মায়াজগতের রঙ

লাতিন আমেরিকার চিত্রকলা

আলম খোরশেদ

দিয়েগো রিভেরার দ্য ফ্লাওয়ার ক্যারিয়ার। ছবি: রিভেরা ডটওআরজি

নিউইয়র্কস্থ মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট, যার চলতি নাম MOMA, আজ থেকে প্রায় তিন দশক আগে আয়োজন করেছিল লাতিন আমেরিকার চিত্রকলার এক বিশাল ও বর্ণাঢ্য প্রদর্শনীর, যা দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল এ লেখকের। যুক্তরাষ্ট্রের নিকট পড়শি মেহিকো, তার লাগোয়া মধ্য আমেরিকা, দ্বীপরাষ্ট্র কিউবা আর গোটা দক্ষিণ আমেরিকার প্রত্যন্ত ভূগোল ছেনে তারা তুলে এনেছিল লাতিন আমেরিকান চিত্রকলার বিপুল রত্নাবলির ভাণ্ডার। তিনশরও বেশি ছবি ও ভাস্কর্য আর আট দশকের কালসীমাজুড়ে মোট ৯০ জন শিল্পীর একত্র সমাহারে তারা একই গাঁটছড়ায় বেঁধে দিতে পেরেছিল লাতিন আমেরিকার আধুনিক দৃশ্যশিল্পের পিতৃপথিকৃৎ দিয়েগো রিবেরার (১৮৮৬-১৯৫৭) সঙ্গে বিখ্যাত সমকালীন কিউবান ভাস্কর আনা মেনদিয়েতাকে (১৯৪৮-৮৫)। এভাবেই লাতিনো চিত্রকলা সম্পর্কে একটা সামগ্রিক ধারণা গড়ে নেয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল তারা নিউইয়র্কের চিত্ররসিকদের। যদিও জাদুঘর কর্তৃপক্ষের বিনীত স্বীকারোক্তি মতে তারা কেবল এতদঞ্চলের চিত্রকলার প্রধান কিছু ধারা ও সেরা ক’জন চিত্রকরের কাজ সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা দিতে চেয়েছে, গোটা লাতিন আমেরিকান চিত্রভূগোল চেনার জন্য তা মোটেও যথেষ্ট নয়।

প্রদর্শনীর মূল ফোকাস ছিল বিশ শতকের চিত্রকলার ওপর, তাই আমার প্রদর্শনী পরিক্রমা শুরুই হয়েছিল মেহিকোর প্রবাদপ্রতিম বিপ্লবী শিল্পী দিয়েগো রিবেরাকে দিয়ে। চিত্রশালায় ঢুকতেই থমকে দাঁড়াতে হয় তার এক আশ্চর্য সুন্দর ছবির সামনে। ১৯১৫ সালে আঁকা ছবিটির নাম Zapatis ta Landscape :The Guerrilla. এটির অঙ্কনকাল এমন একটি সময়, যখন তিনি পারিতে Picasso, Chagall, Mondrian, Matisse, Leger  প্রমুখ তৎকালীন আভাঁগার্দ শিল্পীদের সান্নিধ্যে আকণ্ঠ ডুবে আছেন; ফলত তাদের দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিতও বটে। ছবিটি স্পষ্টতই কিউবিস্ট ঘরানায় অত্যন্ত আধুনিক আঙ্গিকে আঁকা, কিন্তু জাত বিদ্রোহী রিবেরা বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন মেহিকান কৃষক বিপ্লবের নেতা Emiliano Zapata -এর যুগান্তকারী লোকবিদ্রোহের সামাজিক ও নৈসর্গিক পটভূমিকেই, আর তার মাঝখানে অবলীলায় স্থাপন করে দিয়েছিলেন এক নীল বর্ণের গেরিলাকে। নান্দনিক সৌন্দর্যে উজ্জ্বল ও বিষয়মাহাত্ম্যে ভাস্বর এমন অপূর্ব চিত্রশৈলী কিউবিজমের এক নতুন ব্যাখ্যাই, পিকাসো-ব্রাককে মনে রেখেও বলা যায়, বুঝি হাজির করে আমাদের সামনে। অনেকটা একই ধারার ছবি The Flower Carrier, বিশাল ফুলের ঝুড়ির ভারে নুয়ে-পড়া শ্রমিকের ছবিতে একদিকে যেমন আঙ্গিকের মুন্সিয়ানা নজর কাড়ে, অন্যদিকে রঙ ও রেখার দরদি ব্যবহারে শ্রমজীবী মানুষের প্রতি রিবেরার অকৃত্রিম মমতাটুকু আমাদের হৃদয়কেও ছুঁয়ে যায়। রিবেরা ক্রমে অবশ্য কিউবিস্ট নিরীক্ষার পথ থেকে সরে এসে সরাসরি মেহিকোর সমাজবাস্তবতা ও সাম্যবাদী রাজনীতিকেই তার ছবির মূল প্রণোদনা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন, যার অত্যাশ্চর্য ফসল, আজ মেহিকোর জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃত, তার মহাকাব্যিক ম্যুরালগুলো। প্রদর্শনীর কিছু ছবিতে, বিশেষ করে জাহাজের খোলে ভাসমান দেশান্তরী শ্রমিকের ছবিটিতে, সেই বিশালতার আভাসও পাওয়া গিয়েছিল কিছুটা।

দিয়েগো রিবেরারই স্বদেশী, সমসাময়িক ও সমমনা শিল্পী হোসে ক্লেমেন্তে অরোস্কোর (১৮৮৩-১৯৪৯) বেশ কয়টি মূল্যবান ছবিও অন্তর্ভুক্ত ছিল প্রদর্শনীতে। রুশ বিপ্লব, মেহিকোর কৃষক বিদ্রোহ, জার্মানিতে নাৎসিবাদের উত্থান, ত্রিশের বিপুল বিশ্বমন্দা ইত্যাদির অভিঘাতে মেহিকোর রাজনীতি ও শিল্পে তখন প্রগতিশীলতার জোয়ার এসেছিল। তারই প্রভাবে রিবেরা, অরোস্কো, সিকেইরোস প্রমুখের ছবিতে সমাজবাস্তবতার শিল্পিত প্রকাশ লক্ষ করা যাচ্ছিল ব্যাপকভাবে। ১৯৩১ সালে আঁকা অরোস্কোর ব্যারিকেড এরই এক অপূর্ব দলিল। ছবির আঙ্গিকে মেহিকোর লোকচিত্রকলার প্রভাব স্পষ্ট, কিন্তু তার যুদ্ধবিরোধী আবেদনটুকু বিশ্বজনীন। অরোস্কোর অন্যান্য ছবিতেও শ্রেণী শোষণের নির্মমতা, সংগ্রামের শক্তি ও যুদ্ধের শঙ্কা, ক্লান্তি, বীভৎসতা ইত্যাদি অত্যন্ত তীক্ষ্ণভাবে অনুভূত হয়।

এর পরই যার নাম করতে হয়, তিনিও মেহিকোরই আরেক বহুলপরিচিত নারীশিল্পী, ফ্রিদা কাহলো (১৯০৭-১৯৫৪)। তার ছবি সংখ্যায় অবশ্য খুব বেশি ছিল না, হাতেগোনা ছয়-সাতখানা হবে, কিন্তু বিষয়ের স্বকীয়তায় আর আঙ্গিকের সৌকর্যে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল সবচেয়ে বেশি সেগুলোই। কাহলোর ছবি আমরা জানি অতিমাত্রায় আত্মজৈবনিক। বস্তুত প্রদর্শনীতে অন্তর্ভুক্ত তাঁর ছবিগুলোর সিংহভাগই ছিল আত্মপ্রতিকৃতি। তবে আর সব আত্মপ্রতিকৃতির চেয়ে সেসব একেবারেই আলাদা। আকারে ছোট, তবে বক্তব্যে ভারী। আঙ্গিকে একাধারে মিশেছে লোকশিল্পের সারল্য ও বিমূর্ত আধুনিকতার Self Portrait with Cropped Hair, Self Portrait with Monkey, Self Portrait with Humming Bird ইত্যাদি ছবিতে নারীর যন্ত্রণা, প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ যে তীব্রতা ও তীক্ষ্ণতায় ফেটে পড়ে তা খুব কম শিল্পকর্মেই চোখে পড়ে আমাদের। ফ্রিদার নিজের শরীরের নিঃসংকোচ ব্যবহার ও অনুভবের এমন সংরক্ত উপস্থাপনার মধ্যে এ যুগের ফেমিনিস্টরা তাই স্বাভাবিকভাবেই খুঁজে পেয়েছেন একজন আদি ও অকৃত্রিম নারীবাদী শিল্পীকে; অন্যদিকে তার প্রতীক ও ইমেজ ব্যবহারে অবচেতনের স্বতঃস্ফূর্ত উৎসারে পরাবাস্তববাদীরাও খুঁজে পান তাদের একজন মেধাবী মিত্রকে। যদিও কাহলো নিজেকে সেভাবে সুররিয়ালিস্ট ঘরানার শিল্পী বলে ভাবতেন না। দিয়েগো রিবেরার প্রেমিকা ও পত্নী, ফ্রিদা কাহলো নিজেও ছিলেন একজন আদ্যন্ত রাজনীতিসচেতন শিল্পী। সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, আদিম শক্তির আধার ফ্রিদা কাহলোর ছবি চাক্ষুষ দেখতে পাওয়া ছিল এ প্রদর্শনীর আরেকটি বড় প্রাপ্তিযোগ।

এ পর্যন্ত উল্লিখিত তিনজন চিত্রকরই মেহিকোর হওয়ায় ধারণা হতে পারে লাতিন আমেরিকার অন্যত্র বুঝি উচ্চাঙ্গের শিল্প ও শিল্পীর প্রসার নেই। একথা সত্যি, মেহিকো লাতিন আমেরিকান শিল্প, সাহিত্য, নাটক, চলচ্চিত্রের একটি প্রধান কেন্দ্র, তবে অন্যান্য অঞ্চলেও বিশেষ করে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, চিলি, কিউবায়ও শিল্পের প্রায় প্রতিটি শাখায়ই গুণে ও মানে উল্লেখযোগ্য কাজ হয়ে চলেছে বরাবরই। চিত্রকলায় যেমন উরুগুয়ের অবস্থান রীতিমতো ঈর্ষণীয়। মন্ড্রিয়ান, মালেভিচ প্রমুখ সংগঠনবাদী-ইউরোপীয় শিল্পীর লাতিন আমেরিকান প্রতিরূপ হুয়াকিন তোরেস গার্সিয়ার (১৮৭৯-১৯৪৯) ছবিতে আঙ্গিকগত আধুনিকতার প্রথম প্রতিধ্বনি শুনতে পাওয়া গিয়েছিল এ মহাদেশের চিত্রকলায়। প্রদর্শনীতে অন্তর্ভুক্ত তার বিখ্যাত ছবি Cons tructive Structure with White Line (১৯৩৩)-এ তার ছাপ সুস্পষ্ট। উরুগুইয়ান রাফায়েল পেরেস বারাদোসের (১৮৯০-১৯২৯) ছবিও স্বকীয়তায় সমান উজ্জ্বল। তার Apartment House, Circus প্রভৃতি ছবির নির্ভেজাল ইম্প্রেশনিজম কামিল পিসারোর কথা মনে করায় প্রায়ই। লাতিন আমেরিকান ছবির জগতে পরাবাস্তববাদীদেরও একটা শক্ত ঘাঁটি রয়েছে। এর প্রধান প্রবক্তা চিলির রবের্তো সেবাস্তিয়ান আন্তোনিও মাতা এচাউরেন (১৯১১-২০০২), নিজেকে যিনি শুধু ‘মাতা’  নামে পরিচয় দিতেই পছন্দ করেন। তার ছবির বিষয় স্বপ্ন-কল্পনার সংশ্লেষণ ও মহাজাগতিক মায়া ও বিভ্রম; প্রদর্শনীতে The Vertigo of Eros (১৯৪৪) ছবিতে এর পরিপূর্ণ বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা যায়। 

সুররিয়ালিজমের আরেক পথিকৃৎ কিউবান-চাইনিজ শিল্পী উইলফ্রেদো লামের (১৯০২-৮২) খাড়া ক্যানভাসের উল্লম্ব রূপবন্ধগুলো সরাসরি আমাদের ইন্দ্রিয়ে এসে আঘাত করে। কিউবার আরেক প্রতিভাবান তরুণ শিল্পী হোসে বেদিয়া (জন্ম ১৯৫৯), যার ১৯৯২ সালে আঁকা Star Comes to Light the Way-কে কর্তৃপক্ষ বেছে নিয়েছিলেন তাদের প্রদর্শনী পুস্তিকাটির প্রচ্ছদ হিসেবে। এ ছবিতে লাতিন আমেরিকার কলম্বাসপূর্ব পর্বের লোকোমোটিফের বুদ্ধিদীপ্ত প্রয়োগ দেখি আমরা। প্রদর্শনীর আরেক উল্লেখযোগ্য ছবি ছিল কলম্বিয়ার ব্যতিক্রমী ভাস্কর ফের্নান্দো বোতেরোর (জন্ম ১৯৩২) রাজনৈতিক স্যাটায়ার The President Family (১৯৬৭), ব্রাজিলের প্রথম আধুনিকা Tarsila Do Amaral (১৮৮৬-১৯৭৩)-এর Antropofagia (১৯২৯) নামে আদিম প্রত্নপ্রতীকী সিরিজটি, আর্জেন্টিনার Xul Solar (১৮৮৩-১৯৬৩)-এর মিনিমালিস্ট চিত্রমালা ও বেনেসুয়েলার শিল্পীদের গতিময় Kinetic Art-গুলো, যার মধ্যে অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় হেসুস রাফায়েল সোতোরের (১৯২৩-২০০৫) Global Wing (১৯৭৬)-এর কথা। 

উরুগুইয়ান শিল্পী তোরেস গার্সিয়া একদা বলেছিলেন, আমাদের মানচিত্র উল্টে দিই চলুন, সারা পৃথিবী দেখুক এটাই আমাদের আসল চেহারা। বস্তুত লাতিন আমেরিকান চিত্রকলার সেই আসল চেহারাখানাই যেন পূর্ণাঙ্গরূপে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছিল আমাদের সেই আশ্চর্য মায়ামেদুর প্রদর্শনীটির মধ্য দিয়ে।

লেখক: শিল্প সমালোচক ও অনুবাদক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন