পাঠ্যবইয়ের রূপশিল্পী হাশেম খান

শিশির কুমার নাথ

হাশেম খান, হাশেম খানের অলংকরণে পাঠ্যপুস্তকের প্রচ্ছদ

জাগতিক বাস্তবতা সম্পর্কে ভালো ধারণা হয়নি যে শিশুটির, সে পাঠ্যবইয়ের ফুল-পাখি আর লতাপাতার ছবিগুলো দেখে পুলকিত হয় বারবার। ছবিগুলো যেন তার কল্পনার জগৎকে নাড়া দেয়, ভালো লাগা তৈরি করে পাঠ্যবইয়ের প্রতি। এভাবেই শিশুটি একদিন বড় হবে, কিন্তু ভুলতে পারবে না শৈশবের মায়া ছড়ানো এসব ফুল-পাখি আর গাছকে। যেমনটা পারেননি মহেশখালীর রেজাউল করিম। স্কুলের পাঠ্যবইয়ে হাশেম খানের আঁকা ছবি দেখে ছবি আঁকার আগ্রহ জন্মে করিমের। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই হয়ে উঠেছেন পুরোদস্তুর চিত্রশিল্পী। এখানেই হাশেম খানের বইচিত্রের বৈচিত্র্য। তার হাতের শৈল্পিক রেখাগুলোই হয়ে ওঠে শিশুর মননরেখা। শিশুর পাঠ্যবইগুলোর অলংকরণে হাশেম খান অনন্য—এ কথা মোটেই অত্যুক্তি নয়। বাংলাদেশে শিশুশিক্ষা ও শিশু চিত্রকলার ক্ষেত্রে তিনিই অগ্রণী ও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন। শিশুচিত্রের সংস্কৃতি তার হাত ধরেই আমাদের সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। লোকজ মোটিফে অলংকৃত এসব চিত্রকর্ম যেন আমাদের প্রকৃতির প্রতিচ্ছবি। শিশুদের স্কুল পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ ও জীবনধারাকে চিনিয়েছেন হাশেম খান। বর্তমানে শিশু চিত্রকলা বাংলাদেশের শুদ্ধ সংস্কৃতিচর্চার একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়।

১৯৮০-৯০-এর দশকে ইলাস্ট্রেশন করা বইগুলো পাঠ্যবইয়ের জগতে ভিন্নতা যোগ করেছিল। ১৯৮৮ সালে প্রথম শ্রেণীর সহপাঠ হিসেবে মুদ্রিত বইটির নাম ছিল ‘‌চয়নিকা’। বইটির মূল্য ছিল ৬ টাকা ৯০ পয়সা। বইয়ের চমৎকার নামের সঙ্গে হাশেম খানের অলংকরণ যোগ করেছিল বিশেষ মাত্রা। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ রঙে বর্ণিল প্রচ্ছদ। সে প্রচ্ছদে আঁকা হাতি, ঘোড়া, ফুল, পাখিগুলো প্রতীকী হলেও অনেকটা সরস, জীবন্ত। হাতি-ঘোড়ার অলংকরণে হাশেম খান হাজার বছরের টেরাকোটা শিল্পের ঐতিহ্যকে তুলে এনেছেন সুনিপুণভাবে। চিত্রকলার লোকজ ধারাও এখানে স্পষ্ট। কালো রঙের ওপর সবুজ রেখা টেনে যে পাখিটা আঁকলেন সেখানেও তিনি রেখেছেন পৃথক বৈশিষ্ট্যের ছাপ। কত সহজে ‘‌দ’ বর্ণটি পাখা মেলে পাখি হয়ে গেল! আবার ‘‌২’ সংখ্যাটি সে পাখির পা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। শিল্পকলায় এমন সারল্যের বড় ভূমিকা রয়েছে। হাশেম খানের কাজ এ সারল্যকে সঙ্গী করেই সম্পন্ন হয়েছে। এসব দৃশ্য ও রঙ শিশুর চোখে পীড়া দেয় না, বরং আকর্ষণ করে দারুণভাবে। শিল্পীর চোখে শিশুরা দেখে চিরন্তন বাংলার নিসর্গ। এসব দৃশ্য শিশুটিকে ভাবতে শেখায়, তার কল্পনার রাজ্যকে প্রসারিত করে, সৃজনশীলতা উন্মোচন করে। ‘‌পালের নাও’ কবিতায় জসীমউদ্‌দীন লিখলেন,

পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও—

তোমার যে পালে নাচে ফুলঝুরি বাও।

সোনার না বাঁধনরে তার গোড়ে গোড়ে,

হীরামন পঙ্খীর লাল পাখা ওড়ে।

কবিতাটির চিত্র অলংকরণে হাশেম খান নদী ও নৌকাকে দেখলেন জসীমউদ্‌দীনের চোখ দিয়ে। লাল রঙের পালতোলা নৌকা আঁকলেন, গলুইয়ে জুড়ে দিলেন পাখির ঠোঁট। নৌকা যেন হীরামন পাখি হয়ে লাল পাখা নিয়ে উড়ছে। এটাই বোধহয় ছবির উপমা! ছবিই যেখানে কবিতার ছন্দ বলে। এজন্যই হয়তো হাশেম খান ‘‌ছবির কবি’।

বাংলাদেশের শিশুরা ষড়ঋতুর বৈচিত্র্যকে জানে হাশেম খানের চিত্র দেখে। তার ‘‌ছবির রং’ রচনায় প্রকৃতির ষড়ঋতুর নানান রঙের চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন লিখেছেন, “স্কুলের পাঠ্যসূচিতে সবচেয়ে প্রিয় বই ছিল বাংলা টেক্সট বইটি। ‘সবুজ সাথী’ নামে বইটির পাতায় পাতায় চাররঙা চমৎকার সব ইলাস্ট্রেশন করেছিলেন হাশেম খান নামের একজন শিল্পী। পাঠ্যবইতে হাশেম খানের আঁকা চার রঙা ছবির কল্যাণেই আমি ঢাকায় বাস করেও বাংলাদেশের ছয়টি ঋতুকে চিনে নিতে পেরেছিলাম। গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ-হেমন্ত-শীত ও বসন্ত—এই ছয়টি ঋতুতে বাংলাদেশের রূপটি কী রকম পাল্টে যায় সেটা আমি হাশেম খানের ছবি দেখেই অনুভব করেছিলাম প্রথম। পরে গ্রামে বেড়াতে গিয়ে হাশেম খানের আঁকা ষড়ঋতুর ছবির সঙ্গে মিলিয়ে আমি অনায়াসে বুঝে নিতাম—এটা শরৎকাল কিংবা এটা বসন্তকাল। এককথায় অজানা-অচেনা একজন হাশেম খানই আমাকে ঋতু চিনিয়েছেন।”

শৈশবকে রাঙিয়ে তোলা এসব পাঠ্যবই বড় হয়েও খুঁজে ফেরেন অনেকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায়ই এসব সুখপাঠ্য বই নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে দেখা যায়। বাংলাদেশে রয়েছেন এসব বইয়ের অসংখ্য সংগ্রাহক। যারা শৈশবের স্মৃতিটুকু আগলে রাখতে চান। তেমনই এক সংগ্রাহক আদ্-দ্বীন উইমেন্স মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ডা. মেছবাহ রনি। বললেন,‘‌‍শৈশবের প্রিয় ছড়াগুলো সবারই মোটামুটি মুখস্থ। কিন্তু স্কুলবইয়ে ছড়ার সঙ্গে আঁকা সেই সব ছবি কোথায় পাব—এটা অন্বেষণ করতে গিয়েই আমার টেক্সটবুক সংগ্রহ শুরু। হাশেম খান স্যার আমাদের সাদাকালো শৈশবকে রঙিন করেছেন, আলোকিত করেছেন। ছবি বা দৃশ্যের মাধ্যমে সরলভাবে উপস্থাপন করেছেন একটা শিশুমনের সরলতা, উচ্ছলতা, দুরন্তপনা, বন্ধন একই সঙ্গে মায়াবী মায়ের মুখ।’ খুলনার এসওএস হারম্যান মেইনার স্কুলের চারু ও কারুকলার শিক্ষক কাকন সরকার বললেন,‘‌‍শৈশবে যে বইগুলো পড়েছি, এখনো চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার পৃষ্ঠাগুলো। চরিত্রগুলো যেন হেসে ওঠে, কথা বলে আমার সঙ্গে। বড় হয়ে জানতে পারি, পাঠ্যবইয়ের সেসব জীবন্ত ছবি যিনি এঁকেছেন, তার নাম হাশেম খান। সুস্পষ্টভাবেই পুরনো পাঠ্যবই সংগ্রহে আমার আগ্রহ তৈরির একমাত্র কারণ দেশখ্যাত শিল্পী হাশেম খানের সহজ-সাবলীল, মায়া জড়ানো ইলাস্ট্রেশন।’

হাশেম খানের পূর্ণ নাম আবুল হাশেম খান। চাঁদপুরের সেকদি গ্রামে জন্ম বরেণ্য এ শিল্পীর। ছবি আঁকার বিষয়টি পেয়েছেন বড় ভাইয়ের থেকে। শৈশব থেকেই ছবি আঁকার প্রতি টান ছিল তার। নানা টানাপড়েনের মধ্যেও ছবি আঁকা চালিয়ে গেছেন। রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘‌কচিকাঁচার আসর’। পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছেন ঢাকা আর্ট কলেজে। ধীরে ধীরে আগ্রহী হয়েছেন প্রচ্ছদ ও অলংকরণে। পরবর্তী সময়ে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন আর্ট ইনস্টিটিউটে। কচিকাঁচাদের জন্য হাশেম খানের রঙতুলি যতটা কোমল ততটাই কঠিন রূপ নিয়েছে সংকটে-সংগ্রামে। ঐতিহাসিক ছয় দফা থেকে ’৭০-এর নির্বাচনী পোস্টার তার হাতে পেয়েছে সংগ্রামের ভাষা। ১৯৭২ সালের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংবিধান গ্রন্থ অলংকরণের শিল্পী হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। বাংলাদেশের শিল্পকলার প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছুটে গেছেন। প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যবইয়ের অলংকরণ ছাড়াও তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে বিষয়ভিত্তিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। এ পর্যন্ত বহুবার বাংলাদেশ জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র কর্তৃক প্রচ্ছদ ও ইলাস্ট্রেশনে শ্রেষ্ঠ শিল্পী হিসেবে পুরস্কার লাভ করেছেন। তার অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ১৯৯২ সালে একুশে পদক ও ২০১১ সালে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করেছে। সম্প্রতি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন।

হাশেম খানের মনন দিয়ে শৈশব রাঙানো যে দৃশ্য আমাদের শিশুমনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা হয়তো মোছা যাবে না কখনো। বনের হরিণ ময়াবতী হয়েই মনে থেকে যাবে। তাই সুকুমার বড়ুয়ার কথা দিয়েই শেষ করি,

গল্পছড়া লেখার সাথে হাশেম খানের আঁকা

নইলে কি আর মানায় বলো; কাজ কি হবে পাকা?

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন