যুগ-যুগান্তরে আফগান চিত্রকলা

নিজাম আশ শামস

অ্যাবস্ট্রাক্ট, শিল্পী: মোহাম্মদ সেলিম আতায়ী ছবি: দি উইয়্যার

সেদিন সহকর্মীদের নিয়ে কাবুলের গভর্নর অফিসের দেয়ালে ম্যুরাল আঁকছিলেন চিত্রশিল্পী ওমাইদ শরিফি। তখনো তিনি জানেন না, আর কয়েক ঘণ্টা পরই বদলে যাবে পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যাবেন। কাবুল চলে যাবে তালেবানদের দখলে। এসব না জেনেই দেয়ালে রঙ-তুলির আঁচড় কাটছিলেন ওমাইদ ও তার দল। কিন্তু দুপুর থেকে উত্তাপ টের পেতে থাকেন তারা। সরকারি কর্মচারীরা স্রোতের মতো অফিস থেকে রাস্তায় নামছিলেন। অনেকে লাফ দিয়ে উঠছিলেন গাড়িতে। কেউ আবার সাইকেল চালিয়ে কিংবা দৌড়ে সামনের দিকে ছুটছিলেন। তাদের গন্তব্য, বাড়ি কিংবা এয়ারপোর্ট। ওমাইদ শরিফিও রঙ-তুলি গুছিয়ে সহকর্মীদের নিয়ে ছুটলেন। কিছু সময় পর তালেবানরা কাবুলের ক্ষমতা নিয়ে নিল। তারিখ ১৫ আগস্ট, ২০২১।

চিত্রকলাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান আর্টলর্ডসের প্রধান ওমাইদ শরিফি। সাত বছরের বেশি সময় ধরে কাবুলসহ আফগানিস্তানের সর্বত্র রঙচটা ও বিধ্বস্ত দেয়ালগুলোয় ২ হাজার ২০০টিরও বেশি চিত্র এঁকেছেন প্রতিষ্ঠানটির সদস্যরা। এসব দেয়ালচিত্রে শান্তি, মানবাধিকার, লিঙ্গসমতার মতো সামাজিক-রাজনৈতিক সচেতনতামূলক বিবিধ বিষয় উঠে এসেছে। কিন্তু ক্ষমতা দখলের তিন মাসেরও কম সময়ে এসব চিত্রকর্ম সাদা রঙে ঢেকে দেয় তালেবান সরকার। সেসব জায়গায় ঠাঁই পায় ধর্মীয় কবিতা এবং তালেবানদের আদর্শিক বার্তা। চিত্রকলার বৈধতা কিংবা অবৈধতা প্রসঙ্গে ইসলামী শরিয়তে বিস্তর বয়ান আছে। সে আলোচনায় যাওয়া আমাদের উদ্দেশ্য নয়। ফকিহরা এসব নিয়ে কথা বলবেন। তবে তালেবানদের বুঝ অনুসারে, চিত্রকলা সমাজকে পাপ ও অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দেয়। তাই দেয়ালচিত্রগুলো মুছে দেয়া হয়েছে। অনেক চিত্রশিল্পী আফগানিস্তানে চিত্রকলার ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখে দেশ ছেড়েছেন। ওমাইদ শরিফিও তাদের একজন। তিনি বর্তমানে সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় বসবাস করছেন। দেয়ালচিত্র না হয় মুছে ফেলল, কিন্তু আফগানিস্তানের যুগ-যুগান্তরের চিত্রকলার যে ইতিহাস, তা মুছে ফেলা অত সহজ নয়। আফগান চিত্রকলার ভবিষ্যৎ কী হবে, তা ভবিষ্যতেই বোঝা যাবে। কিন্তু এর অতীত যে অত্যন্ত উজ্জ্বল, এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।

আফগান চিত্রকলার ইতিহাস খুঁড়তে হলে আমাদের ঈসায়ী সাল গণনার একেবারে শুরুতে নজর বুলাতে হবে। খ্রিস্টীয় এক থেকে সাত শতকে আফগান চিত্রশিল্পের প্রথম উল্লেখযোগ্য বিকাশ ঘটেছিল। তখন আফগানিস্তান গান্ধার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাই আফগান চিত্রকলার এ কালপর্ব ‘গান্ধার চিত্রকলা’ নামে পরিচিত। এর উদ্ভব, বিকাশ ও পরিণতিকাল হিসেবে খ্রিস্টীয় এক থেকে সাত শতক চিহ্নিত হলেও এর পাটাতন তৈরি হচ্ছিল আরো আগে থেকে; হজরত ঈসা মসিহর জন্মের অন্তত ৩০০ বছর আগে। তখন সম্রাট অশোকের শাসনকাল। তার পৃষ্ঠপোষকতায় গান্ধার অঞ্চলে ব্যাপকভাবে ধর্মপ্রচারে রত মহামতী বুদ্ধের অনুসারীরা। সে কারণে গান্ধার চিত্রশিল্পে বৌদ্ধ ধর্মের বিবিধ কিংবদন্তি এবং সিদ্ধার্থ গৌতমের প্রতিকৃতি ফুটে উঠতে থাকে। আর এসব চিত্রকর্মে ছিল গ্রিক চিত্ররীতির ছাপ। এর কারণ আছে। ইতিহাস জানায়, খ্রিস্টপূর্ব যুগে স্থাপিত গ্রেকো-ব্যাকট্রিয় সাম্রাজ্যের অন্যতম কেন্দ্র ছিল আফগানিস্তান। সেই সুবাদে গান্ধার চিত্রশিল্পে গ্রিক ও বৌদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্যের সমন্বয় ঘটেছে। চিত্রশিল্পের ইতিহাসের কালপর্বটি তাই ‘গ্রেকো-বুড্ডিস্ট’ শিল্পযুগ নামেও পরিচিত। আফগানিস্তানের হাড্ডা নামক প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চল থেকে এ যুগের অসংখ্য চিত্রনিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। আফগানিস্তানের বামিয়ান উপত্যকার একটি খাঁড়া পাহাড়ের গায়ে খোদাই করে তৈরি গৌতম বুদ্ধের দুটি ভাস্কর্য সে যুগের শিল্পকলার অন্যতম নিদর্শন। ছয় শতকে নির্মিত বুদ্ধের এ ভাস্কর্যযুগল একত্রে ‘বামিয়ানের বুদ্ধদ্বয়’ নামে খ্যাত। তুলনামূলক বড় ভাস্কর্যটি ‘পাশ্চাত্য বুদ্ধ’ এবং ছোটটি ‘প্রাচ্য বুদ্ধ’ নামে পরিচিত। এও আরেক মজা। প্রাচীন সিল্ক রোডের মাধ্যমে সংযুক্ত প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সন্ধিস্থল ছিল আফগানিস্তান। তাই সে সময়ের আফগান চিত্রভাবনায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে। গান্ধার পর্বে আফগান চিত্রকলা এমন বিবিধ সংমিশ্রণ ও বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। এক শতকে গান্ধার কুশান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তখন এ অঞ্চলের সঙ্গে রোমের একটি যোগাযোগ গড়ে ওঠে। তার ছাপ পড়ে চিত্রকলায়। চিত্রে বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন কিংবদন্তি ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে চিরায়ত রোমান চিত্রশিল্পের নানা উপাদান ও কৌশল ব্যবহার করা শুরু করেন আফগান শিল্পীরা। পর্যায়ক্রমে তাদের চিত্রে ঠাঁই পেতে থাকে লতানো নকশা, পুষ্পমাল্য হাতে দেবদূত, দেবতা ও নরঘোটকের প্রতিকৃতি। গান্ধার যুগে অঙ্কিত গৌতম বুদ্ধের প্রতিকৃতিতেও রোমান ছাপ সুস্পষ্ট। এ সময় অনেক চিত্রশিল্পী রোমান দেবতা অ্যাপোলোর মুখের আদলে গৌতম বুদ্ধের মুখ এঁকেছিলেন। পোশাকেও ছিল রোমান ভাস্কর্যগুলোর অনুকরণ। গান্ধার যুগের ভাস্কর্যগুলো তৈরিতে শুরুর দিকে সাধারণত ‘গ্রিন ফিলাইট’ এবং ‘গ্রে-ব্লু মাইকা শিস্ট’ পাথর ব্যবহার করা হতো। পরবর্তী সময়ে তিন শতকের দিকে ‘স্টুকো’র (এক ধরনের পলেস্তারা) ব্যবহার শুরু হয়। ভাস্কর্যগুলো রঙিন এবং সোনালি আবরণে উজ্জ্বল ছিল। সাত শতকের পর থেকে আফগান চিত্রকলায় গ্রিক, রোমান ও বৌদ্ধ প্রভাব ধীরে ধীরে ফিকে হতে থাকে। অন্যদিকে ইসলামী ও পারস্য চিত্রশিল্পের প্রভাব বাড়তে থাকে। এ পর্যায়ে আফগান শিল্পীরা চিত্র ও ভাস্কর্যে ল্যাপিস লাজুলির (গাড় নীল বর্ণের মূল্যবান প্রস্তরবিশেষ) মতো স্থানীয় উপকরণের ব্যবহার শুরু করেন। আফগান চিত্রকলায় ইসলামী প্রভাবের এ যাত্রা হয়েছিল গজনবি শাসনামলে। এ যুগে আফগান চিত্রকলা ব্যাপক উৎকর্ষ লাভ করে। সে সময়ের চিত্রকর্মে হাতি, ময়ূর, উটসহ ইসলামী সভ্যতার সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন মোটিফ স্থান পেতে থাকে। আফগান চিত্রকলায় ইসলামী প্রভাব বোঝার অন্যতম কেন্দ্রস্থল কাবুলের লস্করি বাজার। সেখানে অবস্থিত প্রাচীন প্রাসাদগুলোর দেয়ালে বিশেষ সাজে সজ্জিত সৈনিকের প্রতিকৃতি দেখা যায়। ঐতিহাসিকদের মতে, সুলতান মাহমুদ গজনবি তার রাজধানীর সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তৈমুরীয় শাসনামলে আফগান চিত্রকলা এর চূড়ায় পৌঁছেছিল। ইরানের বড় বড় শিল্পী তখন হেরাতে আস্তানা করেছিলেন। ফলে হেরাত হয়ে ওঠে আফগান চিত্রকলার কেন্দ্রস্থল। সে সময়ের চিত্রকর্মগুলোয় রোমান্টিক ও আধ্যাত্মিক কবিতার বিষয়বস্তু মূর্ত হয়ে ওঠে। আফগান চিত্রশিল্পের ইতিহাসে পোর্ট্রেটের যাত্রাও হেরাতের শিল্পীদের হাতেই। ক্যারিকেচারের শুরুও তারাই করেছিলেন।

বিশ শতক থেকে আফগান চিত্রশিল্পীরা নিজেদের শিল্পকর্ম তৈরিতে পাশ্চাত্য কৌশলের ব্যবহার শুরু করেন। আধুনিক যুগের আফগান শিল্পীদের মধ্যে জালালউদ্দিন জালাল, করিম শাহ খান, খায়ের মোহাম্মদ খান ইয়ারি প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। সমসাময়িক শিল্পীদের মধ্যে শামসিয়া হাসানি বেশ আলোচিত হয়েছেন।

বর্তমানে ফিরে আসা যাক। কেবল চিত্রকলাই নয়, শিল্পের প্রতিটি খাতেই আফগানিস্তান এখন এক সংকটময় সময় অতিবাহিত করছে। এ থেকে উত্তরণ কীভাবে ঘটবে, তা এখনই বলা সম্ভব নয়। কিন্তু সুদীর্ঘ ইতিহাসের অত্যুজ্জ্বল আলোকচ্ছটায় এ অন্ধকার যে ক্রমেই দূরীভূত হবে, তা প্রত্যয় নিয়ে বলা যায়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন