ছাত্র-জনতাকে হত্যার অভিযোগ

পুলিশ সদস্যদের নাম এসেছে ২৮৭ মামলায়

সবচেয়ে বেশি মামলায় নাম এসেছে হারুনের

নিহাল হাসনাইন

ছবি : বণিক বার্তা ( ফাইল ছবি)

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলি চালিয়ে কিংবা পুড়িয়ে হত্যার অভিযোগে দায়েরকৃত মামলার মধ্যে ২৮৭টিতে পুলিশ সদস্যদের নাম এসেছে। এসব মামলায় পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এসেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক গোয়েন্দা প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদের নাম। তুলনামূলক কম মামলা হয়েছে পুলিশের সাবেক বিতর্কিত মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে।

এসব মামলায় পুলিশের কনস্টেবল পদমর্যাদার সদস্যের নামও আছে। অনেকে এরই মধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন এবং অনেকে গ্রেফতারের তালিকায় রয়েছেন। তবে তথ্যপ্রমাণ ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের গ্রেফতার না করার একটি নির্দেশনা এসেছে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে। এমনকি গণ-অভ্যুত্থানকেন্দ্রিক হত্যাকাণ্ড এবং অন্যান্য মামলার তদন্তে কোনো সরকারি চাকরিজীবী অথবা কোনো ব্যক্তির সম্পৃক্ততার প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া না গেলে তাদের নাম প্রত্যাহারের নির্দেশনাও এসেছে বাহিনীর পক্ষ থেকে।

পুলিশের সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা বলছেন, এসব মামলায় তথ্যপ্রমাণ ছাড়া কারো নাম যুক্ত করা উচিত হবে না। তথ্যপ্রমাণ ছাড়া কারো নামে মামলা হলে ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে।

ক্ষমতার পালাবদলের পর গত এক মাসে বিগত সরকারের মন্ত্রী-এমপি, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও পুলিশ সদস্যদের নামে প্রায় পৌনে তিনশ মামলা হয়েছে। এসব মামলায় নাম প্রকাশ করে আসামি করা হয়েছে ২৬ হাজারের বেশি মানুষকে, অজ্ঞাতপরিচয় আসামি রয়েছে দেড় লাখের ওপরে। 

এসব মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি মামলায় আসামি হয়েছেন ডিএমপির সাবেক ডিবিপ্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। তার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ৩৮টি মামলা  হয়েছে। এর পরের অবস্থানে রয়েছেন পুলিশের সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৩৬টি। এছাড়া সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা ৩৩ ও ডিএমপি যুগ্ম পুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারের বিরুদ্ধে ২৭টি মামলা হয়েছে। এর বাইরে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) তৎকালীন প্রধান মনিরুল ইসলামের নাম মামলা হয়েছে ১১টি। এর বাইরে ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের ডিসি ইকবাল হোসাইনের নামে আটটি, যুগ্ম পুলিশ কমিশনার এসএম মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে আটটি ও র‍্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ব্যারিস্টার হারুন অর রশিদের নাম এসেছে পাঁচটি মামলায়। 

সাবেক সিআইডি প্রধান মো. আলী মিয়ার বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী থানায় খুনের অভিযোগে দুটি মামলা হয়েছে। অতিরিক্ত আইজিপি খন্দকার লুৎফুল কবিরের বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী থানায় একটি হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য মামলা দায়ের হয়েছে। অতিরিক্ত আইজিপি জামিল আহম্মেদের বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা হয়েছে। সাবেক র‍্যাবপ্রধান এম খুরশিদ হোসেনের বিরুদ্ধে লালবাগ থানায় হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে। অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তারের বিরুদ্ধে লালবাগ, নিউমার্কেট ও যাত্রাবাড়ী থানায় মোট মামলা হয়েছে ছয়টি। নিউমার্কেট ও মোহাম্মদপুর থানায় হত্যার অভিযোগে দুটি মামলা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ড. খ. মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে। ঢাকার ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে সূত্রাপুর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে। 

হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের এসব মামলায় পুলিশের তৎকালীন অতিরিক্ত ডিআইজি, যুগ্ম কমিশনার, উপকমিশনার, অতিরিক্ত উপকমিশনার, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, পরিদর্শক, উপপরিদর্শক ও কনস্টেবল পদমর্যাদার সদস্যের নামও এসেছে। তবে ১০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত আইন-শৃঙ্খলাসংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির প্রথম সভায় সরকারি কর্মকর্তাদের তথ্যপ্রমাণ ছাড়া গ্রেফতার না করার নির্দেশনা আসে। পাশাপাশি যাদের সংশ্লিষ্টতা নেই, তাদের নাম প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তও হয়। পরে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (কনফিডেন্সিয়াল) কামরুল আহসান স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান ঘিরে হত্যাকাণ্ড ও অন্যান্য মামলায় তদন্ত ছাড়া কোনো সরকারি কর্মকর্তার সম্পৃক্ততার প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া না গেলে তাদের নামও প্রত্যাহারের ব্যবস্থা নিতে হবে। পুলিশের এ নির্দেশনার বিষয়ে জনসংযোগ বিভাগ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। তবে ওই চিঠি পুলিশ সদর দপ্তর থেকে বিভিন্ন ইউনিটে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ মনে করেন, হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় তথ্যপ্রমাণ ছাড়া কারো নাম যুক্ত হলে ভুক্তভোগীদের বিচারপ্রাপ্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘যেকোনো মামলা দায়েরের একটি প্রক্রিয়া রয়েছে। যেমন একটা খুনের পর মরদেহের সুরতহাল হয়, ময়নাতদন্ত হয়। তারপর দাফন। এসব প্রতিবেদন সংযুক্ত করে একটি হত্যা মামলা হয়। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং পরবর্তী সময়ে একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি চলছে। এমন পরিস্থিতিতে অপরাধীদের আটকানোর জন্য হয়তো এ ধরনের মামলা দেয়া হতে পারে। তবে আদালতে সেটি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সঠিক তথ্যপ্রমাণ তুলে ধরতে না পারলে ভুক্তভোগীদের মধ্যে বিচারপ্রাপ্তি নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন