মবিনুল আজিম

ক্যানভাসে উচ্ছল যে আত্মা

ওয়াহিদ সুজন

শৈল্পিক প্রয়াসে ভাবের স্বতঃস্ফূর্ত আবির্ভাব অনুভবের ধরনটাই পাল্টে দেয়। যেমন প্রকৃতি প্রকাশে সহজ ও চিরায়ত। একই ঘটনা বারবার ঘটেও সতত নতুন। আমাদের আত্মা যেন তার অনুকৃতি। জুতসই উদাহরণ হিসেবে মবিনুল আজিম বলছেন, যেভাবে গাছে ফুল ফোটে সেভাবেই কবির ঠোঁটে আসা উচিত কবিতা। একইভাবে এক বাতিনি বাধ্যবাধকতা তাকে রঙের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করতে অনুপ্রাণিত করে। ঔজ্জ্বল্যের প্রতি মবিনুলের তুমুল আকর্ষণ—প্রকৃতি থেকেই তো পাওয়া। প্রকৃতির উচ্ছলতা ছিল তার আয়ত্তে। প্রকৃতির জ্যামিতিক বিন্যাসও হয়নি তার চোখের আড়াল।

বিষয়টি তিনি এভাবে বর্ণনা করেন, আমি প্রকৃতিপ্রেমিক। আমি বড় হয়েছি প্রকৃতির মাঝে আর তাই প্রকৃতির রহস্য থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছি। আমি চাই আমার কাজগুলো হবে একটি উদ্ভিদের বেড়ে ওঠার নানা ধাপের মতো। শেষ ধাপে পূর্ণতা পাবে, যেভাবে ফুটে ওঠে একটি ফুল। ক্যানভাসে যে ছবিটি আপনারা দেখবেন সেটা হলো আমার কাজের পূর্ণ রূপ। ওটা একজন শিল্পীর পুরো জীবনের পরিশ্রমের ফল। আমার মনে হয়, প্রকৃতি আমার কাজগুলোকে তার রঙ-রূপ, সজীবতা আর সারল্য দিয়ে সজ্জিত করেছে। 

প্রকৃতি আচ্ছন্ন মবিনুল আজিম মারা গেছেন ১৯৭৫ সালের ১ নভেম্বর, ঢাকায়। জন্ম ১৯৩৪ সালের ২৪ নভেম্বর, বিক্রমপুরে। আর এই ৪১ বছর জীবনের প্রায় ১৬ বছর ছিলেন তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে। সময় তো দূরত্ববিশেষ। তাই ভাবা অস্বাভাবিক নয় যে জনপরিসরে তাকে নিয়ে আলাপ বা চর্চা ততটা হওয়ার কথা নয়। সত্য হলো, অনেকেই তাকে আজও স্মরণ করেন। কারণ তার প্রাণোচ্ছল চিত্রভাষ্য, যা তাকে স্বতন্ত্র করেছে। 

যতদূর ধারণা করা যায়, মবিনুল আজিম উপলব্ধির তরতাজা সারমর্মকে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। আপতিক অনুভূতি; যার প্রাণবন্ত মেজাজ স্বল্পায়ুর। সেই মেজাজ ব্রাশস্ট্রোক ও রঙে মূর্ত করেছিলেন মবিনুল। যেটা শিল্পের চিরকালীনতার মধ্যে চিরস্থায়ী হয়ে গেছে। মনোজগতের স্বতঃস্ফূর্ততা ধরা যায়, আবার যায় না। আনন্দ, ক্ষোভ ও আকাঙ্ক্ষা বরাবরই অস্পষ্ট। মবিনুলের নারীদের ঈর্ষা বা অপেক্ষা তো দীর্ঘায়ুই পেয়ে গেছে। যদিও ক্যানভাসে পুনরুৎপাদন বা গতি ও স্থিতির ফারাকের ভেতর এসব অনুভূতি শনাক্ত করা বেশ কঠিন। এ সক্ষমতার জন্য সমকালে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছিলেন তিনি। 

ব্রিটিশ ইন্ডিয়া ভাগের পর বাংলার প্রকৃতি ও তার মানুষ সদ্য স্বাধীন দেশে চিত্রকলায় বিশেষ স্থান করে নেয়। আত্মাবিষ্কারের এ পর্বে বিশ্বের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে পড়তে চান শিল্পীরা। যারা সমাজের অগ্রবর্তী অংশ। ওই সময় আন্তর্জাতিক ভাব ও আঙ্গিক তাদের কাজে বিশেষ ভূমিকা রাখে। সমসাময়িক ধারায় আধুনিক হয়ে ওঠার কালে ব্যক্তিসত্তার স্ফূরণের ভেতর দিয়েই তো যেতে হয়। সেদিক থেকে মবিনুল আজিম আধুনিক ভাবধারাকে বেছে নিয়েছিলেন। হ্যাঁ, হয়তো মাটির টাটকা গন্ধটুকু পাওয়া যাবে না, কিন্তু বাংলা এসেছে প্রথার আবরণ ভেঙে। 

মবিনুল নিজেকে ভেঙেছেন। কিন্তু প্রকৃতিকে ছেড়ে যাননি কখনো। শিল্পীজীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে প্রকৃতি তার কাজের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। প্রাকৃতিক উপাদানের পাশাপাশি রঙ ছিল তাকে আলাদা করার একটি প্রধান দিক। নারীর ফিগার আসে নতুন দ্যোতনা নিয়ে। কম্পোজিশনেও ছিলেন ব্যতিক্রমী। স্থানে বস্তুর আবির্ভাবে প্রকৃতির মিথস্ক্রিয়ার ধারা আত্মস্থ করেন। অন্ধকার ও আলোর পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল দুনিয়াবি চিহ্ন। তার প্রকৃতি, জেলে, নৌকা ও নারী আমাদের পরিচিত দুনিয়ার স্থিতি ও গতির ফারাককে অতিক্রম করে যায়।

মবিনুল আজিম প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের হাতে গড়া গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটস তথা বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে। ১৯৫১ সালে তৃতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থী তিনি, যখন ভাষা আন্দোলনের উত্তাল সময় পার করছে পূর্ব পাকিস্তান। পরের বছরই ভাষা আন্দোলনে তুমুলভাবে সক্রিয় হন। ১৯৫৫ সালে স্নাতক সম্পন্ন করেন। এরপর মবিনুলের কর্মজীবনের বেশির ভাগ অংশ অর্থাৎ ১৯৫৭ সাল থেকে প্রায় ১৬ বছর পাকিস্তানের করাচিতে কেটেছে। এটা এমনই এক সময় যখন পাকিস্তানের শিল্পী, কবি, লেখক ও ঔপন্যাসিকদের কেন্দ্রস্থল ছিল বন্দর শহরটি। সেখানে আঁকাআঁকিতে সুফলা সময় কাটিয়েছেন, পাশাপাশি পড়িয়েছেন আর্ট ইনস্টিটিউটে। 

শুরু থেকে দেখলে আমরা জানতে পারি, প্রথম দিকের ছবিগুলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ছাপ বহন করে। বস্তুধর্মী। তবে ছাত্র থাকতেই স্টিল লাইফের প্রতি বিরাগ ছিল তার। শুরু থেকে রঙ নিয়ে খেলা করার ঝোঁক ছিল। লাল ও কালো ছিল প্রিয়। বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন মানুষ ও জনপদ, বাংলার প্রকৃতি ও ঋতুবৈচিত্র্য। মাধ্যম হিসেবে জলরঙকেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন, তবে তেলরঙ ও কালি-কলমে ছবি এঁকেছিলেন। বস্তুধর্মী ছবি আঁকার প্রেরণায় জেলে ও মেথরদের সঙ্গে বসবাস করেছেন একসময়। 

১৯৫০ ও পরের দশকে ইমপ্রেশনিজম ও এক্সপ্রেশনিজম ধারা পূর্ব পাকিস্তানে জনপ্রিয়তা লাভ করে, যার সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করেন মবিনুলও। এ সময় ঢাকার চিত্রকলার জগতে আমিনুল ইসলাম, হামিদুর রহমান ও মোহাম্মদ কিবরিয়ার বিমূর্ত চিত্র বিশেষ এক ঘটনা। এর আগে বস্তুকে অবলম্বন করে রঙের খেলা দেখালেও এবার নির্বস্তুকভাবে ব্যবহার করতে থাকেন মবিনুল আজিম। এক পর্যায়ে আগের আঁকা শখানেক ছবি পুড়িয়ে ফেলেন। তবে বিমূর্ততা কখনো তার গন্তব্য ছিল না। একধরনের মিশ্ররীতিতে নিজের কাজটুকু করে যান। সেখানে ক্যানভাসকে পুরোপুরি নৈর্ব্যক্তিক করে দেননি। বিমূর্ত ছবির পেছনে উঁকি দেয় আদল ও অবয়ব। মেজাজেও রোমান্টিক ও রোমাঞ্চকর। এ পর্বে শুধু আপতিক অনুভূতিই নয় আরো কিছু বৈশিষ্ট্য আজিমের পেইন্টিংকে অনন্য করে তুলেছিল। আলো-অন্ধকারের সঙ্গে মিশ্রিত রূপ ও রঙের আছে নিজস্ব ভারসাম্য। বাস্তবতাকে কাটাছেঁড়া করে ক্লান্ত হননি তিনি। বরং জীবনের বৃহত্তর আঙ্গিক খুঁজেছেন। যার কারণে প্রথাগত নানা পথে হেঁটেও নতুনভাবে নিজেকে সন্ধান করেছেন। 

এ এক ধারাবাহিক সফর। আগে যদি তিনি ইমপ্রেশনিস্ট ও এক্সপ্রেশনিস্টদের পথ ধরে থাকেন, তবে পরে ধরলেন অ্যাকশন পেইন্টিংয়ের পথ। অবশ্য ব্যাকরণ মেনে মবিনুল আজিমের ছবিকে অ্যাকশন পেইন্টিং বলতে নারাজ অনেকে। ১৯৬৬ সালে ঢাকায় একক প্রদর্শনীতে তা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পাকিস্তান অবজারভারে সমালোচক বলছিলেন, অ্যাকশন পেইন্টার হিসেবে যদি স্কটিশ চিত্রশিল্পী ক্যারেল অ্যাপেলের মানদণ্ড অনুসরণ করতে হয়, তবে আজিমকে একজন খাঁটি অ্যাকশন পেইন্টার বলা খুব কঠিন হয়ে পড়বে। তিনি অনেক বেশি নিয়ন্ত্রিত, কম জোরালো ও খুব হিসাবি। রঙের বাহুল্য ও অযৌক্তিক ব্যবহারের ঝোঁক নেই তার। নিজের কাজ সম্পর্কে নিশ্চিত থাকতে চান। তাৎক্ষণিক ছাপ ও আবেগ তুলে ধরতে আগ্রহী। যেখানে জ্যামিতিক বক্ররেখা বৈশিষ্ট্য হিসেবে প্রভাবশালী। অর্থাৎ, কাজের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ ও দক্ষতার ছাপটুকু স্পষ্ট।

জীবদ্দশায় ১৭টি একক ও ৩৭টি দলগত প্রদর্শনীতে অংশ নেন মবিনুল। প্রথম দ্বৈত প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় ১৯৬১ সালে। পশ্চিম পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, নেপাল, ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে তার ৪০টি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় এবং ১৪টি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশে। মরণোত্তর একক ও যৌথ প্রদর্শনীতে স্থান পায় তার চিত্রকর্ম।

মবিনুলের আর্টিস্টিক সেনসেবিলিটি তাকে প্রথাগত শিল্প উপকরণের বাইরে যেতে বাধ্য করেছে। বালি, সিমেন্ট, কাপড়, নাইলনের জাল, পাটসহ নানা উপকরণের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেন জীবন ও প্রকৃতি। রঙ করার ক্ষেত্রে শুধু ব্রাশ ও প্যালেট ছুরিই ব্যবহার করেননি, আঙুলের চাপে চিত্রকর্মে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এসব নিরীক্ষা এমন নয় যে উপাদানের বৈচিত্র্যের কারণে চিত্রভাষ্য পাল্টায়, বরং চিত্রভাষ্যে সুনির্দিষ্টতা ও নিপুণতা আরোপে এ ঘটনা ঘটতে পারে। যেভাবে আমরা প্রকৃতিকে সবসময় নতুন রূপে আবিষ্কার করতে পারি। ভিন্ন বস্তুর মেলবন্ধন তো প্রকৃতিতে স্বাভাবিক ও সরল ঘটনা। মবিনুল আজিম সেই সরলতাকে নিজের মাঝে ধারণ করেছিলেন, যার উজ্জ্বল ও উচ্ছল দিকটি এখনো নজর কাড়ে।

শেষ করার কালে মবিনুল আজিমের ভাষ্যে বলা যায়, প্রেমিক ও উপাসক হিসেবে প্রকৃতির সঙ্গে আমার সম্পর্ক। আমি যতই শিশুর মতো তার রহস্য অনুসন্ধান করি, ততই জড়িয়ে পড়ি। যেভাবে পুকুরের পানিতে গাছ প্রতিফলিত হয়, সেভাবে প্রকৃতি আমার হৃদয়ে প্রতিফলিত। আমার মধ্যে প্রকৃতি পুনরায় তৈরি হয়। তার পুনর্জন্ম ঘটে। আর তাতে আমার হৃদয় যুক্ত করে নতুন মাত্রা।


সব তথ্য, বিশ্লেষণ ও ছবি সূত্র: মবিনুল আজিম: কালার্স অ্যান্ড ড্রিমস, বেঙ্গল পাবলিকেশনস

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন