সড়ক দুর্ঘটনায় সাতদিনে নিহত ১২২

নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতের দায়িত্ব সরকারেরই

ছবি : বণিক বার্তা

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বাংলাদেশের প্রতিদিনকার অভিজ্ঞতার অংশ। দুর্ঘটনার পর বিভিন্ন অনিয়মের চিত্র উঠে এলেও তা সমাধানে তেমন পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। নিত্য সড়ক দুর্ঘটনা যেমন বিভিন্ন পরিবারকে পঙ্গু করে দিচ্ছে, তা অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির কারণ হিসেবেও হাজির রয়েছে। ঈদসহ বিভিন্ন ছুটির মৌসুমে সড়কে মৃত্যুর মিছিল যেন বেড়ে যায়। প্রতি বছর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলেও কর্তাব্যক্তিরা যেন হাত গুটিয়ে বসে আছেন। আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হতে চাই ও উন্নত দেশের তালিকায় নাম লেখাতে চাই অথচ আমাদের সড়ক পরিবহন এখনো তৃতীয় বিশ্বের। 

সড়কে বছরে যে প্রাণহানি হয় যুদ্ধরত অনেক দেশেও এত প্রাণহানি হয় না। বিভিন্ন খাতে আমরা অভূতপূর্ব উন্নয়ন করতে পারলেও স্বাধীনতার পর থেকেই অব্যবস্থাপনা ও সড়কে মৃত্যু যেন আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থার নিত্যসঙ্গী। প্রধান উপার্জনকারীর বিদায়ে অনেক পরিবারকে পথে নামতে হচ্ছে। আবার পঙ্গুত্ব বরণ করা ব্যক্তিরাও পরিবার ও সমাজের জন্য বোঝা হিসেবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সড়কে প্রাণহানি আমাদের মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপিতেও বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব রাখছে। দিনের পর দিন সড়কে প্রাণহানি চলছে অথচ মনে হয় দায়িত্ব নেয়ার কেউ নেই। 

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) দৈনিক সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদন অনুসারে, ঈদুল ফিতরের আগে ও পরে সাতদিনে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ১২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন আরো ১৯৭ জন। এ সময়ে সব মিলিয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে ১১৭টি। তবে ঈদের আগের সাতদিন ও পরের চারদিন মিলিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ১৮৯ জনের।

নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতের সঙ্গে জড়িত যানবাহন, পরিবহন মালিক, চালক, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি), ট্রাফিক পুলিশ ও জনগণ। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতে এদের সবারই নিজ নিজ ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। সড়কে আইনের শাসন বাস্তবায়নে বিভিন্ন দায়িত্বশীল সংস্থাকে কঠোর হতে হবে। অন্যথায় সড়কে ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও আইন ভঙ্গকারীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়বে। অনিয়মের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়ন করতে পারলেই সড়ক দুর্ঘটনাও কমে আসবে। সড়কে ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও আইনের প্রয়োগ নিশ্চিতে ট্রাফিক পুলিশ ও বিআরটিসিসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। 

ফরিদপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় ১৪ জন মানুষের মৃত্যুর পর জানা গেল অনিয়মের চিত্র। ইউনিক পরিবহনের বাসটির ফিটনেসের মেয়াদ ছিল ২০২০ সালের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত। পরের বছরের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিল রুট পারমিট। যে রুটে দুর্ঘটনা ঘটে সেই রুটে বাসটির চলাচলের অনুমতি ছিল না। অন্যদিকে পিকআপে যাত্রী পরিবহন আইনত নিষিদ্ধ। তার পরও বেআইনিভাবে পিকআপটি মহাসড়কে যাত্রী পরিবহন করেছিল। 

সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে সরকার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল ভূমিকার প্রয়োজন। দেশে ফুটপাত দখল, অদক্ষ চালক ও সহকারী দিয়ে গাড়ি চালানো, মাত্রাতিরিক্ত গতি, গাড়ির ত্রুটি, ট্রাফিক আইন না মানা, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেডফোন ব্যবহার করার কারণে প্রতিনিয়তই দুর্ঘটনা বাড়ছে। তাই চালক ও যানবাহনের অনিয়ম বন্ধে ট্রাফিক পুলিশকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। 

চালকের অদক্ষতা ও বেপরোয়া যানবাহন চালানোর পাশাপাশি ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, সড়ক ও সেতুর নাজুক অবস্থাও সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বহুলাংশে দায়ী বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। গণপরিবহনে বাড়তি যাত্রী সামাল দিতে গতিসীমার বাইরে দ্রুত গাড়ি চালিয়ে বেশি ট্রিপ দেয়ার অশুভ প্রতিযোগিতা আর বাড়তি মুনাফার লোভে পরিবহন সংস্থাগুলো চালকদের অনেক বেশি সময় কাজ করতে বাধ্য করে। ফলে চালকের ওপর একধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ পড়ে, তাকে বেসামাল হয়ে গাড়ি চালাতে হয়, যা প্রকারান্তরে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। লক্কড়ঝক্কড়, অচল যানবাহনে রঙ লাগিয়ে যেনতেন মেরামত করে রাস্তায় চলাচল করে বিভিন্ন উৎসব-পার্বণের সময়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অতিরিক্ত যাত্রী দূর-দূরান্তে গমনাগমন করে। সড়ক-মহাসড়কে অনেক সময় বাস-ট্রাকের মাদকাসক্ত চালকের গতির লড়াইয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। কেউবা আবার গাড়ি চালানোর সময় ব্যবহার করেন সেলফোন, যা সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত। পণ্যবাহী যানবাহনে যাত্রী বহন, অদক্ষ চালক ও হেলপার দিয়ে যানবাহন চালানো, বিরামহীন যানবাহন চালানো, মহাসড়কে অটোরিকশা, নসিমন-করিমন ও মোটরসাইকেলের অবাধ চলাচল এবং ব্যস্ত সড়কে ওভারটেকিং, ওভারলোডিং তদারকি না করায় সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে।

সড়ক দুর্ঘটনায় বিপুলসংখ্যক মানুষের মৃত্যুর কারণে প্রধানমন্ত্রী সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে পাঁচ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেগুলো ছিল চালক ও সহকারীদের প্রশিক্ষণ প্রদান, দূরপাল্লার বাসযাত্রায় বিকল্প চালক রাখা ও ৫ ঘণ্টা পরপর চালক পরিবর্তন করা, চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট বাঁধা বাধ্যতামূলক করা, চালকদের জন্য মহাসড়কে বিশ্রামাগার নির্মাণ এবং সিগন্যাল মেনে যানবাহন চালানোর ওপর কড়াকড়ি আরোপ, যা তেমন বাস্তবায়ন হতে দেখা যায়নি। 

বিশ্বের প্রথম সারির উন্নত পরিবহন ব্যবস্থার কথা বলতে গেলে সিঙ্গাপুরের নামটি সামনে চলে আসে। সিঙ্গাপুরে পরিবহন ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে ল্যান্ড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি গঠিত হয় ১৯৯৫ সালে। এক দশকের ব্যবধানে সংস্থাটি দেশটির পরিবহন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনে। গ্রাহক সন্তুষ্টির দিক থেকে সিঙ্গাপুরের পরিবহন ব্যবস্থা বিশ্বে প্রথম সারিতে। এশিয়ার মধ্যে চীন, জাপান, দুবাই, ইউরোপের সুইডেন, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি প্রভৃতি দেশের পরিবহন ব্যবস্থা বিশ্বে আদর্শ। প্রতিটি দেশই নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। দেশগুলোয় সংশ্লিষ্ট আইনটি অত্যন্ত শক্তিশালী। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো আইন বাস্তবায়নে তাদের প্রশাসন খুবই কঠোর, কোনো ছাড় দেয়া হয় না। আইন বাস্তবায়নে দুর্নীতিকে তারা প্রশ্রয় দেয় না। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক পরিবহন আইন প্রয়োগ কাগজ-কলমে সীমাবদ্ধ থাকলে দুর্ঘটনা কমবে না। মালিকদের প্রভাবে চলছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। তারা একপেশে ও একচেটিয়া সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। আইন প্রয়োগে প্রভাবশালীদের ছাড় দেয়া হচ্ছে। প্রভাবশালী ও সবলদের ওপর আইন প্রয়োগ করছে না পুলিশ। দুর্বলের ওপর আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে। এছাড়া সড়কে চাঁদাবাজি, ছোট যানবাহনের আধিক্যের কারণে সড়ক পরিবহন নেটওয়ার্ক ভেঙে পড়ছে। উন্নত দেশে গণপরিবহনকে প্রাধান্য দেয়া হয়, আর আমাদের দেশে ছোট যানবাহনকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। 

সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে যেসব ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে—১. সড়ক নিরাপত্তায় বাজেট বরাদ্দ বাড়িয়ে মন্ত্রণালয়ে আলাদা সড়ক নিরাপত্তা ইউনিট গঠন করা যেতে পারে, ২. দেশের সড়ক-মহাসড়কে প্রয়োজনীয় রোড সাইন (ট্রাফিক চিহ্ন) স্থাপন ও জেব্রা ক্রসিং অঙ্কন, ৩. গাড়িচালকদের দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণের পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা আবশ্যক, ৪. পরিবহন খাতে বিদ্যমান অনিয়ম-দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি বন্ধ করা জরুরি, ৫. গাড়ির ফিটনেস ও চালকদের লাইসেন্স প্রদানের পদ্ধতি উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিকায়ন করা, ৬. সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক সহায়তা তহবিল গঠনপূর্বক হতাহতদের দ্রুত উন্নত চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা, ৭. দেশব্যাপী চাহিদানুযায়ী পর্যাপ্ত মানসম্মত নতুন গণপরিবহন নামানোর উদ্যোগ নেয়া, ৮. ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তা ও সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্য ট্রেনিং একাডেমি গড়ে তোলা।  

সড়কে মৃত্যুর যে মিছিল চলছে প্রতিদিন তা নিয়ন্ত্রণে অবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। ঈদসহ বিভিন্ন উৎসব মৌসুমে সড়কে বাড়তি সতর্কতা কাম্য। সড়ক দুর্ঘটনা পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে আসে। দুর্নীতি রোধ, সুপ্রশিক্ষিত চালক, সড়কে সুব্যবস্থাপনা এবং যথাযথ নীতি প্রণয়ন ও কার্যকর ছাড়া এ-জাতীয় ক্ষয় এড়ানো যাবে না। জাতিগত শক্তির নিদারুণ অপচয় রোধে সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নেবে এ কামনা করছি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন