আর্থিক খাতে ব্যাংকবহির্ভূত প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ যৎসামান্য

সরকারকে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে

বাংলাদেশের জিডিপির আকার ৪০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। সে তুলনায় অর্থনীতিতে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) অংশগ্রহণ যৎসামান্য। অথচ বিশ্বের আর্থিক কর্মকাণ্ডের ৫০ শতাংশই পরিচালিত হচ্ছে খাতের মাধ্যমে। সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে খাতটি যথাযথ অবদান রাখতে না পারার পেছনে বিশেষজ্ঞরা তহবিল সংগ্রহের উৎসের সীমাবদ্ধতা ঋণের অসম বাজারকে দায়ী করছেন। গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ব্যাংকের চেয়ে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা বাড়ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশগ্রহণ বাড়াতে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বড় দায়িত্বটি সরকার সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থাকেই পালন করতে হবে।

রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টায় দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। নতুন নতুন ব্যবসার জন্য অর্থায়নের চাহিদা বাড়ছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে উদ্যোক্তাদের মূলধন জোগাতে এনবিএফআইগুলো বড় ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু অনেক প্রতিষ্ঠান ভালো ব্যবসা করতে না পারায় এবং সুশাসন ঘাটতির কারণে আর্থিক খাতে দীর্ঘমেয়াদি সংকট তৈরি করছে। তবে এখনো খাতে কিছু ভালো সক্ষম আর্থিক প্রতিষ্ঠান আছে। তাদের সঙ্গে অন্যগুলো একীভূত করা বা অধিগ্রহণের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। এমনকি ব্যাংকগুলোও তা করতে পারে, যেভাবে সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান চালায়, সেভাবে তারা এসব প্রতিষ্ঠান চালাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকেও নির্বাহীদের পক্ষ থেকে ধরনের পুনর্গঠনের প্রস্তাব এসেছে। বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনা দক্ষতাও বাড়াতে হবে। দক্ষভাবে পরিচালনা করা না গেলে যেকোনো প্রতিষ্ঠানই টিকিয়ে রাখা কঠিন। ব্যবসার ক্ষেত্রেও অভিনবত্ব দরকার। গতানুগতিক গ্রাহকভিত্তির বাইরে শেয়ারবাজারে ব্রোকার হিসেবে কাজ করারও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সুযোগ আছে। ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য তাদের সুযোগ নিতে হবে। ব্যবসার ক্ষেত্রে নানা উদ্ভাবনী উপায় অন্বেষণ করতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ প্রডাক্টগুলো গতানুগতিক। এক্ষেত্রে বৈচিত্র্যও প্রয়োজন। গ্রাহকের চাহিদার দিকে খেয়াল রেখে নতুন নতুন প্রডাক্টের সন্নিবেশ ঘটাতে হবে। গ্রাহকভিত্তিও আরো বহুমুখী করা দরকার। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদন দিলেও দুঃখজনকভাবে এখানে সংস্থাটির তত্ত্বাবধান ব্যাংকের চেয়ে তুলনামূলক কম, নজরদারি দুর্বল। সুযোগে নানা ধরনের অনিয়ম ঘটছে এবং গ্রাহকের কাঙ্ক্ষিত সেবাপ্রাপ্তি ব্যাহত হচ্ছে। কাজেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি বাড়াতে হবে। তবে নজরদারি করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকাশ যেন ব্যাহত না হয়, সেটিও দেখতে হবে। বিশ্বে এনবিএফআইগুলোর তহবিলের প্রধান উৎস হলো বন্ড মার্কেট। অথচ দেশে বন্ড মার্কেটের বিকাশ না হওয়ায় গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত নিয়ে তহবিল সংগ্রহ করছে তারা। তহবিল সংগ্রহের ব্যয় বেশি হওয়ায় বেশি সুদে ঋণ বিতরণ করতে হয়েছে। ভালো গ্রাহকরা বেশি সুদে ঋণ নেয় না। ফলে এনবিএফআই বাধ্য হয়েই অপেক্ষাকৃত মন্দ গ্রাহককে ঋণ দিতে বাধ্য হয়েছে। এসব বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার যথাযথ পদক্ষেপ প্রত্যাশিত।

শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতসহ এশিয়ার অনেক দেশেও এনবিএফআই রয়েছে। এর মধ্যে কোরিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ফিলিপাইনে খাতটি একটা পরিণত অবস্থায় পৌঁছেছে। ভারতেও এটি ভালো অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু শ্রীলংকা, নেপাল বাংলাদেশে এখনো ধরনের আর্থিক মধ্যস্থতা বিকাশের পর্যায়ে রয়েছে। যেসব দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা ভালো, সেখানে দেখা যাচ্ছে কেন্দ্রীয় আর্থিক ব্যবস্থার সঙ্গে সেগুলো ভালোভাবে সংযুক্ত। ভৌত পরিসর ছোট হলেও ব্যবস্থাপনা, প্রক্রিয়া, প্রযুক্তির দিক থেকে কোনোভাবে তারা পিছিয়ে নেই। অথচ ব্যাংকগুলো কিছুটা ভালো অবস্থায় থাকলেও আমাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তির দিক দিয়ে অনেকটা পিছিয়ে। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা জনগণের আস্থাশীলতার দৃষ্টিকোণ থেকেও ওইসব দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো অনুসরণীয়, বাংলাদেশে যা বিরলই বলা চলে। তাই বহির্বিশ্বের অভিজ্ঞতাগুলো পর্যালোচনাপূর্বক এসব ক্ষেত্রে উন্নতি করতে হবে বৈকি।

বিশ্বের বহু দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠান আছে। হয়তো বাংলাদেশের মতো এত স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যময়ভাবে নেই। যুক্তরাষ্ট্রে যেমন শহরভিত্তিক আলাদা আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেখানকার প্রতিষ্ঠানগুলো দেখে গ্রাহক কারা। তারা গ্রাহকদের সর্বোচ্চ সেবা দেয়ার চেষ্টা করে। তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোয় জনগণের আস্থা থাকে, সুপরিচালিত। সেখানকার মানুষের চাহিদা পূরণ করে। আরেকটি বিষয় হলো, সেখানকার ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় আর্থিক ব্যবস্থার সঙ্গে ভালোভাবে সংযুক্ত। ভৌত পরিসর ছোট হলেও ম্যানেজমেন্ট, প্রক্রিয়া, প্রযুক্তির দিক থেকে কোনোভাবে তারা পিছিয়ে থাকে না। অন্যান্য দেশেও বহু ফাইন্যান্স কোম্পানি আছে। ওইসব দেশের ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলো বিদেশেও বিনিয়োগ করে। আমাদের দেশে যেসব প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করতে চায়, তাদের অনেকেই ফাইন্যান্স কোম্পানি, ব্যাংক নয়। তারা কোনো প্রকল্পের স্থায়িত্ব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতিশীলতা দেখলে বিনিয়োগ করে। অন্য কিছু দেখে না। বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এটিও একটা সমস্যা। সবচেয়ে বড় বিষয়, ওইসব দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোয় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা জনগণের আস্থা থাকে; যা বাংলাদেশে যথেষ্ট অভাব রয়েছে।

ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিকাশ সহায়ক পরিবেশের লক্ষ্যে সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। বন্ড মার্কেট তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে ইকুইটি মার্কেট এখনো দুর্বল। লিজ ফাইন্যান্স, কমার্শিয়াল পেপার, সিকিউরিটাইজেশনসহ আধুনিক আর্থিক সেবা উদ্ভাবনের পাশাপাশি পুঁজিবাজারকে প্রাণোদ্দীপ্ত রাখার দায়িত্বও পালন করছে বিশ্বের এনবিএফআইগুলো। বাংলাদেশের এক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকার সুযোগ নেই। নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে প্রত্যাশা থাকবে এনবিএফআইয়ের তহবিল সংগ্রহে সংশ্লিষ্ট বাজার তৈরিতে পদক্ষেপ নেবে। এতে শিল্পে দীর্ঘমেয়াদে ঋণের সরবরাহ আরো সহজ হয়ে উঠবে, যা শিল্পায়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এমনকি বড় বড় অবকাঠামো তৈরিতে অর্থায়নও করতে পারে এনবিএফআই। এর জন্য বন্ড মার্কেট একটি ভালো পথ হতে পারে। বিশ্বব্যাপী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিকশিত হয়েছে ইকুইটি সংস্থান, বন্ড মার্কেট, কমার্শিয়াল পেপারসহ বৈচিত্র্যপূর্ণ বিভিন্ন প্রডাক্টের ওপর ভর করে। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো সে অর্থে কোনো বন্ড মার্কেটই নেই। এতদিন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তহবিলের প্রধান উৎস ছিল ব্যাংক থেকে ধার করা আমানত। এখন ব্যাংকগুলোও আর টাকা দেয় না। গ্রাহকের কাছ থেকে উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহ করে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদান করা এনবিএফআইয়ের জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে। পরিস্থিতি যে জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে, তাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহযোগিতা না পেলে অনেক প্রতিষ্ঠানই হারিয়ে যাবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে অবশ্যই শক্তিশালী বন্ড মার্কেট সৃষ্টি করতে হবে। পাশাপাশি পরিচালনা পর্ষদ ব্যবস্থাপনায় নিশ্চিত করতে হবে কার্যকর সুশাসন।

থাইল্যান্ড, ভারত, মালয়েশিয়া, শ্রীলংকা এমনকি যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রেও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষুদ্র মাঝারি ঋণ বিতরণ এবং নতুন ধরনের অর্থায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। অটো লোন, হাউজিং লোন এমনকি ব্যক্তিঋণের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলো বরং অনেক এগিয়ে। অথচ বাংলাদেশে অনুমোদিত ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অধিকাংশেরই পারফরম্যান্স সন্তোষজনক নয়। গুটিকতক প্রতিষ্ঠান ভালো করলেও খাতটি মোটেও গোছানো নয়। অনেক প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ ঋণ পরিচালক তাদের বন্ধুবান্ধবের মাঝে বিতরণ বা ইনসাইডার ল্যান্ডিং, দুর্বল সম্পদ ব্যবস্থাপনা, পুরনো প্রযুক্তি ব্যবহার, অদক্ষ মানবসম্পদ, অভ্যন্তরীণ সুশাসন এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যথাযথ নজরদারির অভাবের অভিযোগ রয়েছে। এসব সমস্যার দ্রুত সমাধান জরুরি। সবচেয়ে বেশি জরুরি এনবিএফআই বিকাশে সহায়ক পরিবেশ তৈরি। ইউরোপ, আমেরিকায় ব্যাংক শুধু চলতি মূলধনের জোগান দেয়। মেয়াদি ঋণ দেয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু বাংলাদেশে স্বল্পমেয়াদি আমানত সংগ্রহ করে ব্যাংকগুলো দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বিতরণ করছে। মূল দায়িত্বের বাইরে বহু কাজ করতে গিয়ে ব্যাংকের পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুঁজি হারাচ্ছে। এটি আর্থিক খাতের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আর্থিক খাত সংস্কারেও উদ্যোগ নিতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন