প্রদর্শনী

শিল্পসত্তা, শিল্পরূপ ও শিল্পশিক্ষা

মো. বজলুর রশিদ শাওন

‘‌কাল, সংস্রব ও পরিভ্রমণ’ শীর্ষক প্রদর্শনী উপভোগ করছেন দর্শনার্থীরা ছবি: কলাকেন্দ্র

শিল্পকলার ইতিহাসে অসংখ্য প্রথিতযশা শিল্পী ছিলেন এবং আছেন, যাদের শিল্পশিক্ষার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি নেই। ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ, ফ্রিদা কাহালো, আন্দ্রে ব্রেতো, জ্যা মিশেল বাস্কোয়েট থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের আই উই যার প্রামাণিক উদাহরণ। শিল্পশিক্ষার অভিজ্ঞতা নেই এ রকম শিল্পীদের বিশেষত্ব বর্ণনার ক্ষেত্রে প্রায়ই বলা হয় প্রাতিষ্ঠানিক অভিজ্ঞতা না থাকার দরুন তাদের কাজে এক ধরনের বিশুদ্ধতা কিংবা ভিন্নধর্মিতা আছে। এর কারণ হিসেবে বলা হয় শিল্পীর স্বাধীনতা, যা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কাঠামো রুদ্ধ করে দেয়। আমাদের দেশেও এক্ষেত্রে খুব বেশি ভিন্ন আলাপ চোখে পড়ে না। তবে এতটা সরলরৈখিকভাবে বিষয়টা দেখার সুযোগ আছে কি? প্রশ্নটা আসছে সম্প্রতি কলাকেন্দ্রে ‘‌কাল, সংস্রব ও পরিভ্রমণ’ শীর্ষক শিল্পী নাহিদুল ইসলামের চলমান প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অধ্যাপক লালারুখ সেলিমের একটি বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে। তিনি বলছেন, ‘‌যারা মূলধারার শিল্পী না অথবা সেভাবে কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষিত শিল্পী নন, তাদের কিছু সুবিধা আছে, যেগুলো প্রশিক্ষিত শিল্পীদের নেই। কারণ তারা (স্বশিক্ষিত শিল্পীরা) নিজেদের মতো করে ধারণ করতে পারেন এবং প্রকাশ করতে পারেন। অনেক সময় দেখা যায় যারা প্রশিক্ষিত বা তত্ত্বীয় জ্ঞান সমৃদ্ধ তাদের ইন্টালেক্ট/ভাবনা শিল্পকর্ম সৃষ্টির ক্ষেত্রে তাদের পরাধীন করে তোলে। সেদিক থেকে শিল্পী নাহিদুল ইসলামের কাজে এক ধরনের বিশুদ্ধতা আমি দেখতে পাই, যেখানে প্রশিক্ষিত শিল্পীদের এ পর্যায়ে আসতে অনেক চেষ্টা করতে হয়।...’

ভাষার নানাবিধ (গান, কবিতা, সিনেমা, উপন্যাস ইত্যাদি) ধরনের মধ্যে দৃশ্যশিল্প একটা ধরন। যেখানে শিল্পীরা তাদের বিশেষ অভিজ্ঞতা, অনুভূতির প্রকাশ ঘটান মূলত রূপ/ইমেজ নির্মাণের মাধ্যমে। রূপ নির্মাণের ক্ষেত্রে মাধ্যম কিংবা উপকরণের পাশাপাশি ভঙ্গি, বিন্যাস ও বিষয়বস্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভ্যান গঘ কিংবা ফ্রিদা কাহালো উপকরণ ও মাধ্যমের ক্ষেত্রে তাদের পূর্ববর্তী শিল্পীদের থেকে খুব আলাদা কিছু করেননি, বরং তাদের ভিন্নতা তৈরি হয়েছে বিষয়বস্তু হিসেবে তারা কী নিয়েছিলেন এবং কোন ভঙ্গিতে রূপ নির্মাণ করেছিলেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ভ্যান গঘ ও ফ্রিদা কাহালো দুজনই আত্মপ্রতিকৃতি এঁকেছেন, কিন্তু দুজনের অভিজ্ঞতা, অনুভূতির তারতম্যই তাদের ভঙ্গিমাগত পার্থক্য তৈরি করেছে। ফলে রূপ নির্মিত হয়েছে যার যার স্বকীয়তায়। অর্থাৎ শিল্পকর্মকে যদি শিল্পীর চিন্তার প্রতিফলন হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাহলে স্থান, কাল ও পাত্রভেদে ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা এবং চিন্তাকাঠামোর মাধ্যমে তৈরি হওয়া মনোজগতের প্রতিফলন তো সবসময়ই ভিন্নতর হবে। এক্ষেত্রে শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো একজন শিল্পীকে তার নিজস্ব অভিজ্ঞতার রূপ অন্বেষণে কোন ভঙ্গিমা বেছে নেবেন, সেক্ষেত্রে আরো বেশি সহযোগিতা করে থাকার কথা (যদিও আমাদের দেশের বাস্তবতায় শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অতটা সুচারুভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করে না, যা একজন শিল্পীকে তার নিজস্বতা তৈরিতে যথেষ্ট সাহায্য করতে পারে)। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে আমরা পাবলো পিকাসোর শিল্পকর্মগুলোকে দেখতে পারি। প্রতিষ্ঠানের সেরা ছাত্র কীভাবে নিজের ভাষারূপ অন্বেষণে বারবার নিজেকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। দ্বিমাত্রিক পটে নীল, গোলাপি পর্ব থেকে কিউবিজম পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন রূপ নির্মাণের প্রচেষ্টাও তাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। প্রতিবারই শিল্পকর্মের বিষয়বস্তুর সাপেক্ষে মাধ্যম, উপকরণের পাশাপাশি ভঙ্গিমায় পরিবর্তন এনেছেন। তাই আফ্রিকান শিল্পের রূপ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েও কিউবিজমের মতো নিজস্ব ভঙ্গিমার জন্ম দিয়েছেন। এমনকি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও এসএম সুলতানের শিল্পকর্মগুলোকে বিবেচনা করা যেতে পারে। যাদের শিল্পকর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু হিসেবে এসেছে চিরায়ত বাংলার কৃষিজীবন। দুজনই রেখাভিত্তিক শিল্পরূপ নির্মাণ করেছিলেন, কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির কারণে রূপ নির্মাণে ভিন্নতা এসেছে স্বাভাবিকভাবে। এটাই তদের শিল্পসত্তা।

এখন শুরুর প্রসঙ্গে ফেরা যাক। শিল্পী নাহিদুল ইসলাম বেড়ে উঠেছেন বাংলাদেশের দৃশ্যকলার চৌহদ্দির ভেতরে। পরিবারে শিল্পবান্ধব আবহ, নব্বইয়ের দশকে সাহিত্যে পড়াশোনা (যদিও শেষ করেননি), তারপর ফিল্ম স্টাডিজে পড়াশোনা করেছেন। এ প্রদর্শনীতে দ্বিমাত্রিক চিত্রপটে ভিন্ন ভিন্ন উপকরণে তিনি যে রূপ নির্মাণ করেছেন, সেখানে যে ভিন্নতা রয়েছে তা শিল্পশিক্ষা ডিগ্রি না থাকার কারণে এ দাবি অপ্রাসঙ্গিক। এমনকি সেটা না খুঁজে তার শিল্পসত্তাকে খোঁজ করা যেতে পারে। কেননা ভঙ্গিমাগত দিক থেকে আমাদের দৃশ্যশিল্পের পরিমণ্ডলে এ দৃশ্যরূপ মোটেও আলাদা নয়। কিন্তু তারও নিজস্বতা আছে। তার স্বরটা চেনা যায় সময় দিয়ে। প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত চিত্রকর্মগুলো দুই দশকের মধ্যে সম্পন্ন করেছেন তিনি।

সবশেষে বাংলাদেশের দৃশ্যশিল্পে কিউরেটোরিয়াল চর্চাকে ধন্যবাদ দিতে হবে। এ ধরনের অসংখ্য শিল্পীকে তারা নিয়মিতই আমাদের সামনে নিয়ে আসছেন। আমরা নতুন নতুন শিল্পসত্তার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন