মওলানা ভাসানী ও চৌ এন-লাইয়ের আলোচনাজুড়ে ছিল দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি

চীন সফরকালে মওলানা ভাসানীছবি: ১৯৬৩ সালে ফারুক আহমেদ চৌধুরীর তোলা

দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে ব্যাপক মাত্রায় সক্রিয় বড় পরাশক্তিগুলো। দেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন দেশের মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর বড়সংখ্যক অনুসারী। এমনই একটি প্রেক্ষাপটে ১৯৬৩ সালে চীনের জাতীয় দিবস উৎসবে যোগ দিতে পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের প্রধান হিসেবে বেইজিং সফরে যান মওলানা ভাসানী। ১৮ নভেম্বর চীনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চৌ এন-লাই ও সামরিক বাহিনীর মার্শাল চেন ই এবং মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মধ্যে একটি বৈঠক হয়। মওলানা ভাসানীর সঙ্গে চীনা নেতাদের এ বৈঠকে আলোচনার বড় একটি অংশজুড়ে ছিল দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি। বিশেষ করে কাশ্মীর ও অরুণাচল প্রদেশের সীমান্ত নিয়ে ভারতের সঙ্গে দেশটির দুই প্রতিবেশী পাকিস্তান ও চীনের বিবাদের বিষয়ও আলোচনা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের থিংকট্যাংক উইলসন সেন্টারের ডিজিটাল আর্কাইভ থেকে এ তিন নেতার কথোপকথনটি নেয়া হয়েছে। অনুবাদ করেছেন আনিকা মাহজাবিন

চৌ এন-লাই: আপনি ৪০ দিনেরও অধিক সময় চীনে অবস্থান করায় আমরা আনন্দিত। অসুস্থতার কারণে আপনাকে এখানে থাকতে হয়েছে, যা নিয়ে প্রথমে আপনার মধ্যেও উদ্বেগ ছিল। 

মওলানা ভাসানী: যদিও বর্তমান আবহাওয়া আমার স্বাস্থ্যের জন্য পুরোপুরি উপযোগী নয়, তারপরও তা বড় কোনো সমস্যা নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আমি আমার পুরো জীবন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নিয়োজিত ছিলাম। এ কারণে আপনার দেশ যে শুধু সাম্রাজ্যবাদের রাজনৈতিক প্রভাব নয়, বরং অর্থনৈতিক প্রভাবকে দূর করতে পেরেছে তাতে আমি অনেক আনন্দিত। 

চৌ এন-লাই: আপনার প্রশংসার জন্য ধন্যবাদ। আমরা যা করেছি তা এখনো খুব সামান্য। এখনো আমাদের কঠোর পরিশ্রম চালিয়ে যেতে হবে। 

মওলানা ভাসানী: আমি একমত যে এখনো অনেক কাজ বাকি। কিন্তু আপনারা এরই মধ্যে সাম্রাজ্যবাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিপীড়ন দূর করেছেন। আপনারা অনেক ক্ষেত্রে বিশাল সাফল্য অর্জন করেছেন। বিশেষ করে আপনাদের নৈতিক মান পরিবর্তনে আমি বেশ আনন্দিত। আগের সব পাকিস্তান সরকারই সাম্রাজ্যবাদকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে আমাদের জনগণের ওপর নিপীড়ন করার সুযোগ দিয়েছে। তবে আমি আনন্দিত যে বর্তমান পাকিস্তান সরকার এরই মধ্যে রাজনীতি ও অর্থনীতিতে সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব অনেকটাই দূর করেছে। বিশেষ করে তাদের চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার বিষয়টিকে আমি সৌভাগ্যের বলে মনে করি। 

চৌ এন-লাই: আমরা উভয় পক্ষই আমাদের জাতীয় স্বাধীনতাকে রক্ষার প্রয়াস চালাচ্ছি ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সাম্রাজ্যবাদের হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করছি। সেই সঙ্গে এশিয়ায় সাম্রাজ্যবাদীদের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে লড়াই করছি। এটি বিগত কয়েক বছরে আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নয়ন ও অন্তরঙ্গতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে, যা আমাদের বরাবরই আনন্দিত করে।

মওলানা ভাসানী: আপনি হয়তো জানেন, আমি এবং আমার কয়েকজন সহকর্মী ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছি।1১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান বিভক্ত হয়। সে সময় মুসলিম লীগ ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস একটি সমঝোতায় পৌঁছেছিল। ওই সমঝোতার ভিত্তি ছিল যেসব অঞ্চলে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, তারা পাকিস্তানে ফিরে যাবে। একইভাবে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলো ভারতে ফিরে যাবে। কিন্তু তারপর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, যা কিনা বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ সাম্রাজ্যবাদ; পাকিস্তানকে একটা সমঝোতায় যেতে বাধ্য করতে পারল কেন? এর একমাত্র কারণ কাশ্মীর ইস্যু। এ ইস্যুর জন্যই যুক্তরাষ্ট্রও পাকিস্তানকে সিয়াটো ও সেন্টো চুক্তিতে অংশগ্রহণ করাতে পেরেছে। কাশ্মীর বিরোধের কারণেই যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান ও ভারতের ওপর প্রভাব বিস্তার ও দেশ দুটির জনগণের ওপর নিপীড়ন চালাতে পারছে। 

বর্তমানে সাম্রাজ্যবাদ ভারতের পক্ষে দাঁড়িয়ে তাকে হামলা চালানোয় সহায়তা করার মাধ্যমে পাকিস্তানকে পুরোপুরি ধ্বংস করতে চায়। কাশ্মীরের আসল সমস্যা হলো কাশ্মীরি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার থাকা উচিত। এখন আমরা চীনের জনগণের কাছে আবেদন করছি এ আশায় যে তারা এতে নৈতিক সমর্থন দেবে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী নিপীড়নকে মোকাবেলা করতে পারবে। ভারত ও পাকিস্তান বা ভারত ও চীনের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হোক, তা আমি চাই না। আফ্রো-এশীয় দেশগুলোর মধ্যকার বিরোধ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা উচিত বলে আমি বিশ্বাস করি, যাতে করে সাম্রাজ্যবাদকে তাদের ওপর কোনো সুযোগ নিতে না পারে। আমি আমার বাকি জীবনও বিশ্বশান্তি ও আফ্রো-এশীয় ঐক্য গড়ে তোলা এবং সবশেষে সাম্রাজ্যবাদ হঠানোয় উৎসর্গ করতে চাই। 

সবচেয়ে আফসোসের বিষয় হলো এক সময় নেহরু আমার খুব ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন। তিনিও ১৭ বছর জেলে কাটিয়েছেন। যা-ই হোক, এখন আফ্রো-এশীয় ঐক্যকে ধ্বংস করতে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে নিকৃষ্ট সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে একজোট হয়েছেন। আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি যে এশীয়, আফ্রিকান ও লাতিন আমেরিকার অগ্রগতির পথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবন্ধক হলো সাম্রাজ্যবাদী নিপীড়ন। সাম্রাজ্যবাদকে নির্মূল করা ছাড়া আমাদের পক্ষে অগ্রগতি সম্ভব নয়। 

আমার বয়স হয়েছে। সম্ভবত আমার আর চীনে আসার সুযোগ হবে না। আইয়ুব খান সরকার এবং তার প্রতিনিধি জেনারেল রাজার সঙ্গে আপনি এবং আপনার সরকার যাতে একসঙ্গে কাজ করতে পারেন, আমি সেই আশা করি। আফ্রো-এশিয়ান ঐক্য এবং বিশ্বশান্তির জন্য জেনারেল রাজা সবসময় কঠোর পরিশ্রম করতে ইচ্ছুক বলে আমি বিশ্বাস করি। পাকিস্তানের জনগণকে আপনার যদি কিছু বলার থাকে তবে তা আপনি জেনারেল রাজার মাধ্যমে বলতে পারেন। 

সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ব্যাপারে আপনাদের চেয়ারম্যান, পার্টি ও জনগণের অনেক বিশ্লেষণ রয়েছে। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে চূড়ান্ত বিজয়ই আপনার বিশ্লেষণের যথার্থতা প্রমাণ করবে। আমি এরই মধ্যে আপনার অনেক সময় নিয়েছি। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকা কীভাবে তাদের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রাম গড়ে তুলতে পারে, সাম্রাজ্যবাদকে নির্মূল করতে পারে এবং সাম্রাজ্যবাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব দূর করতে পারে সেই বিষয়ে শুনতে চাই। 

চৌ এন-লাই: আপনার আন্তরিক বক্তব্যে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতেই বোঝা যায় অনেক বিষয় আমাদের মনোভাব এক। প্রথমত আফ্রো-এশীয় অন্যান্য দেশের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের উভয় দেশেরও অনেকটা একই রকম কাজ করার রয়েছে। যেমন জাতীয় স্বাধীনতার নিরাপত্তা নিশ্চিত, সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ও নব্য-উপনিবেশবাদের প্রতিরোধ। এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ হলো মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং এটিতে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি একই রকম হওয়ায় আমি আনন্দিত। 

আমরা যদি বলি পুরনো ধাঁচের ঔপনিবেশিকতায় আফ্রো-এশীয় দেশগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সশস্ত্র শক্তির মাধ্যমে দখল, হস্তক্ষেপ, ভূমির বিভাজন, বিভাজন এবং শাসন ও নিয়ন্ত্রণসহ অন্যান্য যেসব কৌশল ব্যবহার হয়েছে, সেখানে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ পুরনো ধাঁচের এ কৌশলগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে।

এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘‌দ্বৈত আচরণ’ (ডাবল ডিলিং)। আপনি বলেছেন যে একদিকে আমেরিকা চেয়েছিল পাকিস্তান সিয়াটো-সেন্টোয় প্রবেশ করুক এবং পাকিস্তানকে বলেছে যে এটি করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কাশ্মীরের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারকে জাতিসংঘে সমর্থন করবে। কিন্তু এখনো যুক্তরাষ্ট্র প্রকৃতপক্ষে ভারতকেই সমর্থন করছে। ভারতে তারা সামরিক সহায়তাও বাড়িয়েছে। শুধু তা-ই নয়, পাকিস্তান ও ভারত এবং ভারত ও চীনের মধ্যে ঝামেলা সৃষ্টি করেছে। এগুলো অবিকল দ্বৈত আচরণের কৌশল। একইভাবে তারা চীনকে ব্যবহার করছে। তাইওয়ান ও তাইওয়ান প্রণালি দখলে জিয়াং জিয়েশিকেও (চিয়াং কাইশেক) তারা সমর্থন দিচ্ছে। 

অন্যদিকে ওয়ারশতে আমাদের সঙ্গে তাদের আলোচনা ছিল একটি ষড়যন্ত্র, যাতে আমরা আপস করে তাদের আগ্রাসন মেনে নেই। এশিয়া ও আফ্রিকায় বিষয়টি একই রকম। যুক্তরাষ্ট্র আসলে শান্তিরক্ষী বাহিনী ব্যবহার করে শান্তির ভান করে। এরপর সব জায়গায় সামরিক ঘাঁটি তৈরি করে। একই সঙ্গে তারা আফ্রো-এশিয়ান দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে। আফ্রো-এশিয়ান দেশগুলোকে সশস্ত্র সংঘাতের দিকে প্ররোচিত করে। এটা এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে তারা এখন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বাংলার ভাগাভাগিকে কাজে লাগাচ্ছে, যাতে বাংলা উভয় দেশ থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন হয়ে যায়। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নতুন এক সংঘাত তৈরির জন্য এটি আরেক উসকানিমূলক পরিকল্পনা। যুক্তরাষ্ট্র এশিয়ায়ও এ দ্বৈত কৌশল ব্যবহার করেছে। তারা যখন অনুভব করে তাদের হাতিয়ারগুলো যথাযথভাবে কাজ করছে না তখনই তারা কৌশলকেও (হাতিয়ার) বদলে ফেলে। যেমন দক্ষিণ কোরিয়ার সিংম্যান রির ক্ষমতাচ্যুতি, দক্ষিণ ভিয়েতনামে নগো দিন দিয়েম ও তার ভাইয়ের হত্যাকাণ্ড এবং তৃতীয়বারের মতো তাইওয়ানে জিয়াং জিয়েশির ক্ষেত্রেও তা ঘটতে যাচ্ছে।

সুতরাং এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সবচেয়ে খারাপ এবং সবচেয়ে অবিশ্বস্ত। তবে এখানে অন্য ধরনের সাম্রাজ্যবাদ আছে, যেটাকে আপনি বলছেন ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদ। অন্যান্য অঞ্চলে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদও আছে্। সত্যিই এখানে অনেক ধূর্ত গোছের সাম্রাজ্যবাদ দেখা যায়। 

মওলানা ভাসানী: কিন্তু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যেহেতু জনগণের নৈতিকতাকে কলুষিত করে, তাই এটি সবচেয়ে খারাপ।

চৌ এন-লাই: এ বিষয়ে আমি আপনার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সবচেয়ে জঘন্য। এর পেছনে অন্য একটি কারণ রয়েছে। ব্রিটেন ও ফ্রান্স এখন ক্ষয়িষ্ণু। তাদের উপনিবেশ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। যেসব অঞ্চল তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, সেগুলোয় দাবানলের মতো জাতীয় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। অদূর ভবিষ্যতে অঞ্চলগুলো স্বাধীনতা অর্জনে সক্ষম হবে। ফ্রান্সের ক্ষেত্রে এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ দেখা যায় ইন্দোচীন ও আলজেরিয়ায়। ব্রিটিশের ক্ষেত্রেও পাকিস্তানসহ আফ্রো-এশীয় অনেক দেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এ কথা আফ্রিকান দেশগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। 

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সবচেয়ে খারাপ কারণ যখন এটি কোনো এলাকার দখল নেয়, তখন তা না ছাড়ার বিষয়ে জেদ ধরে বসে থাকে। স্থানীয় জনগণ যদি দৃঢ় সংগ্রামে জেগে ওঠে, শুধু তাহলেই তাদের বিতাড়ন করা যেতে পারে। এমনকি তাড়িয়ে দেয়ার পরও তারা ফিরে আসার চেষ্টা করবে এবং আগের মতো হস্তক্ষেপ করবে। তবে তারা আবারো পরাজিত হলেই কেবল হাল ছাড়তে বাধ্য হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে হয়তো তাদের আগের মতো পুরোপুরি সরে যেতে নাও দেখা যেতে পারে। যদি তারা এক টুকরো জমি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয় তবে তাই করবে। তারা চীনেই এমনটি করছে। যখন চীনের মূল ভূখণ্ড সম্পূর্ণরূপে ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল, তখন তারা কোরিয়ান যুদ্ধকে উসকে দিয়েছিল। এ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে তারা চীনের তাইওয়ান দখল করে, যেভাবে তারা আগেও তাইওয়ান জোর করে দখল করেছিল। 

মওলানা ভাসানী: সাম্রাজ্যবাদের অন্যতম কৌশল হলো কপট প্রচার-প্রচারণা (হিপোক্রেটিক্যাল প্রোপাগান্ডা)। উদাহরণস্বরূপ, পাকিস্তানে তারা হাজার হাজার লিফলেট বিতরণ করেছে। যেখানে লেখা থাকে—’চীনা কমিউনগুলো কৃষকদের ইচ্ছাকে লঙ্ঘন করে এবং তা জনগণের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেয়া’। ‘‌অসংখ্য মানুষের কোনো খাবার নেই, তাই তারা হংকংয়ে পালিয়ে যাচ্ছে’” ইত্যাদি। এগুলো সম্পূর্ণ বানোয়াট।

চৌ এন-লাই: তার মানে আপনি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে বিশ্বাস করতে পারবেন না এবং এর নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যখন একটি দেশকে নিয়ন্ত্রণ করে, তখন ওই দেশের স্বাধীনতা ও অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেয়। এর ফলে আমাদের প্রস্তাব হলো যে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করার অর্থ হলো সাম্রাজ্যবাদের নেতা হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা করা। এর মধ্য দিয়ে পৃথিবীর ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ, যারা যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবাজ ও আগ্রাসী নীতির বিরোধিতা করে তাদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। নিশ্চিতভাবেই তা দ্রুত অর্জন করা যাবে না। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ সংগ্রাম। 

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সমগ্র বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার করতে চায় এবং সর্বপ্রথম এটি সমাজতান্ত্রিক ও সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের মধ্যকার বিশাল মধ্যবর্তী অঞ্চল জোরপূর্বক দখল করতে চায়। আধিপত্য বিস্তার করতে চায় অবশ্যই। এর মধ্যে শুরুতেই রয়েছে এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার দেশগুলো। দ্বিতীয়ত, তারা মিত্রদেরও পুরোপুরি বশীভূত হতে বাধ্য করে। এর মধ্যে রয়েছে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা। একই সঙ্গে তারা সমাজতান্ত্রিক শিবির পতন চায়। প্রাচ্যের বেশকিছু সমাজতান্ত্রিক দেশ তা মানে না যেমন চীন, ডেমোক্রেটিক পিপলস রিপাবলিক অব কোরিয়া, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব ভিয়েতনাম। এর ফলে এখন তারা নিয়ন্ত্রণমূলক নীতিমালা গ্রহণের মাধ্যমে আমাদের বিচ্ছিন্ন করতে চাচ্ছে। এই তার বৈশ্বিক কৌশল। এর উচ্চাকাঙ্ক্ষা অনেক বড়, ইতিহাসের যেকোনো সাম্রাজ্যবাদীদের চেয়েও বেশি। 

এর উদর অত বড় না হলেও সবকিছু গিলে ফেলতে চায়। তারা দেখতে কত শক্তিশালী, সেটিতে মনোযোগ দেবেন না, বরং তারা বাস্তবে দুর্বল। তাদের ভীতিকর হিসেবে বিবেচনা করবেন না। এভাবেই বিশ্বের যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে নিপীড়িত মানুষেরা তাদের ভয় দূর করতে পারে। 

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে মোকাবেলা করতে হলে মনে রাখতে হবে আপনি যত ভয় পাবেন, তারা তত চেপে বসবে। আপনাকে আগে বলতে হবে যে আপনি তাকে ভয় পান না এবং তারপর তাকে নিয়ে ভাবুন। এখন আপনি যদি মনে করেন চীন দেশটি আয়তনে অনেক বড়, এটিকে গ্রাস করা যাবে না, তাই চীনের ভয় পাওয়ার কিছু নেই; তাহলে তা ভুল হবে। আমরা কিউবার দিকে তাকালে দেখতে পাই, যুক্তরাষ্ট্র থেকে মাত্র ৯০ নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থিত। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দৃঢ় বিরোধিতা করছে তারা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে কিছু করতে পারছে না। এর কারণ হলো ফিদেল কাস্ত্রো বলেছেন, ‘আমাদের শেষ ব্যক্তিটিরও কোনো ধরনের আত্মসমর্পণ ছাড়াই লড়াই করে যেতে হবে। কিউবা তার নিজ সীমানায় পর্যবেক্ষণ চালানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘ—কাউকেই অনুমতি দেয় না। এখন পর্যন্ত তারা কখনো প্রবেশেরও সুযোগ পায়নি।’ 

এখন যুক্তরাষ্ট্র কেন কিউবা আক্রমণের সাহস দেখায় না? যদি তারা কিউবা আক্রমণ করে, তাহলে ৭ মিলিয়ন কিউবান নাগরিক যুদ্ধে নেমে পড়বে এবং আত্মসমর্পণ করবে না। জেগে উঠতে পারে লাতিন আমেরিকার সব মানুষ। সবাই উঠে দাঁড়াবে। গোটা বিশ্বের শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা করবে। ফলে লাতিন আমেরিকা ও সারা বিশ্বের জনগণের নিচে যুক্তরাষ্ট্র চাপা পড়ে যাবে। এমন প্রেক্ষাপটে তা কীভাবে বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার করতে পারে? এটি হলো কেনেডির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় এবং তা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মৌলিক দুর্বলতাও। 

যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ ভিয়েতনামে যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহ করছে। কিন্তু সেখানকার দৃঢ়চেতা জনগণ আত্মসমর্পণ করবে না। এজন্য যুক্তরাষ্ট্র নগো দিন দিয়েম ও তার ভাইকে হত্যা করে তাদের পছন্দের লোককে প্রতিস্থাপন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র যদি একবার অভ্যুত্থান ঘটাতে সক্ষম হয়, তাহলে তারা তা বারবার ঘটাবে। দক্ষিণ কোরিয়ায় এরই মধ্যে বিষয়টি প্রমাণ করেছে তারা। দক্ষিণ ভিয়েতনামও তা প্রমাণ করবে। 

এ দুটি জায়গা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কোনো পথ ছাড়াই এগিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। ছোটগুলোকে গোনায় না ধরলেও সারা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টিরও বেশি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এসব ঘাঁটি দিয়ে গোটা বিশ্বকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। দেশটি যেখানেই যায়, সেখানেই স্থানীয় জনগণকে বিক্ষুব্ধ করে। ভাসানী যেমন বলেছিলেন, দেশটি যেখানেই যায় সেই অঞ্চলের স্থানীয় নৈতিক শৃঙ্খলাকে ধ্বংস করে দেয়। তাহলে কীভাবে তারা স্থানীয় জনগণের প্রতিরোধের মুখোমুখি হবে না? সুতরাং বলাই যায়, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য পরিস্থিতি ক্রমাগত খারাপ হচ্ছে। 

কেবল রাজনৈতিকভাবেই নয়, অর্থনৈতিকভাবেও তার সমস্যাগুলো ক্রমাগত বাড়ছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বার্ষিক সামরিক বাজেট ৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা রেকর্ড। দেশটির জাতীয় ঋণ ৩০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। স্বর্ণের মজুদ ১৯৪৯ সালের তুলনায় ১০ বিলিয়ন ডলার কম। অর্থাৎ তাদের মূল্য মাত্র ১৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। যদিও তাদের বিদেশে মার্কিন মুদ্রার সঞ্চালন হচ্ছে ২৫ বিলিয়ন ডলার। 

দেশটির অভ্যন্তরীণ স্বর্ণের মজুদ এখনো বিদেশে বিনিময় হওয়া মার্কিন মুদ্রার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। উপরন্তু প্রতি বছর তাদের ডলার সঞ্চিতি উদ্বৃত্তের পরিবর্তে ঘাটতিতে থাকে। গত বছরের ঘাটতি ছিল ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। যেখানে এ বছরে প্রথমার্ধে ঘাটতি ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার এবং এ বছরের দ্বিতীয়ার্ধে এ ধারা অব্যাহত থাকতে পারে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা সংকটাপন্ন। আগামী বছর তার বৈদেশিক সাহায্যের বাজেট হ্রাস করা হবে। কেনেডি প্রথমে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার চেয়েছিলেন। কিন্তু দীর্ঘ বিতর্কের পরে, সিনেট কেবল ৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার অনুমোদন করেছে। সিনেট কী কারণে ৮০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি ছাড় করার বিষয়ে তীব্র বিরোধিতা করে যাচ্ছে? কারণ যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক অবস্থা বেশি ভালো ছিল না। 

ফলে আমেরিকা ভারতকে খুব বেশি পরিমাণ অর্থ দিতে পারবে না। অতীতে শুধু আপনারাই ভারতের আগ্রাসনকে প্রতিহত করেছেন। এখন আমাদের দুই দেশই তাদের আগ্রাসন প্রতিহত করছে। আপনারা কি ভারতকে ভয় পান?

ভারত অনেক অপপ্রচার চালায়। তারা বলে, চীন-ভারত সীমান্ত আবার উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠছে। চীন আবার সেখানে সৈন্যদের কেন্দ্রীভূত করছে। মার্কিন সংবাদপত্রগুলোর মতে, ভারতীয় প্রচারণা অবিশ্বাস্য। সেগুলোর উদ্দেশ্য হলো যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সহায়তা আকর্ষণ করা। 

ভাসানী: ভারতীয়দের প্রচারণায় বলা হয়, পুরনো চীন সরকার ম্যাকমাহন লাইনকে স্বীকার করেছিল।

চৌ এন-লাই: না। এ বিষয়ে আমার কাছে প্রতিটি দেশের নেতাকে দেয়ার জন্য মানচিত্রসহ একটি চিঠি আছে। আমি আপনাকে একটি অনুলিপি দিতে পারি। তথাকথিত"ম্যাকমোহন লাইন চালু হয়েছে যখন ব্রিটিশরা এ মহাদেশে শাসন করছিল। ব্রিটিশ ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী [স্যার হেনরি] ম্যাকমাহন চীনা কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধির আড়ালে তিব্বতের আঞ্চলিক সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এ নিয়ে মতবিনিময় ও চুক্তি সই করেছিলেন। সে সময় চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিরা তথাকথিত ম্যাকমাহন লাইন সম্পর্কে একেবারেই জানতেন না। তৎকালীন চীন সরকারও এটিকে স্বীকার করেনি। জিয়াং জিয়েশিও ২২ বছর ধরে শাসন করেছিলেন এবং তিনিও কখনো তা স্বীকার করেননি। বর্তমানে তিনি তাইওয়ানে আছেন। এখনো তা স্বীকার করছেন না। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর একসময় ইঙ্গিত দিয়েছিল, তারাও এটি স্বীকার করেনি। গত বছর চীন-ভারত সীমান্ত সংঘাতের পর ব্রিটেনের দ্য টাইমস একটি মানচিত্র প্রকাশ করে। সেখানে উল্লেখ করা হয়, ম্যাকমাহন লাইন প্রচলিত এবং গতানুগতিক সীমানা নির্ধারণের লাইন থেকে ব্যতিক্রম। এ লাইনটি শুধু চীন-ভারত সীমান্তেই নয়, চীন-বার্মিজ (মিয়ানমার) সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। যদিও চীন ও বার্মা এরই মধ্যে তাদের সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করেছে। চীন-বার্মিজ সীমান্ত আলোচনার সময় আমরা ম্যাকমাহন লাইন নিয়ে কোনো আলোচনা করিনি বা আমরা তা স্বীকারও করিনি। বার্মার প্রধানমন্ত্রী ইউ নু ও বার্মার রাষ্ট্রপতি নে উইনও এর সঙ্গে একমত। যদিও নেহরু যেভাবেই হোক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন।

যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে নিয়ন্ত্রণ করতে চীন-ভারত সীমান্ত সমস্যাকে কাজে লাগাতে চায়, এটি সত্য। প্রথমত, এটি ভারতীয় জনগণের জন্য বিপর্যয়কর এবং তাদের আরো দরিদ্র করে তুলবে। আরো বেশি খাদ্য ঘাটতি দেখা দেবে। ফলে আমেরিকা থেকে আমদানি বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে। কিন্তু আমদানীকৃত মার্কিন অস্ত্রগুলো তো খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। আমরা যদি সত্যিই যুদ্ধে যাই, তবে এ সামরিক সরঞ্জাম, অস্ত্র ও গোলাবারুদ ইত্যাদি নিয়ে সমস্যা দেখা দেবে। তারা আমাদের জন্য বাস্তবে হুমকিস্বরূপ। কিন্তু আমরা যদি ভারতের সঙ্গে চুক্তিতে পৌঁছাই, তাহলে আমেরিকার পক্ষে আমাদের মধ্যে যুদ্ধ উসকে দেয়া কঠিন হবে। অতএব, আমরা আপনার দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একমত, আমাদের অবশ্যই আমেরিকাকে নিকৃষ্টতম সাম্রাজ্যবাদ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। আমাদের অবশ্যই আমেরিকার আগ্রাসন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে একত্র হতে হবে। 

আফ্রো-এশীয় ঐক্যের স্বার্থে, আফ্রো-এশীয় দেশগুলো সহিংসতার আশ্রয় না নিয়ে শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাদের বিরোধ নিষ্পত্তি করা উচিত। আমাদের অবশ্যই যেকোনো বিদেশী হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করা দরকার। প্রতিটি দেশের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য চেষ্টা করতে হবে। স্বাধীন জাতীয় অর্থনীতি, স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ কাজগুলো বাস্তবায়িত করার পরই আমরা সাম্রাজ্যবাদকে সত্যিকার অর্থে প্রত্যাখ্যান করতে পারব। এটি আমাদের সাধারণ লক্ষ্য এবং বন্ধুত্বকে দৃঢ় করবে। 

চীন এখনো সাম্রাজ্যবাদের নিপীড়ন পুরোপুরি বন্ধ করতে পারেনি। চীন স্বাধীন। দেশটি সাম্রাজ্যবাদকে উৎখাত করেছে। কিন্তু আমেরিকা এখনো তাইওয়ান ও তাইওয়ান প্রণালি জোরপূর্বক দখল করে রেখেছে। তাহলে আমরা কীভাবে বলতে পারি যে আমরা সম্পূর্ণ স্বাধীন? উপরন্তু আমেরিকা এখনো আমাদের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। সুতরাং আমাদের অবশ্যই আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন ও নিপীড়নের বিরোধিতা করা উচিত। আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদের একমাত্র সুবিধা হলো এটা আমাদের আত্মবিশ্বাস জাগায় ও উদ্যোগী করে। 

অবশ্য এশিয়া ও আফ্রিকার সব দেশ একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় না। তারা সবাই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করার জন্য একই পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারে না। একই সময়ে সাম্রাজ্যবাদের নিয়ন্ত্রণ ত্যাগ করতে পারে না এবং একই স্তরে পৌঁছাতেও পারে না। যেমন পাকিস্তানের নিজস্ব অবস্থা রয়েছে এবং এ অবস্থা অনুসারে পদক্ষেপগুলো বিবেচনা করা উচিত। আমরা আপনাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও রাষ্ট্রদূত রাজাকে বলেছি, আমি বা মার্শাল চেন ই যদি পাকিস্তানে আসার সুযোগ পাই, তাহলে আমরা অবশ্যই রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের সঙ্গে মতবিনিময় করতে পেরে আনন্দিত হব। প্রতিটি দেশের পরিস্থিতি আলাদা, পদ্ধতিও আলাদা এবং আমরা সবাই একই মানের দাবি করতে পারি না। তবে আমাদের লক্ষ্য একই।

বর্তমানে দ্বিতীয় আফ্রো-এশীয় সম্মেলন আহ্বানের মাধ্যমে আমরা একটি পারস্পরিক পদক্ষেপ নিতে পারি। রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান এবং রাষ্ট্রপতি সুকর্ণ—তারা এক যৌথ বিবৃতিতে এটিকে সমর্থন জানিয়েছেন। আমাদের অবিলম্বে দ্বিতীয় আফ্রো-এশীয় সম্মেলন আহ্বান করা উচিত। এ সম্মেলন শুধু বান্দুং সম্মেলনের দশটি নীতির চেতনাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এমন নয়, সেগুলোকে দৃঢ়ও করবে। আফ্রো-এশীয় সম্মেলনে আফ্রো-এশীয় দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার আহ্বান করা হয়। আমরা এটি করেছিলাম, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। আমাদের শর্ত দিতে হবে যে যখন কোনো দেশ সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপের মুখোমুখি হবে, তখন আমাদের সর্বসম্মতভাবে তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমরা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বা অন্য যেকোনো ধরনের সাম্রাজ্যবাদের বিরোধী, যা আফ্রো-এশীয় দেশগুলোর সাধারণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে। অর্থনৈতিক বিষয়েও আমরা পারস্পরিক সহায়তা ও সহযোগিতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আরো এক ধাপ এগিয়ে যেতে পারি। আপনি এই মাত্র উল্লেখ করেছেন, কীভাবে স্বাধীনতা এবং একটি জাতীয় অর্থনীতি গড়ে তোলা যায়। এর জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ সময় ও পারস্পরিক সহায়তার প্রয়োজন। যদিও আমাদের শক্তি সীমিত এবং উন্নত পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় কম, আমরা যদি একত্র হই এবং একে অন্যকে পারস্পরিক সমর্থন করি তবে আমরা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে পারি।

ভাসানী: পূর্ব পাকিস্তানের একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে চীন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। সেখানে প্রতি দুই-তিন বছর পর পর বন্যা ও ঝড় হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান সমস্যা মাটির লবণাক্ততা। আমি আপনাদের দেশের যে স্থানে গিয়েছি, সেখান থেকেই দেখেছি যে আপনারা এসব সমস্যা মোকাবেলায় ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছেন। আমি আশা করি, আপনারা আমাদের সাহায্য করার জন্য পাকিস্তানে কিছু বিশেষজ্ঞ পাঠাতে পারবেন, অথবা আমাদের নিজস্ব বিশেষজ্ঞদের কাছে আপনার অভিজ্ঞতা উপস্থাপন করতে পারবেন।

চৌ এন-লাই: আমাদের বন্যা ও মাটির লবণাক্ততা ইত্যাদির একই সমস্যা রয়েছে। আমরা কয়েকটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছি এবং বর্তমানে সেগুলো বাস্তবায়ন করছি। পাকিস্তান সরকার যদি আমাদের সাহায্যের জন্য অনুরোধ করে, তাহলে আমরা সাহায্য করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করব। তবে স্পষ্ট করে বলতে চাই, বর্তমানে আমাদের শক্তি সীমিত। আমরা আশা করি যে দীর্ঘ সময়ের মধ্যে, সম্ভবত ৫ বা ১০ বছরের মধ্যে আমরা আমাদের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডকে শক্তিশালী করতে পারব। সেই সময় আমরা আফ্রো-এশীয় দেশগুলোকে আরো বেশি সহায়তা দিতে পারব। তবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সাম্রাজ্যবাদের অবসান পর্যন্ত অপেক্ষা করতে করব না। একদিকে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করব এবং অন্যদিকে স্বাধীনতা ও জাতীয় অর্থনীতি প্রতিষ্ঠায় পারস্পরিক সহায়তা করব। অর্থনৈতিক উন্নয়নকে শক্তিশালী করার অর্থই হলো সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করা। 

বর্তমানে আফ্রো-এশীয় সম্মেলন আয়োজন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নেহরু ও টিটো বর্তমানে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলন আহ্বান করছেন এবং আফ্রো-এশীয় সম্মেলনকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করছেন। আমরা জোটবদ্ধ দেশ। কিন্তু এখন বিশ্ব বদলে যাচ্ছে, আপনার সহযোগী কমছে। যেহেতু আমেরিকা ভারতকে সাহায্য করছে। মজার কথা, আমদের মিত্ররা ভারতের বিরোধিতা করার পরিবর্তে, ভারতকে আমাদের আক্রমণ করতে সহায়তা করছে। আপাতদৃষ্টিতে আপনার দেশ একটি জোটবদ্ধ দেশ, কিন্তু বাস্তবে আপনি জোটনিরপেক্ষ। স্পষ্টত প্রতীয়মান, ভারত জোটনিরপেক্ষ, কিন্তু বাস্তবে এটি কেবল আমেরিকার সঙ্গেই নয়, সোভিয়েত ইউনিয়ন বা ইউএসএসআরের সঙ্গেও যুক্ত। বর্তমান বিশ্ব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অতএব, আমি অবশ্যই বলব, জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনের চেয়ে আফ্রো-এশীয় সম্মেলন আহ্বান করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের অবশ্যই রাষ্ট্রপতি সুকর্ণ, সিলনের (শ্রীলংকা) প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি নাসেরকে প্রথমে আফ্রো-এশীয় সম্মেলন আহ্বান করার জন্য প্ররোচিত করতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের অবশ্যই আফ্রিকার অন্যান্য দেশের নেতাদের প্ররোচিত করতে হবে।

দ্বিতীয় বিষয়টি হলো আফ্রো-এশীয় দেশগুলোকে অবশ্যই নিয়মিতভাবে মতবিনিময় করতে হবে। শুধু একে অন্যের সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়া বাড়ানোর মাধ্যমেই আমরা একে অন্যকে পারস্পরিক সমর্থন করতে সক্ষম হব। ইন্দোনেশিয়ায় সাম্প্রতিক [নভেম্বর ১৯৬৩] গেমস অব দ্য নিউ ইমার্জিং ফোর্সেসে [জিএএনইএফও] সবাই একসঙ্গে থাকতে সক্ষম হয়েছিল। সুকর্ণ যখন পাকিস্তান সফর করেছিলেন এবং রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের সঙ্গে তাদের বিখ্যাত বিবৃতি জারি করা হয়েছিল। 

আরেকটি বিষয় হলো আমরা ধারাবাহিকভাবে সমর্থন করেছি যে কাশ্মীর সমস্যাটি সরাসরি ভারত-পাকিস্তান দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা উচিত। বর্তমানে আপনারা শুধু কাশ্মীর সমস্যার মুখোমুখি নন, আমরাও তথাকথিত লাদাখ সমস্যার মুখোমুখি। ভারত কেবল আক্রমণ ও দখল করতে চায় না, বরং আকসাই চিন অঞ্চল অর্থাৎ তাদের তথাকথিত লাদাখও দখল করতে চায়। তারা এখনো কাশ্মীর পুরোপুরি দখল করেনি, বর্তমানে তারা এর একটি অংশ দখল করেছে। আকসাই চীনের ক্ষেত্রে, তারা কখনো এতে প্রবেশ করেনি। যদিও বর্তমানে, তারা এটি দখল করতে চায়। ঠিক এ কারণেই গত বছরের সংঘাতের সূত্রপাত হয়েছিল। আপনারা চান আমরা কাশ্মীরের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের অবস্থানকে সমর্থন করি, কিন্তু বাস্তবে আমাদের পদক্ষেপ এরই মধ্যে এর বাইরে চলে গেছে। আমরা আপনাদের সঙ্গে চীন-পাকিস্তান সীমান্ত সমস্যার সমাধান করেছি। বিশ্বের মানুষ এটা বুঝতে পেরেছে এবং এটা ইঙ্গিত দেয় যে আমরা স্বীকার করছি, এ অঞ্চলটি আপনাদের। যদিও আন্তর্জাতিক আইনের শর্তের কারণে অনেক কিছু অব্যক্ত রয়ে গেছে। রাষ্ট্রদূত রাজা এটি জানেন। কিন্তু সার্বভৌমত্বের এখতিয়ারের বিষয়টি নিষ্পত্তি হওয়ার পরে আমরা আবার এ বিষয়ে কথা বলব।

কিন্তু কাশ্মীর কীভাবে আত্মনিয়ন্ত্রণকে উপলব্ধি করতে পারে? সশস্ত্র বাহিনী ব্যবহার করা কোনো বিকল্প নয়। এখানে কেবল একটি পদ্ধতি রয়েছে। এটি কেবল আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যেতে পারে। আপনি কি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের বিরোধী নন? ভারত-চীন যুদ্ধের কী হবে? 

নেহরু আমাদের এ যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন। যদিও আপনারা সিয়েটো ও সেন্টোর অন্তর্ভুক্ত। আমরা সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অন্তর্ভুক্ত; সীমান্ত ইস্যুতে আমরা একই যুদ্ধের লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের গৃহীত পদক্ষেপ বিমূর্ত বিবৃতির চেয়ে সুবিধাজনক। কেন? যদি আমরা বলি, আমরা কাশ্মীরের জনগণের জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণকে সমর্থন করি। ভারত কেবল জিনজিয়াংয়ের আকসাই চীন অঞ্চলের জনগণের জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দেবে। ফলে তিব্বতের জন্য একই বিষয় উত্থাপন করা হবে। এই দুটোই আমাদের এলাকা, কেন তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত? এটি একটি পৃথক বিষয়। প্রকৃতপক্ষে জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার জাতিসংঘের সনদে স্পষ্টভাবে নির্ধারিত হয়েছে। জাতিসংঘও বিমূর্ত নীতির একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। আমরা জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের এ বিমূর্ত নীতিগুলোকে ধারাবাহিকভাবে সমর্থন করেছি। তবে এ সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্য সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের ওপর নির্ভর করা প্রয়োজন। এর চেয়ে আমাদের ভারতের আগ্রাসনের বিরোধিতা করা সবচেয়ে দৃঢ় এবং কার্যকর।

ভাসানী: আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের বিষয়টি আসলে নেহরুর সরকারই প্রথম জাতিসংঘে উত্থাপন করেছিল, পাকিস্তান জাতিসংঘে বিষয়টি উত্থাপন করেনি। এশিয়ার দেশগুলোর সম্মেলনের পরে আমি ভারতে গিয়েছিলাম এবং নেহরু আমাকে বলেছিলেন, ‘‌দেখুন, কাশ্মীর সমস্যাটি প্রথমে সমাধান করা খুব সহজ ছিল। কিন্তু এখন, আপনার সরকারের পশ্চিমের সঙ্গে সংহতি এবং প্রতিক্রিয়াশীল বৈদেশিক নীতি সমস্যাটিকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে।’ পাকিস্তানে ফিরে আসার পর, আমি আমার সরকারের কাছে একটি স্বাধীন বৈদেশিক নীতি বাস্তবায়নের প্রস্তাব রেখেছিলাম। কিন্তু এখন, নেহরু এরই মধ্যে তার কথা থেকে সরে এসেছেন।

চৌ এন-লাই: এসব নেহরুর অজুহাত। আপনার বন্ধু অবিশ্বস্ত। তিনি আমাদেরও বন্ধু। রাষ্ট্রদূত রাজাও এসব জানেন। যখন তিনি প্রথম আপনার রাষ্ট্রদূত হিসেবে চীনে এসেছিলেন, তখন তিনি আমাদের বলেছিলেন, নেহরু অবিশ্বস্ত। সেই সময়, প্রতি উত্তরে একই কথা বলেছিলাম, যা আপনি সবেমাত্র বলেছেন। ঘটনাগুলো প্রমাণ করে যে নেহরুর কথাগুলো সবই অর্থহীন। সাংবাদিকদের সঙ্গে তার কথোপকথনের রেকর্ডগুলো পড়ে দেখা যায় যে কয়েকদিন পরে তিনি যা কিছু বলেছেন তার সবকিছুরই সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়েছে। একজন এশীয় রাজনীতিবিদ একবার আমাকে বলেছিলেন, নেহরুর চিন্তাভাবনা ব্রিটিশদের মতোই। নেহরু নিজেই বলেছিলেন, আমি ভারতীয় বলার পরিবর্তে, এটা বলা ভালো হবে যে আমি একজন ইংরেজের মতো।"আপনি কি বিশ্বাস করেন যে ১৭ বছর জেলে থাকার পর তিনি সত্যিই সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করতে পারতেন? ঠিক এখানেই যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ব্রিটেন বেশি চালাক। একদিকে তিনি কারাগারে ছিলেন, অন্যদিকে তিনি একজন সক্ষম ও চতুর মানুষ হিসেবেও প্রশংসিত হয়েছিলেন। এমনকি মাউন্টব্যাটেন তার সঙ্গে বন্ধুত্বও করেছিলেন। যদিও নেহরুকে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল, তবুও তিনি ব্রিটেনকে একেবারেই ঘৃণা করেন না এবং কেবল বলেন যে তিনি স্বাধীনতা চান। তিনি যা চান তা হলো একটি মহান ভারতীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা। তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা অপরিসীম। আপনি নিশ্চয়ই তার ‘‌দ্য ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ বইটি পড়েছেন, তাই না? এখনো পরিষ্কার নয়?

চেন ই: আপনার বন্ধু নেহরুকে আমরা সত্যিই বিশ্বাস করি না।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন