দেশের ক্রেডিট কার্ড বাজারের ২৩ শতাংশ সিটি ব্যাংক একাই নিয়ন্ত্রণ করে

ছবি : বণিক বার্তা

দেশে ক্রেডিট কার্ডের বাজার কেমন?

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত দেশের মোট ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা ছিল ২৩ লাখ ৯৮ হাজার। আগের বছরের সঙ্গে তুলনা করলে এ সংখ্যা ১৩ শতাংশ বেশি। ব্যাংকগুলো গত বছর মাসে নতুন ক্রেডিট কার্ড বিক্রি করেছে ৩৫-৪০ হাজার করে। এ মুহূর্তে ক্রেডিট কার্ডের ঋণের স্থিতি ৯ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। এটা গত বছরের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু এখনো এটা ব্যাংক খাতের মোট ঋণ স্থিতির ১ শতাংশও হতে পারেনি। হয়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ৬২ শতাংশ। আর কার্ডে লেনদেনের কথা যদি বলি—২০২৩ সালে ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহকরা মাসে গড়ে ২ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা লেনদেন করেছেন। এর মধ্যে ১৫ শতাংশ ট্র্যানজ্যাকশনই ঘটেছে দেশের বাইরে। এ খরচ ২০২২ সাল থেকে প্রায় ১০ শতাংশ বেড়েছে, সেটাও একটা লক্ষ করার মতো বিষয়। কভিডের পরে—কভিডকালীন হঠাৎ থেমে থাকার পরে—বিদেশ ভ্রমণ ও কেনাকাটা, সবই বাড়ছে।

জনসংখ্যার অনুপাতে ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা খুবই কম মনে হয় না?

অবশ্যই কম। আগেই বলেছি, এ দেশে মোট ক্রেডিট কার্ড ২৩ লাখ ৯৮ হাজার। কিন্তু এর মধ্যে প্রাইমারি কার্ড আছে এর মাত্র ৬০ ভাগ বা ১৪ লাখের মতো। একই মানুষের ওয়ালেটে যেহেতু একাধিক ব্যাংকের কার্ড থাকে, তাই প্রকৃত প্রাইমারি ক্রেডিট কার্ডহোল্ডার কিন্তু ৮-৯ লাখের বেশি হবে না। একটা বিদেশী কনসালট্যান্সি প্রতিষ্ঠানের হিসাব অনুযায়ী—যে হিসাব এশিয়ার অন্য কিছু সমমানের দেশের সাপেক্ষে করা—আমাদের ১৭ কোটি লোকের এবং ৭ কোটি ৩৪ লাখ কর্মক্ষম মানুষের এ দেশে কমপক্ষে ৮০ লাখের কাছে ক্রেডিট কার্ড থাকা উচিত ছিল।

এ বাজার সম্প্রসারণ সম্ভব হচ্ছে না কেন?

অনেকগুলো কারণে এ বাজার সম্প্রসারণ সম্ভব হচ্ছে না। প্রথমত, ২০২২ সালের জুলাই থেকে ক্রেডিট কার্ড পাওয়ার জন্য আয়কর রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। এ সিদ্ধান্তের ফলে ক্রেডিট কার্ড নেয়ার সম্ভাব্য গ্রাহকসংখ্যা একবারে ৮০ লাখ থেকে ৩০ লাখে নেমে এসেছে। সত্যিকারের ক্যাশলেস সোসাইটি নির্মাণে ক্রেডিট কার্ডের বাজার বাড়ানোর বিকল্প নেই। তাই এক্ষেত্রে আমাদের দরকার নীতি সহায়তা। এছাড়া আরো কিছু নেগেটিভ ফ্যাক্টর আছে। যেমন ক্রেডিট কার্ড নিয়ে মানুষের সাধারণ ভীতি, ঢাকা-চট্টগ্রামসহ সাতটা বড় শহরের বাইরে ক্রেডিট কার্ড চলার অবকাঠামো বসাতে ব্যাংকগুলোর অনীহা বা আর্থিক অসামর্থ্য, অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করা পেশাজীবীদের ক্রেডিট কার্ড দিতে ব্যাংকের অনিচ্ছা, সার্বিক মন্দ ঋণ কালচার। এসবও ক্রেডিট কার্ডের বাজার বাড়ানোর পথে দেয়াল তুলেছে। তবে সবচেয়ে বড় দেয়াল ওই আয়কর রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা।

বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে মানুষ এখন ক্রেডিট কার্ডের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি অনুভব করছে। এটিকে কাজে লাগানো যায় কীভাবে? 

বাংলাদেশীরা ২০২২ সালে ক্রেডিট কার্ডে বিদেশে খরচ করেন ৩ হাজার ২২২ কোটি টাকা। এ ভলিউমটাই ২০২৩ সালে হয়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ বাংলাদেশীদের বিদেশে ক্রেডিট কার্ডে খরচ এক বছরে বেড়েছে ৪৩ শতাংশ। তার মানে বিদেশ ভ্রমণের বেলায় ক্রেডিট কার্ডের প্রয়োজনীয়তা বা জনপ্রিয়তা সামগ্রিকভাবে বাড়ছে। এর দুটোই প্রধান কারণ। এক. ব্যাংকগুলোর কাছে পর্যাপ্ত ক্যাশ ডলার না থাকা। দুই. ব্যাংকের কাউন্টার থেকে ক্যাশ ডলার না পেয়ে মানি চেঞ্জারদের বা হুন্ডিওয়ালাদের কাছ থেকে যে রেটে ডলার কিনব, তার চেয়ে অনেক কম রেটে বিদেশে ক্রেডিট কার্ডে খরচের বিল পে করতে পারা; অর্থাৎ কার্ডের বিল পেমেন্টে ওদের রেটের চেয়ে অনেক ভালো রেট পাওয়া। এর বাইরে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের আরো কিছু বেসিক সুবিধা তো আছেই। যেমন রিওয়ার্ড পয়েন্টস, ক্যাশব্যাক, ৪৫ দিন পর্যন্ত ক্রেডিট সুবিধা। আবার করোনার বিরতির পর গ্রাহকরা বিদেশেও বেশি যাচ্ছেন। মানুষের লাইফস্টাইল বদলাচ্ছে, নিঃসন্দেহে। সেটাও একটা কারণ যে কার্ডে আমাদের বৈদেশিক ট্র্যানজ্যাকশন বাড়ছে।

সিটি ব্যাংক কীভাবে ক্রেডিট কার্ডের মার্কেট লিডার হলো?

দেশের ক্রেডিট কার্ড বাজারের প্রায় ২৩ শতাংশ সিটি ব্যাংক একাই নিয়ন্ত্রণ করে। আমাদের এ মার্কেট লিডার হওয়ার পেছনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে আমেরিকান এক্সপ্রেসের সঙ্গে সিটি ব্যাংকের সম্পৃক্ততা। আমরাই দেশের একমাত্র ব্যাংক যারা আমেরিকান এক্সপ্রেস কার্ড ইস্যু ও অ্যাকোয়ার করতে পারি। এছাড়া গ্রাহক চাহিদাকে অগ্রাধিকার দেয়া, বেস্ট-ইন-ক্লাস গ্রাহকসেবা ও লয়্যালটি প্রোগ্রাম, ভালো ২৪ ঘণ্টার কল সেন্টার, ভালো কম্পিটিটিভ ভ্যালু, দেশের সবচেয়ে বড় কার্ড মার্চেন্ট নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা, দেশজুড়ে ছড়ানো অনেক বড় কাস্টমার টাচপয়েন্ট, সিটিটাচ ইন্টারনেট ব্যাংকিং দিয়ে কার্ডের অধিকাংশ কাজ সামলাতে পারা, ঢাকা এয়ারপোর্টে মোট তিনটা লাউঞ্জ সুবিধা, ব্যাংকের ব্র্যান্ড ভ্যালু, এসবই আমাদের এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।

গ্রাহকদের কয় ধরনের ক্রেডিট কার্ড দিচ্ছেন?

আমরা যেহেতু আমেরিকান এক্সপ্রেসের (অ্যামেক্স) একমাত্র লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যাংক, তাই আমাদের প্রডাক্ট অফারিংয়ের সবচেয়ে বড় অংশই আছে এ নেটওয়ার্কে। অ্যামেক্স সেঞ্চুরিয়ন লাইনে আমাদের ধনী গ্রাহকদের জন্য রয়েছে অ্যামেক্স প্লাটিনাম কার্ড। এরপর অতিসচ্ছল গ্রুপের জন্য আছে অ্যামেক্স গোল্ড কার্ড আর সাধারণ মধ্যবিত্ত সেগমেন্টের জন্য আছে অ্যামেক্স ব্লু কার্ড। অ্যামেক্স সেঞ্চুরিয়ন বাদে আমাদের অ্যামেক্স ব্লু-বক্স লাইনে আছে নারীদের জন্য স্পেশালাইজড কার্ড ‘সিটি আলো অ্যামেক্স কার্ড’, গ্রোসারি শপারদের জন্য ‘অ্যামেক্স আগোরা কো-ব্র্যান্ড কার্ড’, ফ্রিকোয়েন্ট ফ্লায়ারদের জন্য ‘বাংলাদেশ বিমান-অ্যামেক্স কো-ব্র্যান্ড কার্ড’ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাই ও শিক্ষকদের জন্য ‘ঢাকা ভার্সিটি-অ্যামেক্স কো-ব্র্যান্ড কার্ড’। আর ভিসা নেটওয়ার্কে আমাদের আছে ভিসা প্লাটিনাম ক্রেডিট কার্ড। সামনে আরো বড় চমক আসছে অ্যামেক্স ও ভিসা, দুই নেটওয়ার্কেই। দ্রুতই এ বিষয়ে চমকপ্রদ ঘোষণা আসবে। 

আপনাদের ক্রেডিট কার্ডের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলো কী?

আমাদের কার্ডের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো প্রডাক্ট ও সেগমেন্টের যথাযথ ম্যাচিং। প্রতিটি সেগমেন্টের ইউনিক চাহিদাগুলো বিবেচনা করে আমাদের প্রডাক্টগুলো ডিজাইন করা। আমরা হিসাব করে দেখেছি যে কিছুটা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কার্ড ব্যবহার করলে গ্রাহকরা কার্ডের যে অ্যানুয়াল ফি পেমেন্ট করেন, বছরে তারা তার থেকে ৪-৫ গুণ বেশি বেনিফিট কার্ড থেকেই তুলে নিতে পারেন। গত বছর আমি নিজেই সেটা নিয়েছি। এ ব্যাপারটা অংক, এখানে কারো দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই। এছাড়া আমরা শুধু বেসিক কার্ড প্রডাক্ট চালু করেই বাজারে ছেড়ে দিই না, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কয়েক মাস পর পরই কার্ডের ভ্যালু প্রোপজিশনগুলো আমরা রিভিউ করে থাকি। যেমন ২০২৩ সালেই আমরা অ্যামেক্স সেঞ্চুরিয়ন লাইনের প্রডাক্টগুলো রিভিউ করে ১৫ শতাংশের বেশি কার্ড বিক্রি করতে পেরেছি। এরপর আমাদের কার্ডের দেশসেরা গ্রাহকসেবার মানের কথা বলতেই হয়। এটার কারণে আমাদের নিট প্রমোটার স্কোর (এনপিএস) ঈর্ষণীয় লেভেলে আছে। অনেকে জেনে অবাক হন যে শুধু কার্ডের সেবা দেয়ার জন্যই আমাদের আছে ৬টা ফিজিক্যাল সার্ভিস সেন্টার, যা দেশের অন্য কোনো ব্যাংকের নেই। এর বাইরে দেশজুড়ে ২৮টা ব্রাঞ্চে বসছে আমাদের ডেডিকেটেড কার্ড অ্যাম্বাসেডররা। আর মার্কেট লিডার হওয়ার নিয়ামকগুলোর কথা তো আগেই বলেছি।

রমজান ও ঈদুল ফিতর উপলক্ষে গ্রাহকদের জন্য কী ধরনের অফার দিচ্ছেন?

প্রতিবারের মতো আমরা এবারো রমজান ও ঈদুল ফিতর উপলক্ষে গ্রাহকদের জন্য বিশেষ অফার এনেছি। এবার প্রায় সব ক্যাটাগরিতেই দিচ্ছি এ অফার। এর মধ্যে প্রধান ক্যাটাগরিগুলো হলো ইফতার ও ডিনার বা এককথায় ডাইনিং; তারপর ট্রাভেল, গ্রোসারি, লাইফস্টাইল, জুয়েলারি, অনলাইন শপিং। অফারগুলোর মধ্যে আছে সেভিংস অফার, ক্যাশব্যাক, এক্সিলারেটেড মেম্বারশিপ রিওয়ার্ড পয়েন্ট, বাই ওয়ান গেট ওয়ান ফ্রি নানা কিছু। সিটি ব্যাংকের এ রমজান ও ঈদের সব অফারের সব তথ্য পাওয়া যাবে একটা মাইক্রো সাইটে: www.citybankplc.com/ramadan202। এ সাইটে যাওয়ার অনুরোধ রেখে আমার তরফ থেকে অগ্রিম ঈদ শুভেচ্ছা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন