প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষকের ঘাটতি

মো. আবিদ মঈন খান

দেশে নানামুখী ঘাটতিতে ভুগছে শিক্ষা ব্যবস্থা, তবে এর মধ্যে বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মানসম্মত শিক্ষা। প্রতি বছর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলে পাসের আধিক্য বাড়লেও শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে যথেষ্ট সংশয় ও প্রশ্ন এখনো রয়েছে। শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন মানসম্মত শিক্ষাদানের জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও দক্ষতাসম্পন্ন শিক্ষক দিয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান নিশ্চিত করতে পারলে মানসম্মত একটি শিক্ষাক্ষেত্র তৈরি হবে। তবে দেশের প্রয়োজন অনুপাতে স্কুলগুলোয় শিক্ষকের বিশাল ঘাটতি এখনো বিদ্যমান, ঠিক কতটা ঘাটতি রয়েছে তার যদিও সঠিক হিসাব নেই, তবে গণমাধ্যমগুলোর দেয়া তথ্য মতে, ৬০-৭০ হাজার শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে। শিক্ষকের ঘাটতি পূরণের জন্য সরকার চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল যেখানে ৬৮ হাজার শূন্য পদে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হবে। আর যদিও শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াটি এখন খুবই স্বচ্ছ এবং সহজ হওয়ার কথা। মানসম্মত শিক্ষক নেয়ার প্রক্রিয়ায় সুযোগ পাওয়ার জন্য স্নাতক-মাস্টার্স সম্পন্ন করা চাকরিপ্রার্থীরা নিয়োগ পরীক্ষা দিয়ে নিবন্ধন সনদ নেন, এরপর তাদের কেবল শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়ার কাজটাই বাকি রয়ে যায়। যাদের শিক্ষক নিবন্ধন সনদ আছে তাদের মধ্য থেকে মেধাক্রমানুসারে নিয়োগ দেয়া হলে শিক্ষক ঘাটতির একটা বড় অংশ পূরণ হয়ে যেত এতদিনে। এর মাধ্যমে দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী যারা কিনা বেকার রয়েছেন তাদের জন্য একটি ব্যবস্থা হতো। পাশাপাশি দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে তাদের অংশগ্রহণ পাওয়া যেত। 

বণিক বার্তায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে সাড়ে ৮২ শতাংশ অন্য বিষয়ের ডিগ্রিধারী শিক্ষক গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে পাঠদান করছেন। আমাদের দেশে শিক্ষার্থীদের কাছে এমনিতেই সাধারণত গণিত ও ইংরেজি কঠিন বিষয় হিসেবে চিহ্নিত। আর পাবলিক পরীক্ষায় অকৃতকার্যদের বেশির ভাগ অকৃতকার্য হয়ে থাকে ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে। মূলত শিক্ষক ঘাটতির জন্যই এ বিষয় দুটিতে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না, তা স্পষ্ট। এ দুই বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করার জন্য প্রাইভেট কোচিংমুখী হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। কিন্তু যেসব শিক্ষার্থীর কোচিংয়ের পেছনে অর্থ ব্যয় করার মতো সামর্থ্য নেই, তারা শিক্ষায় পিছিয়ে পড়ছে। যেটা বেশ উদ্বেগজনক বিষয়। আরো উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, দেশে আইসিটি বিষয়েও দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের অভাব রয়েছে। এক্ষেত্রে দেখা গেছে, মোট ২০ হাজার ২৯৪ সরকারি-বেসরকারি স্কুলের মধ্যে ১৬ হাজার ২৭৫টিতে আইসিটি শিক্ষক রয়েছেন, যা মোট সংখ্যার ৮০ শতাংশ। বাকি ২০ শতাংশ স্কুলে অন্য বিষয়ের শিক্ষকরা আইসিটি বিষয়টি শিক্ষকতা করছেন। বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) ভাষ্য মতে, বর্তমানে সারা দেশে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের শূন্যপদ আছে ৬৮ হাজারের বেশি। দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শূন্যপদের জন্য মোট ৩২ হাজার ৪৩৮ জন নিয়োগের সুপারিশ করেছে এনটিআরসিএ। মূলত শূন্যপদগুলো পূরণ করতে চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়েছিল গত বছরের ১২ ডিসেম্বরে। কিন্তু দেড় লাখের বেশি চাকরিপ্রার্থী আবেদন করলেও প্রায় ৩৬ হাজার শিক্ষক পদে নিয়োগের জন্য কাউকে সুপারিশ করতে পারেনি এনটিআরসিএ। এ অবস্থায় নতুন করে আবারো প্রায় ৩৬ হাজার শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার চাহিদা এখনো রয়ে গেছে। সুপারিশ করতে না পারার কারণ হিসেবে এনটিআরসিএ জানায় মূলত ইংরেজি, আইসিটি, বিজ্ঞান, মাদ্রসার সহকারী মৌলভি এবং নারী কোটার সংরক্ষিত পদে যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ার কারণে ৩৫ হাজার ৭২৯টি পদে কাউকে সুপারিশ করতে পারিনি এনটিআরসি। এছাড়া চাকরিতে আছেন এমন ইনডেক্সধারীরা আবেদন করতে না পারায় বিশালসংখ্যক পদ ফাঁকা রয়ে গেছে। এনটিআরসিএ এসব পদ পূরণ করতে কিছুটা ছাড় দিয়ে বিশেষ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে এমনটাই জানা গেছে। এদিকে শিক্ষক চাকরিপ্রার্থীদের পক্ষ থেকে অভিযোগ এসেছে যে মেধাক্রম ও শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার নম্বরের মাধ্যমে সুপারিশ হওয়ার কথা থাকলেও মেধাতালিকার পেছনে থাকা অনেকেই সুপারিশ পেয়েছেন। এসব ভুল যাচাই করে প্রকৃত মেধাবীদের নিয়োগ দিতে এনটিআরসিএকে স্মারকলিপি দিয়েছে একটি পক্ষ। মূলত শিক্ষক চাকরিপ্রার্থীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ নিয়ে এমন জটিলতা এর আগেও দেখা গেছে কিন্তু সমাধান পাওয়া যায়নি। 

এনটিআরসিএ থেকে আরো জানা যায়, ৬৮ হাজার ১৬৭টি শিক্ষকের শূন্যপদের মধ্যে স্কুল-কলেজ পর্যায়ে ৩১ হাজার ৫০৮ জন এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানে ৩৬ হাজার ৮৮২টি শূন্য পদ রয়ে গেছে। ১ থেকে ১৬তম শিক্ষক নিবন্ধনে পাস করা সর্বোচ্চ ৩৫ বছরধারীরা এ নিয়োগের জন্য আবেদন করতে পারেন। এনটিআরসিএর হিসাবে, এখন পর্যন্ত ১৬টি নিবন্ধন পরীক্ষায় পাসকৃত প্রার্থীদের মধ্যে ২ লাখ ৪৮ হাজার ৭৪৮ জন চাকরি পাওয়ার যোগ্য। সংস্থাটির প্রাথমিক হিসাবে, এখন পর্যন্ত এক লাখ প্রার্থী চাকরি পেয়েছেন এবং তারা একটি পারসোনাল আইডেনটিফিকেশন নম্বর (ইনডেক্স) পেয়েছেন। সেগুলো ব্লক করে রাখায় ফ্রেশার (নতুন) হিসেবে চাকরির আবেদন করলেও রোল নম্বর একই হওয়ায় ভালো নম্বর এবং মেধাতালিকায় এগিয়ে থেকেও চাকরির সুপারিশ পাননি তারা। 

তবে এতকিছুর মধ্যে চিন্তার জায়গা হলো, কোনো এক অজানা কারণে চাকরির জন্য প্রার্থীদের আলাদাভাবে একাধিক প্রতিষ্ঠানে আবেদন করতে হয়। এক্ষেত্রে যদিও সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে তারা একবার আবেদন করবেন, সেই আবেদনের ভিত্তিতে একটা তালিকা করে রাখা হবে এবং যখন যেখানে কাজের জন্য কর্ম পদ ফাঁকা হবে তখন সেখানে এ তালিকা থেকে একজন করে নিয়োগ দেয়া হবে। কম্পিউটার প্রযুক্তির এই ডিজিটাল যুগে যেখানে সবার এনআইডি আছে সেখানে এই কাজটি কেন করা হচ্ছে না তার উত্তর জানা নেই আমাদের। সব প্রার্থীকে ৪০টির মতো স্কুলে আবেদন করতে হয়, যে কারণে অনেক শিক্ষক চাকরিপ্রার্থীরা চাকরির জন্য একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবেদন করেন, প্রতিটি আবেদনের জন্য একাধিকবার টাকা খরচ করতে হয়। এভাবে প্রার্থীদের কত অতিরিক্ত টাকা খরচ সেটার হিসাব সেই চাকরিপ্রার্থী ছাড়া কেউ রাখেন না। 

শিক্ষা যখন জাতির জন্য মেরুদণ্ড তখন শিক্ষার সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষকের গুরুত্ব যে অপরিসীম তা বলা বাহুল্য। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতার পেছনে চারটি বড় কারণ চিহ্নিত করেছে। সেগুলো হলো—শৈশব জীবনের মানোন্নয়নে কর্মসূচিগুলোর দুর্বলতা, নিম্নমানের পাঠদান, দুর্বল স্কুল ব্যবস্থাপনা এবং শিক্ষা খাতে সরকারি বিনিয়োগ কম। এ চিহ্নিত অংশগুলোয় কাজ করে যেতে পারলে শিক্ষা ব্যবস্থায় কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে। এছাড়া দক্ষ শ্রমশক্তি গড়ে তুলতে শিক্ষার মানের দিকে নজর দেয়ার ক্ষেত্রে এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল মানসম্মত শিক্ষার মূল উপাদান হিসেবে মানসম্মত শিক্ষক, মানসম্মত শিক্ষা উপকরণ ও মানসম্মত পরিবেশ নির্ধারণ করেছে। তাই আমাদের উচিত হবে আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে যত জলদি সম্ভব শিক্ষক নিয়োগ বাড়ানো এবং বর্তমান প্রক্রিয়ার বিদ্যমান জটিলতাগুলোকে চিহ্নিত করে নিরসন পন্থা অবলম্বন করা।

মো. আবিদ মঈন খান: সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন