ষা খাতে অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধন হয়েছে। 

বর্তমানে অর্থনৈতিক শক্তি সামরিক শক্তির স্থান দখল করেছে। কিন্তু অর্থনৈতিক শক্তির ভিত্তিটা কোথায়? জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও গবেষণায় যে অর্থনৈতিক শক্তির বুনিয়াদ সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বর্তমানে বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ পল রোমার আশির দশকের শেষ ভাগে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নতুন তত্ত্ব উদ্ভাবন করেন যা এন্ডোজেনাস গ্রোথ থিওরি নামে পরিচিত। এ তত্ত্ব অনুসারে প্রবৃদ্ধির নিয়ামক বাহ্যিক কোনো শক্তি নয় বরং মানবপুঁজি, উদ্ভাবন ও জ্ঞান বা শিক্ষায় বিনিয়োগই এর অন্যতম অনুঘটক। এক শতাব্দী ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি তার অন্যতম উদাহরণ।

উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর মাধ্যমে দারিদ্র্য নিরসন ও প্রবৃদ্ধির জন্য শিক্ষা, বিজ্ঞান ও কারিগরি দক্ষতা অপরিহার্য। বর্তমানে জ্ঞান অর্থনীতি তাই উন্নয়ন কৌশলের অন্যতম অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে প্রেক্ষিত পরিকল্পনা-২০৪১ এবং অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় মানব উন্নয়ন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখা হয়েছে। মানব উন্নয়নের জন্য প্রেক্ষিত পরিকল্পনা-২০৪১ রূপকল্প বস্তুত মূল প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্যসংশ্লিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে চালিত, যার উদ্দিষ্ট ২০৪১-এর মধ্যে চরম দারিদ্র্যের প্রায় অবসানসহ উচ্চ আয় মর্যাদা অর্জন। আমাদের লক্ষ্য ২০৪১ সালের মধ্যে একটি জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির প্রতিষ্ঠা। 

মানব উন্নয়ন সূচকেরও অন্যতম সূচক হলো শিক্ষা। কিন্তু এখন শুধু শিক্ষা নয়, শিক্ষার মান অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টে গুণগত শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। অভীষ্ট ৪-এ বিশেষ প্রণিধানযোগ্য-সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং জীবনব্যাপী শিক্ষালাভের সুযোগ সৃষ্টি। আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যতে বলা হয়েছে—‘সর্বক্ষেত্রে মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করা এবং শিক্ষার্থীদের গবেষণায় উৎসাহী করা এবং মৌলিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের গবেষণার সঙ্গে সঙ্গে দেশের জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণার উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলা’।

বৈশ্বিক জ্ঞান সূচক ২০২২-এ ১৩২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৫তম। শ্রীলংকার অবস্থান ৭৯, ভুটানের অবস্থান ৮৯, ভারতের অবস্থান ৯১, নেপাল ১০৮, পাকিস্তান ১১০। বৈশ্বিক উদ্ভাবনী সূচক ২০২২-এ ১৩২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০২। ভারতের অবস্থান ৪০তম, শ্রীলংকার ৮৫, পাকিস্তানের ৮৭, নেপালের ১১১তম। টাইমস হায়ার এডুকেশন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‍্যাংকিং ২০২৩-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্থ সাঊট ইউনিভার্সিটির অবস্থান ৬০১-৮০০। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট ও খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ১২০১-১৫০০। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাংকিং এখনো নেই। হতাশাজনক বটে! 

দক্ষতা উন্নয়নে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। এছাড়া প্রশিক্ষণের সঙ্গে চাহিদার সামঞ্জস্য খুব কম। বিকেন্দ্রীকরণের অভাবে অপর্যাপ্ত সুবিধাদি ও প্রশিক্ষক বিদ্যমান। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি নগণ্য। সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো গবেষণা উন্নয়নে আমাদের ব্যয় খুব সীমিত।

ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০-এর সুষ্ঠু বাস্তবায়নের জন্য পানি, জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা, কৃষি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা এবং অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, কার্যকরী প্রতিষ্ঠান পরিচালন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন এবং জ্ঞান ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত কারিগরি দক্ষতা সংবলিত শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে কৃষি সম্পর্কিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। 

অন্যদিকে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে গুণগত মান বৃদ্ধি, ছাত্রদের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি, উচ্চশিক্ষায় শাসন উন্নীতকরণ, গবেষণা ও শিক্ষায় অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, বিশ্ববিদ্যালয়কে মঞ্জুরী কমিশন পুনর্গঠনের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় অনেক হয়েছে বিধায় একে আরো স্বশাসিত ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে ক্ষমতায়িত করা প্রয়োজন। কিশোর ও যুবকদের জন্য আলাদা কর্মসূচি তৈরি, জনসমাজভিত্তিক শিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন, ফলপ্রসূ দক্ষতা প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি, বেসরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে অংশীদারত্ব তৈরি, অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা বোর্ড গঠন এ খাতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে পারে। শিক্ষায় পর্যাপ্ত সম্পদ বাড়াতে হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে আমাদের আরো অনেক দূর যেতে হবে। বিশেষত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণা, খাতভিত্তিক উদ্যোগ গ্রহণ, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা সংস্থা সংস্কার, প্রায়োগিক গবেষণা ও উন্নয়ন খাত উৎপাদনশীলতার সঙ্গে এর সংযোগ স্থাপন করতে হবে। 

সরকার শিক্ষার পরিমাণগত ও গুণগত পরিবর্তনে ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ২০১৯ সালে ২ হাজার ৭০০-এর বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্তির ঘোষণা করেছিল সরকার। গত বছরের ৬ জুলাই ২ হাজার ৭১৬টি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। নতুন করে আরো ২৫৫টি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বর্তমান সরকারের সময়ে ২৬ হাজার ১৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে নতুন করে জাতীয়করণ করা হয়েছে। ১ লাখ ৪২ হাজার শিক্ষকের চাকরি সরকারীকরণ হয়েছে। দেশের প্রায় ৯৮ শতাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয় বেসরকারি। তার পরও ওইসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারীদের শতভাগ বেতন প্রদান করা হচ্ছে। ১৯৯০ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিশুর হার ছিল ৬১ শতাংশ। বর্তমানে তা উন্নীত হয়েছে ৯৭ দশমিক ৭ শতাংশে। সুবিধাবঞ্চিত গরিব ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা নিশ্চিতের লক্ষ্যে ‘শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট আইন, ২০১২’ প্রণয়ন করা হয়েছে। গঠন করা হয়েছে ‘শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট’। শিক্ষায় সরকারের আরেকটি অন্যতম সাফল্য জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন করা। তাছাড়া শিক্ষা আইন ২০২১-এর খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। 

প্রায় শতভাগ শিশুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিতকরণ, ঝরে পড়ার হার কমিয়ে আনা, উপবৃত্তি, বছরের শুরুতেই আদিবাসীসহ সব শিক্ষার্থীর জন্য বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, বিপুলসংখ্যক প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পর্যাপ্তসংখ্যক নারী শিক্ষক নিয়োগ এবং শিক্ষা ও স্বাক্ষরতার হার বৃদ্ধির প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। করোনাকালে বর্তমান সরকারের বহুমুখী প্রয়াসের মাধ্যমে উল্লিখিত অর্জনগুলো ধরে রাখার জন্য প্রশংসার দাবি রাখে। ২০২২ শিক্ষা বর্ষে মাধ্যমিক স্তরে ১ কোটি ২২ লাখ ৬১ হাজার শিক্ষার্থীদের মাঝে ১৭ কোটি ৯৪ লাখ সাড়ে ৪৬ হাজার পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। এ বছর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের ৪ কোটি ২৬ লাখ ১৯ হাজার শিক্ষার্থীর হাতে এবার ৩৫ কোটি ২১ লাখ ৯৭ হাজার ৮৮২ কপি বিনামূল্যের পাঠ্যবই তুলে দেয়া হয়েছে।

জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১-এর আলোকে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বিকাশে নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ১০ ধরনের শেখার ক্ষেত্র ঠিক করা হয়েছে। এগুলো হলো—ভাষা ও যোগাযোগ, গণিত ও যুক্তি, জীবন ও জীবিকা, সমাজ ও বিশ্ব নাগরিকত্ব, পরিবেশ ও জলবায়ু, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি। প্রাক-প্রাথমিকের শিশুদের জন্য আলাদা বই থাকবে না, শিক্ষকরাই শেখাবেন। শিক্ষা ক্ষেত্রে সংস্কার অবশ্যই প্রয়োজন। তবে নতুন যেকোনো সংস্কার বা পদক্ষেপ অনেক ভেবেচিন্তে নিতে হবে, কেননা অতীতে অনেক সংস্কার প্রস্তাব তেমন কোনো ভালো ফল বয়ে আনেনি, তা শিক্ষার মান বাড়াতে বা বাজার উপযোগী করতে পারেনি। 

অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় উচ্চশিক্ষার জন্য কৌশলগুলো হলো—বিজ্ঞান, কারিগরি প্রকৌশল ও গণিত (এসটিইএম) বিষয়গুলোয় মনোযোগ বাড়ানো, সরকারি ও বেসরকারি খাতের সহযোগিতা, প্রশিক্ষণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংখ্যা বৃদ্ধি, লিঙ্গ পার্থক্য কমানো (প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হলেও তৃতীয় পর্যায়/উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে লিঙ্গসমতা অর্জন হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছেলে শিক্ষার্থীরা মেয়ে শিক্ষার্থীদের তুলনায় ৩:১ অনুপাতে বেশি), গবেষণা ও প্রকাশনায় মনোযোগ বাড়ানো। এ লক্ষ্যগুলো অনুসরণ করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। জাতীয় এ পুনর্জাগরণকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রশাসন এবং ছাত্রছাত্রীদের অনন্য ভূমিকা রয়েছে। ইতিহাসের এ অমোঘ দাবি পূরণ করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্ররা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাবেন—এটাই বর্তমানের প্রত্যাশা। 

ড. শামসুল আলম: সামষ্টিক পরিকল্পনাবিদ, অর্থনীতিবিদ ও প্রতিমন্ত্রী, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন