গবেষণায় নকল করলে চাকরিচ্যুতি, পদাবনতি, বাতিল হবে ডিগ্রি

সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্ল্যাজারিজম প্রিভেনশন রুলস করা হোক

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় গবেষণায় চুরি (প্ল্যাজারিজম) কাণ্ড দিন দিন বাড়ছে। শিক্ষকের এহেন চৌর্যবৃত্তিতে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো লজ্জার আধারে নিমজ্জিত হচ্ছে। উপরন্তু গবেষণার জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেও এর ফল হচ্ছে শূন্য, ক্ষেত্রবিশেষে পড়ছে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব। এমন প্রেক্ষাপটে গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি বা নকল রোধে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রস্তাবিত রুলস অনুযায়ী. গবেষণায় নকলের অভিযোগ প্রমাণিত হলে দায়ী ব্যক্তিকে শুরুতে জরিমানা সাপেক্ষে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট পাণ্ডুলিপি সংশোধনের সুযোগ দেয়া হবে। তা প্রতিপালনে ব্যর্থ হলে গবেষণায় নকলের মাত্রা অনুযায়ী চাকরিচ্যুতি, পদাবনতি ডিগ্রি বাতিলসহ বিভিন্ন ধরনের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। নীতিমালা প্রণয়ন শাস্তির বিধান ইতিবাচক। দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বার্ষিক বাজেটে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্ল্যাজারিজম চেকার সাবস্ক্রিপশন চৌর্যবৃত্তি বন্ধে রুলস থাকা বাধ্যতামূলক করা উচিত। যেসব সফটওয়্যার বিশ্বের অধিকাংশ মানধারী সাময়িকী তাদের প্রকাশনায় ব্যবহার করছে, গ্রহণযোগ্য সেসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষার্থী শিক্ষকেরা অনায়াসে অন্যের লেখা চুরি ঠেকাতে সক্ষম হবেন। শুধু তাই নয়, মাস্টার্স পিএইচডির থিসিস চূড়ান্ত করার আগে এসব সফটওয়্যারে চেকিং বাধ্যতামূলক করা উচিত। দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় এমন নীতিমালা বাস্তবায়নে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনকে সক্রিয় হতে হবে।

বাংলাদেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা প্রবন্ধের চৌর্যবৃত্তি ঠেকানোর জন্য ব্যবহূত প্রযুক্তির সাহায্য নেয়া হলে অনেক গবেষণাই জালিয়াতির দায়ে অভিযুক্ত হবে। বিষয়টিকে উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে, গবেষণায় অসদুপায় অবলম্বনের কারণে বহু শিক্ষক স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত হবেন; এমনকি গবেষণায় ব্যবহূত পাবলিক ফান্ডের অপব্যবহারের দায়ে ফৌজদারি অপরাধে জেল জরিমানার সম্মুখীন হবেন। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এসব চৌর্যবৃত্তির ঘটনা নতুন নয়, কয়েক দশক ধরে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ধরনের খবর প্রকাশ হচ্ছে। গঠনগতভাবে গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি যদি ব্যাখ্যা করতে বলা হয়, তাহলে দেখা যাবে, অন্যের ধারণা নিজের নামে চালিয়ে দেয়া থেকে শুরু করে প্রবন্ধে ব্যবহূত অন্যের প্রকাশিত গবেষণার তথ্যের প্রাপ্তিস্বীকার বা সাইটেশন না করা, ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে কপি পেস্ট, প্যারা এদিক-সেদিক করে কিংবা প্রকাশিত কোনো গবেষণার চিত্র, ভিডিও ডাটা ব্যবহার করে যেকোনো ধরনের গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশনা চৌর্যবৃত্তির মধ্যে পড়ে। এমনও ঘটনা ঘটছে, শিক্ষকেরা কোনো গবেষণায় অবদান না রাখা সত্ত্বেও কেবল ব্যক্তিগত সম্পর্কের জায়গায় থেকে সহলেখক হিসেবে প্রকাশনায় নাম চলে আসছে, যা মৌলিক গবেষণায় নীতিবিরোধী। এছাড়া অনেক সময় অর্থলগ্নি করেও গবেষণাপত্রে নাম প্রকাশের মহোৎসব দেখা যায়। শুধু তাই নয়, শিক্ষকদের এসব প্রকাশনার সবচেয়ে বড় অবদান রাখেন মাস্টার্স পর্যায়ের থিসিস শিক্ষার্থীরা। অনেক সময় এসব শিক্ষার্থী থিসিস শেষ করে বিভাগ ছাড়লেও পরবর্তী সময়ে ওই গবেষণার ফল তার সুপারভাইজার তাকে অথরশিপ থেকে দূরে রেখে প্রকাশ করছেন, যা একটি মারাত্মক একাডেমিক অপরাধ।

একটা সময় ছিল যখন গবেষণা প্রকাশিত হতো কাগজের সংস্করণে এবং সে সময়ে গুগলের মতো সার্চ ইঞ্জিনও ছিল না, কারণে অনেক সময় দেখা যেত, এসব কাগুজে সাময়িকীর বাক্য হুবহু মেরে দেয়া যেত কিংবা আইডিয়াও ক্লোন করা সম্ভব হতো, যা দেখার কেউ ছিল না। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে গবেষণায় এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। ফলে মৌলিক গবেষণা প্রকাশ করার আগে প্রযুক্তির সহায়তায় আমরা অনায়াসে সেটি ধরতে পারি। এমনকি গবেষণা শুরুর আগে নিজের লব্ধ আইডিয়ার যাচাই-বাছাইয়ের জন্য পূর্ববর্তী গবেষণা নিবন্ধের বাছাই করা সম্ভব হয়েছে। ফলে এখন অন্যের গবেষণার তথ্যকে প্রাপ্তিস্বীকার না করে নিজের নামে চালিয়ে দিলেই চৌর্যবৃত্তি ঠেকানোর সফটওয়্যার তা জানিয়ে দেবে। নকল দেখার জন্য ব্যবহূত সফটওয়্যারগুলো অর্থ দিয়ে কেনা ছাড়াও কিছু বিনামূল্যের সফটওয়্যারও পাওয়া যায়। দুঃখজনক বিষয় হলো, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যাদের হাতে নিয়ন্ত্রিত, সেই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) এখন পর্যন্ত গবেষণায় অসদুপায় অবলম্বনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান কী হতে পারে, তা সুস্পষ্ট করছে না। কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও একাডেমিক পর্যায়ে জঘন্য অপরাধের শাস্তি প্রদানে ব্যর্থ হচ্ছে। কারণ, আমাদের শীর্ষ চার বিশ্ববিদ্যালয় যে আইনে পরিচালিত হয়, সেই ৭৩ অধ্যাদেশের ৫৬() ধারায় একজন শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করার আইনে বলা হয়েছে, কেবল নৈতিক স্খলন কিংবা অদক্ষতার কারণে উপযুক্ত তদন্ত কমিটির তদন্তের প্রমাণ সাপেক্ষে শাস্তি প্রদান করা যেতে পারে। কারণে একাডেমিক পর্যায়ে সবচেয়ে বড় অপরাধ করেও পদাবনতি মাথায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিতে পারছেন। পুরনো অধ্যাদেশের হালনাগাদ করা যে কতটা জরুরি হয়ে পড়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা থিসিসের স্বচ্ছতা ফেরাতে নীতিনির্ধারকদের সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গবেষণাগারে যোগদানের পর পরই বাধ্যতামূলক গবেষণার এথিকস কোর্স করানো হয়। বলা হয়ে থাকে, এসব গবেষণার নৈতিকতার মানদণ্ডের মধ্য থেকে গবেষণা করতে হবে। গবেষণা করতে গেলে ঠিক কোন দিকগুলোর প্রতি আপনাকে তীক্ষ নজর রাখতে হবে, তাও শেখানো হয়। নিরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন, ফান্ড অপব্যবহার, প্রবন্ধ চৌর্যবৃত্তির প্রতিটি ধাপ শেখানো হবে। প্রয়োজনে এসব প্রশিক্ষণ থেকে কুইজ প্রশ্নে লব্ধ জ্ঞান যাচাই করা হবে। ঠিক একই নিয়মের আদলে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোয় গবেষণা শুরুতেই ধরনের কোর্স থাকা বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। শিক্ষা কার্যক্রম, বিশেষ করে স্নাতক পর্যায়ের প্রতিটি বর্ষে রিসার্চ এথিকস শাস্তি নামক একটি শর্ট কোর্স রাখা যেতে পারে, যাতে শিক্ষার্থীরা নিজেদের অ্যাসাইনমেন্ট লেখা থেকে শুরু করে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে গবেষণার থিসিস লেখায় চৌর্যবৃত্তি সম্পর্কে সতর্ক হতে পারে। অভিযোগ রয়েছে, দেশের অনেক উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মনীতি ছাড়াই এমফিল, এমনকি পিএইচডি পর্যায়ের গবেষক ভর্তি করা হয়। অনেক ক্ষেত্রেই গবেষণাকর্ম সঠিকভাবে যাচাই করা হয় না। ফলে অন্যের গবেষণা থেকে তথ্য বা জ্ঞান চুরি করে সহজে পার পাওয়া যায়। কারণে একশ্রেণীর গবেষক অন্যের গবেষণা থেকে তথ্য-উপাত্ত নিয়ে নিজের গবেষণাকর্মে জুড়ে দিয়ে ডিগ্রি লুফে নিচ্ছেন। আর ডিগ্রির বদৌলতে তারা পদোন্নতিসহ পেশাগত সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে যাচ্ছেন।

কয়েক বছর আগে জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষক বিজ্ঞান সাময়িকী নেচারের কয়েকটি প্রকাশনায় ডাটা ম্যানিপুলেট করার দায়ে অভিযুক্ত হন। পরবর্তী সময়ে সেই শিক্ষককে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাকরিচ্যুত করে, তার জন্য গবেষণায় বরাদ্দকৃত অর্থ ফেরত নেয়, এমনকি তাকে জেলে যেতে হয়। সারা বিশ্বেই একাডেমিক এসব সূক্ষ্ম চৌর্যবৃত্তিকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে দেখা হয়। আমাদের দেশে যেটিকে লঘুদণ্ড হিসেবে মনে করা হচ্ছে, সেটি যে গুরুদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার যোগ্য, সে বিষয়ে আমাদের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে টনক নড়তে হবে। রাষ্ট্র প্রয়োজন পড়লে আইনপ্রণেতাদের মাধ্যমে একাডেমিক অপরাধের একটি আইন প্রণয়ন করতে পারে। ইউজিসি সেখানে গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা হিসেবে কাজ করতে পারে। মনে রাখতে হবে, শিক্ষা গবেষণায় অনিয়ম ঠেকাতে ব্যর্থ হলে দেশের অনিয়ম দুর্নীতি ঠেকানো সম্ভব নয়। তাই একাডেমিক অপরাধকে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করা সময়ের দাবি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একাডেমিক গবেষণা দেখভালের জন্য একটি কার্যকর কমিটি তৈরি করে দিতে পারে। সে কমিটির কাজ হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রণয়নকৃত একাডেমিক গবেষণার মানদণ্ডের নিরিখে গবেষণা সম্পন্ন হচ্ছে কিনা, তা পর্যালোচনা করা। কুম্ভিলতা ঠেকানো ছাড়াও কমিটি গবেষণার বরাদ্দ থেকে শুরু করে একাডেমিক ফান্ডের স্বচ্ছ ব্যবহার নিশ্চিত করুক। নৈতিক মৌলিক গবেষণায় একাডেমিশিয়ানদের আগ্রহের জায়গা তৈরি করুক। শিক্ষকেরা যেন কেবল পদোন্নতির নেশায় গবেষণায় নিয়োজিত না থেকে দেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে মনোনিবেশ করেন, সেই বিষয়ে উৎসাহ প্রদান করা। গবেষণাকর্ম পরীক্ষার বাধ্যবাধকতা না থাকা, গবেষকের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা, যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা না থাকা, চৌর্যবৃত্তি করেও ধরা না পড়া ইত্যাদি কারণে গবেষণা চুরির ঘটনা ঘটছে। এছাড়া তদারকি, সদিচ্ছা জবাবদিহিতার ঘাটতিও গবেষণা চৌর্যবৃত্তির অন্যতম কারণ। গবেষণায় তথ্য চুরি ধরার দায়িত্ব মূলত তত্ত্বাবধায়কসহ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। অন্যের গবেষণা থেকে তথ্য-উপাত্ত নেয়ার নিয়ম আছে। গবেষণায় একনাগাড়ে সর্বোচ্চ ২৫ শব্দ বা চার-পাঁচ বাক্য ব্যবহার করা যায়। এজন্য তথ্যসূত্র উল্লেখ করতে হয়। অন্যদিকে ভার্চুয়াল দুনিয়ায় সবকিছুই হাতের নাগালে থাকায় গবেষকরা খুব সহজেই ইন্টারনেট থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে পারেন। উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনে চৌর্যবৃত্তি রোধে কঠোর নীতিমালা থাকা প্রয়োজন।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণার বার্ষিক বাজেট খুবই কম। এসব বরাদ্দে গবেষণা হয় না, হওয়ার কথাও নয়। স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের থিসিসে যে বাজেট থাকে, তা দিয়ে কখনোই মানসম্মত গবেষণা হতে পারে না। অবিলম্বে একাডেমিকভাবে গবেষণায় নকল অনৈতিক প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে দ্রুততর সময়ে কেন্দ্রীয়ভাবে নীতিমালা তৈরি করা, যা অনুসরণ করবে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়। আর তা বাস্তবায়নের মধ্যে এগিয়ে যেতে পারে আমাদের মৌলিক গবেষণা। প্রকাশনার সংখ্যার দিকে না তাকিয়ে কোয়ালিটি অব পাবলিকেশন থাকা জরুরি। প্রত্যাশা করি, অচিরেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিংবা মঞ্জুরী কমিশন এসব নীতি প্রণয়নে এগিয়ে আসবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন