মত-দ্বিমত

বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতিতে র‍্যাগিং কি আবশ্যক?

আকাশচুম্বী স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে পদার্পণ করেন  শিক্ষার্থীরা। তাদের ওপর চালানো হয় শারীরিক মানসিক নির্যাতন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন র‍্যাগিং বন্ধে পদক্ষেপ নিলেও পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতিতে র‍্যাগিং আবশ্যক কিনা, সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মত তুলে ধরেছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী মো. মমিনুর রহমান


সুন্দর ভবিষ্যতের প্রত্যয়ে র‍্যাগিং হোক অন্যতম মাধ্যম

 

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা অনুযায়ী মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে শিক্ষার্থীরা নিজস্ব মেধা, মনন ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দুয়ারে পা রাখেন। যখনই তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন পরিবেশে আবর্তিত হন, তখন থেকে তারা নিজেরাই নিজেদের সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো সক্ষমতা অর্জন করেছেন ধরে নেয়া হয়। ঠিক মুহূর্তে তাদের জন্য দরকার হয় ঢালস্বরূপ সিনিয়রদের সাপোর্ট, সাহায্য, পরামর্শ বন্ধুসুলভ আচরণ। ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ্য রস আহরণ করে নিজেদের পরিচয় গড়ার লক্ষ্যে সিনিয়রদের গাইডলাইন বা রোলমডেলের ভূমিকা অগ্রগণ্য। উল্লেখ্য, প্রায়ই শোনা যায় নবাগতদের ওপর নানা অত্যাচার, নির‍্যাতনের ঘটনা, এমনকি অশালীন কাজে বাধ্য করা হয়। যেটাকে আমরা র‍্যাগিং বলি। র‍্যাগিং বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সংস্কৃতি, যা বর্তমানে নেতিবাচকভাবে ব্যবহার হচ্ছে। যদিও প্রাথমিকভাবে র‍্যাগিং বা র‍্যাগ শব্দদ্বয়ের অর্থ হলো আনন্দ, উল্লাস করা। আসুন এই আনন্দ, উল্লাসের নেতিবাচক চর্চা বাদ দিয়ে নবাগতদের তাদের নতুন জীবন সাজানোর রাস্তা দেখাই।

 মো. আলমগীর হোসেন: সিনিয়র প্রভাষক, কম্পিউটার বিজ্ঞান প্রকৌশল বিভাগ, প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা




র‍্যাগিংয়ের ভয়াবহতা নয়, প্রয়োজন এর সুষ্ঠু পরিবেশ

 

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে র‍্যাগিং এমন এক ভাইরাস, যা নতুন শিক্ষার্থীদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়। র‍্যাগিংয়ের নামে শারীরিক মানসিক  নির‍্যাতন বাধাগ্রস্ত করে নতুন শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। র‍্যাগিংয়ের ভিন্ন অর্থ রয়েছে, যেমন ছিন্নবস্ত্র, পরিচয় পর্ব ইত্যাদি। তবে এখন এটা গবেষণার বিষয় যে বাংলাদেশে কোন অর্থে এটি ব্যবহূত হয়ে র‍্যাগিংয়ের মতো অপসংস্কৃতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করেছে। র‍্যাগিংয়ের কারণে অনেক শিক্ষার্থী পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছেন, দীর্ঘমেয়াদি মানসিক রোগে ভুগছেন, ক্লাসে অমনোযোগী থাকছেন, মাদকে জড়িয়ে পড়েছেন। র‍্যাগিং নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি হচ্ছে কিন্তু এর ব্যাপকতা ভয়াবহতা কমছে না, কারণ এর দায়ভার কেউ নিতে রাজি না বা এড়িয়ে যাচ্ছে সুকৌশলে। র‍্যাগিংয়ের ব্যাপকতা দেখে মহামান্য হাইকোর্ট প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়কে অ্যান্টি-র‍্যাগিং কমিটি গঠনের নির্দেশনা দিয়েছেন, যা প্রশংসনীয়। র‍্যাগিংয়ের মতো অপসংস্কৃতির প্রয়োজনীয়তা বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় আগেও ছিল না এবং বর্তমানেও নেই।

 মো. জহির উদ্দিন: প্রভাষক, জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

 



র‍্যাগিংমুক্ত ক্যাম্পাস হোক

 মুক্ত জ্ঞান, চিন্তা গবেষণার জন্য শিক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। তবে তাদের শৈশব মিশ্রিত সংস্কৃতি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতিতে এসে নিজেদের খাপ খাওয়াতে একটু সময় লাগে। আর ঠিক তখনই তাদের সম্মুখীন হতে হয় র‍্যাগিং শব্দের সঙ্গে। র‍্যাগ বা র‍্যাগিং শব্দের অর্থ হইহুল্লোড় হলেও বর্তমানে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শব্দটি নেতিবাচক দৃষ্টিতে বেশ পরিচিত। ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণে যেমন সিনিয়র-জুনিয়রের সখ্য দেখা যায়, তেমনি র‍্যাগিংয়ের চর্চা দেখা যায়। সিনিয়রদের দ্বারা তৈরি র‍্যাগিং নবাগত তরুণ শিক্ষার্থীদের কোমল মনে এক ধরনের ভয় বা ত্রাসের জন্ম দেয়। ম্যানার শেখানোর নামে তারা নানান রকম বুলিং, ভার্বাল অ্যাবিউজের শিকার হন; যা একেবারেই কাম্য নয়। র‍্যাগিং জিনিসটা শুধু শারীরিক নির‍্যাতনই নয়, পাশাপাশি মানসিক নির‍্যাতনও বটে। বর্তমানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন সজাগ দৃষ্টির সঙ্গে কঠোর আইন পাসের মধ্যে অপসংস্কৃতি দমনের চেষ্টা করছে। আবার অনেক জায়গায় রয়েছে র‍্যাগিং দমনে নীরব ভূমিকা। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় ভিকটিম নিজেই বিষয়টি অগোচরে রাখেন। এসব বিষয়ের যথাযথ চিত্র খুঁজে বের করে র‍্যাগিংমুক্ত স্বাধীনচেতা ক্যাম্পাস গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।

 জেমিমা জাহান মিম: প্রভাষক, পরিবেশ উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

 


অপসংস্কৃতি র‍্যাগিং নিষিদ্ধ হোক

 

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের সংস্কৃতির সঙ্গে র‍্যাগিং শব্দটি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। তা না হলে আজ হয়তো আমাদের মাঝে বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ বেঁচে থাকতেন। ইউরোপীয়রা সর্বপ্রথম র‍্যাগিং সম্পর্কে ধারণা দেয়। তাদের কাছে র‍্যাগিং বা র‍্যাগ ডে ছিল বিশেষ আনন্দঘন একটি দিন। ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় র‍্যাগিং ইতিবাচক অর্থে ব্যবহার হলেও বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতিতে র‍্যাগিং একটি নেতিবাচক ধারণা। নবাগত তরুণ শিক্ষার্থীদের মাঝে ভয় ত্রাস সৃষ্টির জন্য প্রবীণ শিক্ষার্থীরা র‍্যাগিংয়ের চর্চা করেন। কিন্তু ভয় ত্রাস কখনো কখনো নবীন শিক্ষার্থীদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় আবার কখনো মানসিক সমস্যার জন্ম দেয়। অথবা কখনো তাজা এবং তরুণ শিক্ষার্থীদের আকাশচুম্বী স্বপ্ন চুরমার করে দেয়। গণতান্ত্রিক দেশে এমন কোনো এখতিয়ার বা শক্তি নেই কারোর স্বপ্নে আগুন জ্বালানোর। তবুও এই গণতান্ত্রিক দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠগুলোতেই রকম অগণতান্ত্রিক অপসংস্কৃতির চর্চা হচ্ছে। তাই কর্তৃপক্ষের কাছে র‍্যাগিং নামের ভাইরাস থেকে তরুণ শিক্ষার্থীদের মুক্তির লক্ষ্যে আকুল আবেদন জানাচ্ছি।

 

ফারহানা ইয়াসমিন: শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

 


র‍্যাগিং নয়, সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ আবশ্যক

 

বিশ্ববিদ্যালয় একজন শিক্ষার্থীর নিজেকে প্রকাশ করার মুক্তমঞ্চ। সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জনের  পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় শেখায় সততা, মূল্যবোধ, মনুষ্যত্ববোধের মতো গুণাবলি; যা পরবর্তী সময়ে একজন শিক্ষার্থীকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে। বিশ্ববিদ্যালয়জীবন এজন্যই অনন্য। আর সেই মুক্তমঞ্চকে কলুষিত করার আরেক নাম র‍্যাগিং। এটি এমন এক পরিচিত পর্ব, যেখানে সিনিয়র শিক্ষার্থী দ্বারা নবীন শিক্ষার্থী  শারীরিক মানসিকভাবে হয়রানি হন। ফলে নবীনরা এতদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে যেসব রঙিন স্বপ্ন এঁকেছিলেন, সেই লালিত স্বপ্ন প্রেতাত্মায় পরিণত হয়। যে মুক্তমঞ্চে তারা নিজেদের বাধাহীনভাবে প্রকাশ করতে এসেছিলেন, সেখানেই বন্দি হতে হয় মানসিক দাসত্বের কারাগারে। যে মুক্তমঞ্চ একজন শিক্ষার্থীকে পরিপূর্ণ মানুষ হতে শেখায়, সেখানে র‍্যাগিংয়ের মতো অপসংস্কৃতি কখনই কাম্য নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে নবীন প্রবীণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সম্পর্ক হোক ভালোবাসা-মমতাময় সৌহার্দপূর্ণ। সবার দায়িত্বশীলতা, সৌহার্দপূর্ণ আচরণ, শ্রদ্ধা ভালোবাসার পারস্পরিক সম্পর্কের মাধ্যমে র‍্যাগিংয়ের নামে নবীনদের স্বপ্নের মৃত্যু রোধ হোক অপসংস্কৃতি বন্ধ হোক, এটাই সবার কাম্য।

 তমালিকা রায়: শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

 

র‍্যাগিংয়ের নামে মানসিক নির্যাতন বন্ধ করতে হবে

 

র‍্যাগিং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে সুপরিচিত টার্ম। প্রথম বর্ষের একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে প্রথম যে শব্দটির সঙ্গে পরিচিত হন, সেটা হচ্ছে র‍্যাগিং। র‍্যাগিং সম্পর্কে তথাকথিত অভিমত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র কর্তৃক জুনিয়রকে শিক্ষা দেয়া। কখনো কখনো এই তথাকথিত শিক্ষা দেয়া একজন শিক্ষার্থীকে মানসিক শারীরিকভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত করে। সিনিয়ররা যেটাকে মজা হিসেবে নেন, জুনিয়রদের জন্য সেটা অনেক বড় ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। যে ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা প্রথম বর্ষের কোমলমতি শিক্ষার্থীর পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। র‍্যাগিংয়ের পাশাপাশি বর্তমানে শিক্ষার্থীদের কাছে আরেক আতঙ্কের নাম গেস্টরুম নির‍্যাতন। গেস্টরুম শব্দটি শুনতে সুন্দর শোনালেও মূলত এখানে বড় ভাইদের কর্তৃক ছোট ভাইদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার পদ্ধতি প্রচলিত হয়ে আসছে। গেস্টরুম নির্যাতনের কারণে শিক্ষার্থীকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার ইতিহাস রচিত হয়েছে। যেটা একদম অনাকাঙ্ক্ষিত। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী বিভিন্ন জ্ঞান অর্জন করে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে চান। কিন্তু তথাকথিত র‍্যাগিং গেস্টরুম পদ্ধতি শিক্ষার্থীর মেধা বিকাশে বাধা দেয়। অনতিবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথা বন্ধ করা জরুরি।

 

মানছুর আল ফারাবী: শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন