ব্যাংক খাতে সক্ষমতা বাড়াতে গভর্নরের তাগিদ

মধ্যম আয়ের দেশের উপযোগী টেকসই ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা হোক

সম্প্রতি বিআইবিএমের এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির ব্যাংক খাতের সক্ষমতা বাড়ানো অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। তার মন্তব্য বিশেষ তাত্পর্যপূর্ণ। বিশ্বব্যাপী ব্যাংক খাতে চলছে রূপান্তর। নিত্যনতুন অনেক কিছু সংযোজন হচ্ছে। সঙ্গে বাড়ছে নানা ঝুঁকিও। দ্রুত বদলে যাওয়া ইকোসিস্টেমে দেশের ব্যাংক খাতের স্থায়িত্বশীলতা নির্ভর করছে সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর। কাজেই গভর্নরের মন্তব্য আমলে নিয়ে কর্তৃপক্ষের কার্যকর উদ্যোগ জরুরি।

গত পাঁচ দশকে দেশের ব্যাংক খাতের কলেবর বেড়েছে। অনুমোদন পাচ্ছে নতুন নতুন ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, বর্তমানে ৬১টি বাণিজ্যিক ব্যাংক দেশে কার্যরত। দেশের জিডিপির আকার এখন ৪১৬ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু অর্থনীতির আকার বিবেচনায় সংখ্যাটা বেশি হলেও ব্যাংক খাতের সক্ষমতায় তেমন উন্নতি নেই। গুটিকয়েক বাদে অনেক ব্যাংকই ভুগছে দক্ষ জনবল ঘাটতিতে। সময়ে সময়ে লোকবল নিয়োগ দেয়া হলেও অনেক ক্ষেত্রে মিলছে না চৌকস কর্মী। ব্যাংকের সেবা কার্যক্রমের গতিশীলতায় এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। আবার ব্যাংকিং প্রডাক্টেও নেই তেমন বৈচিত্র্য। গতানুগতিক ঋণ আমানত পণ্যের মধ্যে বেশির ভাগ ব্যাংকের কার্যক্রম সীমিত। ফলে অনেক ব্যাংক হলেও তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা নেই বললেই চলে। মোটামুটি একই ধরনের সেবা দিয়ে চলছে সবাই। ঘাটতি আছে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায়ও। ব্যাংক সাধারণত জনগণের আমানত সঞ্চয়ের জিম্মাদার। সুতরাং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ব্যাংকের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। দেশে ২০০৩ সাল থেকে সব ব্যাংকে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। অথচ এখন পর্যন্ত বিভাগটি পুরোপুরি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। পদে পদে পরিচালনা পর্ষদের হস্তক্ষেপ। কারণে দিনের পর দিন বাড়ছে খেলাপি ঋণ, মূলধন ঘাটতি এবং অ্যাডভান্স ডিপোজিট রেশিও (এডিআর) বা ঋণসীমা লঙ্ঘনের মতো ঘটনা। একইভাবে দুর্বলতা আছে অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ পরিচালনায়ও। অনেক ব্যাংক শুধু শাখা বাড়ানো বা নিজস্ব জমি কেনার দিকেই মনোযোগী। এতে পরিচালন ব্যয় বাড়ছে ঠিকই, ব্যবস্থাপনায় উন্নতি ঘটছে না। সাম্প্রতিক সময়ে প্রযুক্তিগত বড় উল্লম্ফন ঘটেছে। কিছু ব্যাংক বিনিয়োগ বাড়িয়ে প্রযুক্তি ক্ষেত্রে এগোলেও অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান বেশ পিছিয়ে। সব মিলিয়ে দেশের ব্যাংক খাতের সক্ষমতা আশাব্যঞ্জক নয়।

বর্তমান বিশ্বায়িত দুনিয়ায় বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা পারস্পরিকভাবে আন্তঃসংযুক্ত। এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ ব্যাংক। বিভিন্ন দেশের ব্যাংকগুলো নিজস্ব সক্ষমতায় একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে। যেমন যুক্তরাজ্যে বার্কলেস, এইচএসবিসির মতো কিছু ব্যাংক ভালো করছে। যুক্তরাষ্ট্রে বেশি নৈপুণ্য দেখাচ্ছে জেপি মরগান গোল্ডম্যান স্যাকসের মতো ব্যাংক। সুইজারল্যান্ডে নাম করছে সুইস ক্রেডিট কিংবা জুলিয়াস বেয়ার ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান। প্রতিবেশী ভারতে নৈপুণ্যের ওপরের দিকে রয়েছে আইসিসিআইসি এইচডিএইসি ব্যাংক। উল্লিখিত ব্যাংকগুলোর সাফল্যের মূল কারণ দক্ষ জনবল, প্রযুক্তিগত স্থায়িত্বশীলতা, টেকসই ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, সুদক্ষ অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, সময়োপযোগী নীতি কাঠামো, পণ্যবৈচিত্র্য, পেশাদারি গ্রাহকসেবা নিশ্চিতসহ সার্বিক সক্ষমতার উন্নয়ন। বৈশ্বিক কর্মপ্রক্রিয়া অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য শিক্ষণীয়। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উদীয়মান অর্থনীতিতে জিডিপির প্রবৃদ্ধির চেয়ে ব্যাংকের সম্পদ প্রবৃদ্ধি হয় অনেক বেশি। এক দশকের বেশি সময় ধরে জিডিপির উচ্চ প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। কিন্তু সময়ে জিডিপির প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেশের ব্যাংক খাতের সম্পদ বড় হতে পারেনি। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য বলছে, দেশের ব্যাংক অ্যাসেট টু নমিনাল জিডিপি রেশিও বা জিডিপি-ব্যাংক সম্পদের অনুপাত ২০২১ সালে ৬১ শতাংশে নেমে এসেছে। শুধু জিডিপি-ব্যাংক সম্পদের অনুপাতই নয়, বরং গত কয়েক বছরে ব্যাংক খাতে রিটার্ন অন অ্যাসেট (আরওএ) বা সম্পদের বিপরীতে আয় ধারাবাহিকভাবে কমে যাচ্ছে। দেশের ব্যাংক খাতের সম্পদ বা ঋণের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ অনুৎপাদনশীল। খেলাপি হয়ে পড়া সম্পদ থেকে রিটার্ন পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোসহ বেসরকারি খাতের অনেক ব্যাংকের অবস্থাই নাজুক। এটা দেশের ব্যাংক খাতের সক্ষমতা ঘাটতির বিষয়টিই তুলে ধরে।

অনেকেই ব্যাংকিং নীতি কাঠামো সংস্কারের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে কিন্তু ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরীণ সংস্কার, পরিবর্তন সক্ষমতা বৃদ্ধি কতটা জরুরি, সে বিষয়টি আলোচনায় কম আসছে। সক্ষমতা বাড়ানোর পদবন্ধটি আবার শুধু জনবলের দক্ষতা বৃদ্ধির মধ্যেই সীমিত। স্বভাবত কর্মীদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য ব্যাংকগুলো নানা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে। বিআইবিএমের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোও বিভিন্ন সার্টিফিকেশন কোর্স চালু করেছে। এসব কোর্স সম্পন্ন করে অনেকেই নিজেদের দক্ষতা বাড়াতে সমর্থ হচ্ছে। তবে এটিই সব নয়। সক্ষমতার আরো মাত্রা আছে। এখনো অনেক ব্যাংক গতানুগতিক ব্যাংকিং প্রডাক্টের মধ্যেই আবদ্ধ। ওই সীমিত পণ্যের মধ্যেই একে অন্যের সঙ্গে ব্যাংকগুলো প্রতিযোগিতা করছে, যা গ্রাহক আকর্ষণে সমর্থ হচ্ছে না। ফলে অনেকেই এখনো ব্যাংকিং সেবার বাইরে রয়েছে। ব্যাংকিং সেবায় আনতে হলে তাদের উপযোগী প্রডাক্ট ডিজাইন করা প্রয়োজন। পণ্য বহুমুখীকরণে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এখনো অনেক ব্যাংক প্রযুক্তি ব্যবহারে পিছিয়ে। প্রযুক্তি ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে সিস্টেম হ্যাকসহ নানাভাবে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার প্রবণতাও বাড়ছে। এটি বন্ধে নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নতকরণে বিনিয়োগ বাড়াতে ব্যাংকগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বিদ্যমান নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বজনপ্রীতির অভিযোগ আছে। পদোন্নতির ক্ষেত্রেও নানা অসংগতি বিদ্যমান। দক্ষ ব্যাংকারদের প্রেষণা ধরে রাখতে এগুলো দূর করতে হবে।

দেশের অর্থনীতি নতুন ধাপে উন্নীত হতে যাচ্ছে, রূপান্তর ঘটছে বিপুল মাত্রায়। ব্যাংকিং ব্যবস্থাকেও এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে রূপান্তর ঘটাতে হবে। বাংলাদেশ অচিরেই মধ্যম আয়ের দেশ হবে। প্রেক্ষাপটে গভর্নর যে ব্যাংক খাতে সক্ষমতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন, তা যথাযথ। এটাকে গুরুত্ব দিতে হবে। সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের জোরালো প্রচেষ্টায় শক্তিশালী, টেকসই, সুপরিচালিত সুদক্ষ ব্যাংকিং ব্যবস্থা দেশে গড়ে উঠবে, এমনটাই প্রত্যাশা।  

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন