উত্তম তালুকদার ও সময়ের চিত্রভাষা

আলম খোরশেদ

লাভ দ্য লাইনস অ্যান্ড মাই কালার-১

অনেকদিন পর চট্টগ্রাম শহরে একটা উল্লেখযোগ্য ও পরিপূর্ণ চিত্র প্রদর্শনী দেখার সুযোগ হলো। আমি গত ২৭-৩১ অক্টোবরের পর্যন্ত চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমির জয়নুল আবেদিন গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত শিল্পী উত্তম তালুকদারের ‘সময় ও আমার শিল্প’ শীর্ষক একাদশতম একক চিত্রপ্রদর্শনী কথা বলছি। প্রদর্শনী পরিকল্পনা, বিষয় নির্বাচন, সে অনুযায়ী শিল্পকর্মের সৃজন থেকে শুরু করে তাদের বিন্যাস ও উপস্থাপনা, সুমুদ্রিত স্মরণিকা প্রকাশ এমনকি সুচিন্তিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন—সব মিলিয়ে পুরো প্রদর্শনীটি এমন এক নিটোল পূর্ণাঙ্গতা অর্জন করে, যা প্রশংসার দাবিদার ও অভিনন্দনযোগ্য বটে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালে এরই মধ্যে দশটি একক এবং দেশে-বিদেশে আরো অসংখ্য দলগত প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ শিল্পী উত্তম তালুকদার। 

উত্তম তালুকদার অ্যাক্রিলিক, জলরঙ, ড্রইং, মিশ্রমাধ্যম, ভাস্কর্য ইত্যাদি মাধ্যমেই কাজ করতে সিদ্ধহস্ত; তবে বর্তমান প্রদর্শনীতে অন্তর্ভুক্ত চিত্রগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে নজর কাড়ে ক্যানভাসের ওপর যুগপৎ কলম ও অ্যাক্রিলিকের ছোট-বড় কাজ। ক্যানভাসের ওপর কলমের কাজ করা এমনিতেই বেশ দুরূহ, যার জন্য ব্যবহার করতে হয় এক বিশেষ ধরনের সূক্ষ্ম ফলাবিশিষ্ট কলম, যার নিয়ন্ত্রিত আঁচড়ে ক্যানভাসের শরীরে ফুটিয়ে তুলতে হয় নানাবিধ আকার ও রেখার উদ্ভাস। তবে উত্তম শুধু এটুকু করেই ক্ষান্ত হন না, তার মধ্যে হালকা ও কোমল কিছু রঙের আভাস ফোটাতেও সক্ষম হন তিনি। এ প্রসঙ্গে বিশেষ করে একটি চিত্রকর্মের কথা উল্লেখ করতেই হয়। সেটির নাম তিনি রেখেছেন Launch Time। ছয় ফুট দৈর্ঘ্য ও পাঁচ ফুট প্রস্থবিশিষ্ট এ বড় কাজকে তিনি বেশ কয়েকটি চতুষ্কোণ ক্ষেত্রে ভাগ করে নেন, তারপর সেগুলোকে তার সেই অলৌকিক কলমের টানে ক্রমে ভরে তোলেন নানা আঙ্গিক ও অবয়বে। এর মধ্যে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় প্রাণ ও প্রকৃতি, মানুষ ও প্রাণী, ভাবনা ও বস্তুবিশ্বের বিবিধ উপকরণ। এত সূক্ষ্ম, বিশদ ও বহুমাত্রিক তার এ চিন্তা-উদ্দীপক চিত্রকর্মটি যে বহুক্ষণ এর দিকে অভিনিবেশ সহকারে তাকিয়ে থাকতে হয়। 

তার এসব চিত্তাকর্ষক কলমের কাজগুলোয় আমরা যেমন এক ধরনের জটিল, জঙ্গম ও ধূসরাভ জগতের ছায়াপাত দেখি, তেমনি তার জলরঙে আঁকা ছবিগুলোয় পরিস্ফুট অন্য রকম এক মায়াবি বর্ণের উদ্ভাস, কমনীয় আকারের কোমল বিন্যাস এবং কম্পোজিশনের সারল্য আমাদের চৈতন্য ও অনুভূতিকে স্পর্শ করে। Reflection of Time সিরিজের কাজগুলোর কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, যেসবের বর্গাকার ও বৃত্তাকার চিত্রপটে শিল্পী যেন জীবনের জটিলতা নয়, বরং তার শাশ্বত সৌন্দর্য ও ভালোবাসার অভিব্যক্তিকেই রঙে ও রেখায় বাঙ্ময় করে তোলেন। এ কাজগুলোতেও আমরা চিত্রপটকে একাধিক আয়ত ক্ষেত্রে ভাগ করে নিয়ে তুলির ভাষায় জীবনের আটপৌরে গল্প বলার প্রবণতা লক্ষ করি আমরা, যা আমাদের বাংলার ঐতিহ্যবাহী পটচিত্রের কথা মনে করিয়ে দেয়। 

উত্তম বড় ক্যানভাসে বহুবিধ উপাদান ও উপলব্ধির সমন্বয়ে এপিকধর্মী কাজেও সমান স্বচ্ছন্দ। সেসব চিত্রপটে একদিকে যেমন মানব-মানবীর সম্পর্কের জটিল রসায়নকে বর্ণিত হতে দেখি আমরা, তেমনি প্রাণ ও প্রকৃতির আন্তঃসম্পর্ক বিষয়েও সচেতন ও সংবেদনশীল মনে হয় শিল্পীকে, সর্বোপরি সেখানে আধুনিক নগরজীবনের নানাবিধ সংকট, সংঘাত, হতাশা, বিচ্ছিন্নতাবোধ এবং কুটিল ভূরাজনীতির নির্মম আগ্রাসনের বহিঃপ্রকাশও দেখতে পাওয়া যায়। Transformation of Love into the Feeling of Man and Nature নামক বৃহৎ আঙ্গিকের কাজটিতে এ সময় ও সমাজের প্রকৃত চেহারাটিকেই যেন উঁকি দিতে দেখি আমরা, শিল্পীর ব্যবহৃত বিবিধ চিত্রকল্প, রূপক ও বস্তুসংস্থানের ভেতর থেকে।

সব মিলিয়ে শিল্পী উত্তম তালুকদার নিঃসন্দেহে আমাদের সমকালীন শিল্পাঙ্গনের একজন প্রেরণাসঞ্চারী প্রতিনিধি, যার স্বকীয় শিল্পভাবনা ও সমৃদ্ধ শিল্পভাষার সামগ্রিক ইতিবাচকতাকে উদযাপন করা জরুরি। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন