১৫ বছরে নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করেছে ৪৮ লাখ অঙ্গীভূত আনসার

নিহাল হাসনাইন

আওয়ামী লীগের অধীনে গত ১৫ বছরে বিভিন্ন নির্বাচনে আনসার-ভিডিপির বড় একটি অংশকে অঙ্গীভূত করে কাজে লাগানো হয় ছবি: ফাইল/নিজস্ব আলোকচিত্রী

আনসার ও ভিডিপি বাহিনীর যেসব সদস্য সরকারি-বেসরকারি-স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় স্থায়ী বা সাময়িকভাবে নিরাপত্তা অথবা অন্যান্য সেবার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন, তাদের বলা হয় অঙ্গীভূত আনসার। আওয়ামী লীগের অধীনে গত ১৫ বছরে আয়োজিত বিভিন্ন নির্বাচনে আনসার-ভিডিপি বাহিনীর বড় একটি অংশকে অঙ্গীভূত করে কাজে লাগানো হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এ ১৫ বছরে আয়োজিত নির্বাচনগুলোয় অঙ্গীভূত হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন ৪৮ লাখের বেশি আনসার সদস্য। তাদের মধ্যে ১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের হাত ধরে আত্মসমর্পণ করা ৪৮০ দস্যুও রয়েছেন, যাদের পুনর্বাসন করা হয়েছিল বিশেষ আনসার হিসেবে। নির্বাচনের সময় অঙ্গীভূত ও বিশেষ এ আনসারদের বড় একটি অংশ ভোট গ্রহণকালে নানা অনিয়মে জড়িয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনিয়মে জড়িত এ অঙ্গীভূত আনসার সদস্যদের কাজে লাগিয়ে সামনের দিনগুলোয়ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন নিয়ে বড় ধরনের সংশয় রয়েছে। এ অবস্থায় বাহিনীটির সংস্কার এখন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। 

প্রতিবারই নির্বাচনের বছরগুলোয় সরকারের কাছে নানা দাবি নিয়ে হাজির হতে দেখা গেছে অঙ্গীভূত ও বিশেষ আনসার বাহিনীর সদস্যদের। এসব দাবি পূরণও হয়েছে। সর্বশেষ গত নির্বাচনের আগেও বাজেটে অতিরিক্ত চাহিদা হিসেবে অঙ্গীভূত আনসার সদস্যরা বড় ধরনের দাবি তুলে ধরেন। দৈনিক খোরাকি ভাতা ২ কোটি থেকে বাড়িয়ে ৩০ কোটি টাকা এবং যাতায়াত ভাতা ৪৫ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৬ কোটি টাকা করার দাবি তোলেন তারা। তৎকালীন সরকার তাদের দাবি পুরোপুরি মেনে নিয়ে ৩৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ দেয়। পরে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষ নিয়ে নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগও ওঠে তাদের বিরুদ্ধে। 

সামনে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে গেলে আনসার বাহিনীতেও বড় ধরনের সংস্কার আনতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, নির্বাচনের সব বাহিনীর মধ্যে আনসার সদস্যরা নিয়োজিত থাকেন সবচেয়ে বেশি। সেক্ষেত্রে আনসার বাহিনীর সংস্কার ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন সম্ভব নয়। 

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পুলিশ ফোর্সের ঘাটতির কারণেই বিভিন্ন জায়গায় আনসারের প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচনে বিপুলসংখ্যক আনসার সদস্য দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তাদের যেসব কার্যক্রম আমরা দেখছি, তাতে সংস্কারের বিকল্প আছে বলে মনে হয় না।’ 

আনসার সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সারা দেশে আনসার ও ভিডিপি বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ৬২ লাখ ৯৩ হাজার ৩০৬। এর মধ্যে ৫ হাজার ৭০১টি সংস্থায় এখন অঙ্গীভূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ৫৪ হাজার ৬৫১ জন। অঙ্গীভূত দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত আছে আরো ১৫ হাজার। এছাড়া ব্যাটালিয়ন আনসার সদস্য ১৭ হাজার ৮০৬ জন। দস্যুতা থেকে পুনর্বাসিত বিশেষ আনসার ৪৩৯ জন। এর বাইরে বাকিরা সবাই ভিডিপি সদস্য।

গত ১৫ বছরে অঙ্গীভূত আনসার সবচেয়ে বেশি নিয়োগ দেয়া হয়েছে বিভিন্ন ধাপের নির্বাচনে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে দেশে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ সিটি করপোরেশন, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন ৪৮ লাখ ১৪ হাজার ৩৯৫ জন অঙ্গীভূত আনসার সদস্য। ব্যাটালিয়ন আনসার সদস্য নিয়োজিত ছিল ৬৮ হাজার ৮১৩ জন। এছাড়া এ সময়ের মধ্যে শারদীয় দুর্গা পূজায় ১৯ লাখ ৬৬ হাজার ২১২ জন, বাণিজ্য মেলায় ৬৩৫, মোবাইল কোর্টে ২৮ হাজার ৩২৮ ও বিশ্ব ইজতেমায় ১ হাজার ৫০০ জন অঙ্গীভূত আনসার সদস্য দায়িত্ব পালন করেছে।

আনসার সদর দপ্তরের কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে বিভিন্ন নির্বাচনে অংশ নেয়া ৪৮ লাখ অঙ্গীভূত আনসারের মধ্যে ৯৫ শতাংশই ছিলেন ভিডিপি সদস্য। তারা আনসারের সঙ্গেই দায়িত্ব পালন করেছেন। ইউনিফর্মও ব্যবহার করেছেন অঙ্গীভূত আনসারের। 

সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশজুড়ে পাঁচ লাখ আনসার সদস্য নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে ৪২ লাখ ১ হাজার ৪৯০ জন ভিডিপি সদস্য। ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে ১০ দিনের প্রশিক্ষণের ভিত্তিতে তাদের সংগ্রহ করা হয়। গত নির্বাচনে প্রতি প্লাটুন (৩২ জন) অঙ্গীভূত আনসার সদস্যের মধ্যে ২৫ জনই ছিলেন ভিডিপি সদস্য।

দস্যুতা ছেড়ে আনসারে পুনর্বাসিত সদস্যদের বিরুদ্ধেও রয়েছে নির্বাচনে নানা অনিয়মে সম্পৃক্ত হওয়ার অভিযোগ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আনসার বাহিনীর সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৯ সালে পুলিশ ও ব্যাটালিয়ন আনসারের সমন্বয়ে চরমপন্থী হিসেবে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হয়। সে সময় তাদের আত্মসমর্পণ করলে সাধারণ ক্ষমা ও পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে চরমপন্থী হিসেবে অভিযুক্ত বিভিন্ন গ্রুপের ২ হাজার ১২৬ সদস্য অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। যাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিল না, তাদের মধ্য থেকে ৭৬৫ জনকে আনসার বাহিনীতে বিশেষ আনসার হিসেবে নিয়োগ দিয়ে পুনর্বাসনের প্রাথমিক উদ্যোগ নেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। পরে বিভিন্ন কারণে বেশকিছু সদস্যকে চাকরিচ্যুত করা হয় এবং কেউ কেউ চাকরি ছেড়ে দেন। বর্তমানে ৪৮০ জন বিশেষ আনসার সদস্য দেশের ৩৫টি জেলায় পুলিশের সঙ্গে কর্মরত।

অঙ্গীভূত ও বিশেষ আনসার সদস্যদের নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে খোদ বাহিনীটির মধ্যেই। বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর উপমহাপরিচালক (অপারেশনস) মো. ফখরুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সাধারণ ও বিশেষ আনসারের কার্যক্রম নিয়ে আমরা লজ্জিত। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর সারা দেশে থানা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে যে অর্জন তৈরি হয়েছিল, তা নিমেষেই শেষ করে দিয়েছেন অঙ্গীভূত আনসার সদস্যরা। তাদের জন্য আনসার ব্যাটালিয়নের অর্জনও ম্লান হয়েছে। যৌক্তিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে এ সংকট কাটিয়ে উঠতে কাজ চলছে। আশা করি, দ্রুততম সময়ের মধ্যেই এসব সংকট দূর করা সম্ভব হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন