৬০০ কোটি টাকা ব্যয়েও নিরসন হয়নি ভবদহের জলাবদ্ধতা

আব্দুল কাদের, যশোর

ভারি বৃষ্টিতে ভবদহের ২০৫ গ্রাম এখনো পানিবন্দি। বেশির ভাগ ঘরবাড়ি, ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, কৃষিজমি ও মাছের ঘের প্লাবিত হয়েছে ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

যশোরের অভয়নগর উপজেলার ভবানীপুর গ্রামের ভবদহ এলাকায় ১৯৬১ সালে নির্মাণ করা হয় স্লুইসগেট। এর পরই মণিরামপুর, কেশবপুর, অভয়নগর এবং খুলনার ফুলতলা ও ডুমুরিয়া উপজেলার মধ্যবর্তী ভবদহের কৃষকরা জলাবদ্ধতার কবলে পড়েন। ১৯৮৮ সাল থেকে স্থায়ীভাবে দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। এর মূল কারণ ভবদহের ভাটিতে থাকা নদ-নদীগুলোর নাব্য হারানো। এ অঞ্চলের জলাবদ্ধতা নিরসনে কয়েক দশকে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। ১৯৯০ থেকে চলতি বছর পর্যন্ত ভবদহ ঘিরে নেয়া ২১টি প্রকল্পে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৬০০ কোটি টাকা। তার পরও নিরসন হয়নি জলাবদ্ধতা।

অভয়নগর, মণিরামপুর ও কেশবপুর এবং খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার অংশবিশেষ নিয়ে ভবদহ অঞ্চল। এ এলাকার পানি ওঠানামা করে মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদ-নদী দিয়ে। তবে পলি পড়ে নদ-নদীগুলো নাব্য হারিয়েছে। এসব নদ-নদী দিয়ে এখন ঠিকমতো পানি নিষ্কাশিত হচ্ছে না। এ কারণে পানি আটকা পড়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। গত শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে সোমবার পর্যন্ত ভারি বৃষ্টিতে ২০৫টি গ্রাম এখনো পানিবন্দি। বেশির ভাগ ঘরবাড়ি, ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, কৃষিজমি ও মাছের ঘের প্লাবিত হয়েছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভবদহের মানুষ সড়কে থাকলেও রাতে কেউ কেউ ঘরে মাচাং বেঁধে বসবাস করছে।

এক মেয়ে ও স্বামীকে নিয়েই অভয়নগর উপজেলার ডুমুরতলার বাসিন্দা সুপ্রিয়া বৈরাগীর সংসার। স্বামী একটি কারখানায় চাকরি করেন। মেয়ে পড়াশোনা করে। তাদের ঘর ছিল সাজানো-গোছানো। এখন উঠানে কোমর সমান পানি। ঘরেও হাঁটুপানি। বারান্দা থেকে রাস্তা পর্যন্ত বাঁশের সাঁকোই তাদের চলাচলের একমাত্র পথ। পানি আরেকটু বাড়লে ছাড়তে হবে বাড়িঘর।

সুপ্রিয়া বৈরাগী বলেন, ‘হাঁস-মুরগি ও গোয়ালঘরে পানি উঠেছে। রান্নাঘরেও হাঁটুপানি। শোয়ার ঘরেও পানি। জিনিসপত্র নষ্ট হওয়ার পথে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাস্তায় কাটাচ্ছি। সবাই এক ঘরে মাচাং করে রাত পার করছি। তিনবেলার বদলে একবেলা খাবার খেতে হচ্ছে। পেটে ক্ষুধা, লজ্জায় কারো কাছে হাতও পাততে পারছি না। আমাদের দুঃখ কি কোনোদিন শেষ হবে না?’

ভবদহের জলাবদ্ধতা শুধু সুপ্রিয়া বৈরাগীর নয়, তছনছ করে দিয়েছে হাজারো পরিবারের সাজানো-গোছানো ঘর। প্রতি বছরই ঘরছাড়া হয় বিস্তীর্ণ জনপদের মানুষ। গত দুই বছর জলাবদ্ধতা কম থাকলেও চলতি মাসের বৃষ্টিতে ফের তলিয়ে গেছে এ অঞ্চলের মাঠ-ঘাট। দ্রুত পানি নিষ্কাশনের সঙ্গে টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট (টিআরএম) চালু ও আমডাঙ্গা খাল সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।

মণিরামপুরের মশ্বিমনগর ইউনিয়নের সুজাপুরে সড়কের ওপরে গরু-ছাগলের অস্থায়ী ঘর নির্মাণ করছিলেন সুকুমার সরদার। পাশেই তার স্ত্রী নির্মাণাধীন ঘরের ছাউনির পলিথিন বাঁধছিলেন। সুকুমার বলেন, ‘মাস খানেক ধরে বাড়ির উঠানে পানি। গত সপ্তাহ থেকে উঠানে কোমর সমান পানি। নিরুপায় হয়ে সড়কে চলে এসেছি। পশুগুলো তো আর কথা বলতে পারে না, তাই তাদের জন্য ঘর বানাচ্ছি।’

ডহর মশিয়াহাটী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অরুণ কুমার মণ্ডল বলেন, ‘বিদ্যালয়ের মধ্যে উঁচু বেঞ্চ পর্যন্ত পানি উঠে গেছে। বিদ্যালয়ের চারদিকে কোমর সমান পানি। শিক্ষার্থীরা আসতে পারছে না। তার পরও বিদ্যালয় খোলা রাখতে হয়েছে।’

ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রণজিৎ বাওয়ালির বাড়ির উঠানেও হাঁটুপানি। ঘরের বারান্দাও ছুঁই ছুঁই করছে পানি। তিনি বলেন, ‘বৃষ্টির পানি জমে ভবদহ এলাকা ডুবতে শুরু করেছে। প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। অনেকের বাড়িতে পানি উঠেছে। কারো কারো ঘরের মধ্যেও পানি প্রবেশ করেছে। এলাকার বিলে জোয়ারাধার চালু করতে না পারলে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি নেই। টিআরএমের দাবিতে আমরা ৮ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে পানিসম্পদ উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দিয়েছি। দ্রুত মিটিং করে পানি নিষ্কাশন ও জলাবদ্ধতা দূরীকরণে বিল কপালিয়ায় টিআরএম বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন শুরু করা হবে।’

বৃদ্ধ, শিশু ও গবাদিপশু নিয়ে সমস্যার অন্ত নেই ভবদহ জনপদের মানুষের। জলাবদ্ধতা নিরসনে নেই জনপ্রতিনিধিদের তেমন উদ্যোগ। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে তাদের এ ভোগান্তি পোহাতে হয়। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য বলছে, ১৯৯০ থেকে চলতি বছর পর্যন্ত ভবদহকে ঘিরে নেয়া ২১টি প্রকল্পে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৬০০ কোটি টাকা। যদিও এসব প্রকল্প কোনো কাজেই আসেনি বলে বছরের পর বছর জলাবদ্ধতায় ভুগতে হচ্ছে বলে মনে করেন ভবদহপাড়ের বাসিন্দারা।

ডুমুরতলা গ্রামের শিক্ষক শিবপদ বিশ্বাস বলেন, ‘বিভিন্ন সময় প্রকল্পের নামে লুটপাটের কারণে আমাদের এ দশা। বিগত সরকারের স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, চেয়ারম্যান, এমপি ও প্রতিমন্ত্রীর কাছে ভবদহ ডিম দেয়া হাঁসের মতো। ভবদহ স্লুইসগেট থেকে শোলগাতী পর্যন্ত নদীতে একটা চ্যানেল করে জরুরি ভিত্তিতে পানি সরানো, আমডাঙ্গা খাল সোজাসুজি খনন করে রাজাপুর খালের সঙ্গে সংযোগ দিতে হবে। অবিলম্বে বিল কপালিয়ায় জোয়ারাধার বাস্তবায়ন করতে হবে। কিন্তু তা না করে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জনপ্রতিনিধিরা সেচ প্রকল্প নিয়েছেন। এসব অর্থের সিংহভাগই লোপাটের অভিযোগ রয়েছে।’

এ ব্যাপারে যশোর পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বর্তমানে হরি নদের ২ দশমিক ১ কিলোমিটার অংশে মাটি কাটার কাজ চলছে। ভবদহ স্লুইসগেটের ২১ ভেন্টের ওপর চারটি বড় ও পাঁচটি ছোট পাম্প সব সময় চলছে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন