মাতিসসমগ্র: রঙ ও রেখার আলোড়ন

আলম খোরশেদ

স্টিল লাইফ উইথ আ ব্লু টেবলক্লথ

১৯৭০ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত অঁরি মাতিসের প্রথম পূর্ণাঙ্গ প্রদর্শনীর দীর্ঘ ২২ বছর বাদে নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট আয়োজন করেছিল তার সারা জীবনের শ্রেষ্ঠ চার শতাধিক কাজ নিয়ে বিশাল এক রেট্রোস্পেকটিভের। বিশেষ প্রিভিউয়ের সুযোগে গোটা একটি সন্ধ্যা আমার কাটানোর সুযোগ হয়েছিল মাতিসের মেলে ধরা রঙ ও রূপের সেই আশ্চর্য আলোড়নের মাঝখানে। সেই অনুপম অভিজ্ঞতাটুকু লিপিবদ্ধ করে রাখার জন্যই এ নিবন্ধের অবতারণা। মনে আছে মিউজিয়ামের সম্পূর্ণ দুটি তলাজুড়ে বসেছিল সেই প্রদর্শনীর পসরা। প্রথম তলায় ছিল ১৮৯০ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত আঁকা ছবির জগৎ, আর দ্বিতীয় তলায় ১৯১৭ থেকে ১৯৫৪ সালে তাঁর মৃত্যু অবধি রচিত শিল্পকর্মের সম্ভার। প্রতিটি কালপর্বকে আবার শিল্পীর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও প্রবণতা অনুযায়ী ভাগ করা হয়েছিল আরো কিছু উপবিভাগে। প্রথমাংশের উপবিভাগটি ছিল Discovering Modern Art, আর দ্বিতীয় পর্যায়ে ছিল The Early Years at Nice 1917-1930, Themes and Variation 1930-1943 ও The Final Years 1943-1954।

মাতিসের ছবির জগতে আসাটা অনেকটা আকস্মিক। আইনের ছাত্র মাতিস ২০ বছর বয়সে অ্যাপেন্ডিসাইটিস থেকে সেরে ওঠার সময় মায়ের দেয়া এক বাক্স রঙ পেন্সিলের সদ্ব্যবহার করতে গিয়ে হঠাৎ করে ছবি আঁকতে শুরু করেন। তিনি তাতে এমনই মজে যান যে আইন ছেড়ে রীতিমতো শিল্পকলার শিক্ষা নিতে শুরু করেন প্যারিস গিয়ে। তার ভাষায়, এক নতুন স্বর্গের দরজা খুলে যায় তার সামনে এই রঙ ও রেখার জাদুতে। মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত সেই ব্যক্তিগত স্বর্গের প্রতিচ্ছবিই তিনি রচনা করে গেছেন নিরন্তর রঙ, রূপ আর আলোর উদ্ভাসনে। মাতিস একদা বলেছিলেন, তিনি এমন জাতের ছবি আঁকতে চান যা দর্শকের ইন্দ্রিয়কে শান্ত ও সমাহিত করবে, তার দিনানুদিনের গ্লানি ও যন্ত্রণার প্রশমন ঘটাবে। মাতিসের সমগ্র প্রদর্শনী ঘুরে আমার অন্তত সে রকমই অনুভূতি হয়েছিল। তার ছবি কোথাও চোখকে পীড়িত করে না, চিত্তকে করে না চঞ্চল। তার ছবির বিষয় ও আঙ্গিকের কোথাও কোনো অসুন্দর ও নিষ্ঠুরকে প্রত্যক্ষ করি না আমরা। বস্তুত আধুনিক নগরজীবনের কোনো জটিলতা, যন্ত্রণা ও সন্ত্রাসকেই তিনি আমল দেননি তার গোটা শিল্পীজীবনের বিশাল চিত্রসম্ভারের কোথাও। 

তার বিষয় মূলত নিসর্গ, সেই সঙ্গে অনাদি অকৃত্রিম মানুষ ও তার বস্তুময় পরিপার্শ্ব। মাতিস তাদের নির্মাণ করেন আশ্চর্য সারল্যে, অজস্র উদ্দাম রঙে মাখামাখি করে। তার একটি সিরিজের নামই হচ্ছে Joie de Vivre বা বাঁচার আনন্দ। মাতিসের রঙ ও রেখা যেন ঘুরেফিরে জীবনের সেই মামুলি আনন্দকেই সন্ধান করে ফেরে। তিনিও আর সবার মতোই স্থিরচিত্র দিয়েই শুরু করেছিলেন তার চিত্রকর জীবন। সেসবে যত না তার নিজস্বতা, তার চেয়ে বেশি ছিল Monet আর Renoir-এর ছায়া। তবু এরই মধ্যে প্রদর্শনীর Still life with a Blue Tablecloth কাজটিতে মৌলিকতার আভাস মেলে, টেবিলের অজস্র দ্রব্যসম্ভারের তলা থেকে অল্প কিছু নীল রেখার ঝলকে tablecloth-এর ইঙ্গিতময় উপস্থাপনায়। এ পর্যায়ে তার অপর প্রধান কাজ The Dinner Table নামক Still life-এর বহুস্তর বিন্যাসের মধ্যে ঈর্ষণীয় মুন্সিয়ানা লক্ষ না করে পারা যায় না। মাতিসের গুরু পল সেজানের জ্যামিতিক কম্পোজিশনের প্রভাবও চোখে পড়ে তার কাজে, বিশেষ করে Male Model চিত্রকর্মটিতে, যেখানে ভাস্কর্যের ঘনত্ব নির্মিত হয় রেখার নৈপুণ্যে। 

১৯০৫-এর গ্রীষ্মকাল মাতিস কাটিয়েছিলেন শিল্পী Andre Derain-এর সঙ্গে ভূমধ্যসাগর সৈকতে। সেখানেই প্রথম মাতিসের ক্যানভাসে প্রধানত গগ্যাঁ ও ভ্যান গঘের প্রভাবেই, রঙের প্রাচুর্য দৃশ্যমান হতে থাকে। পরে Derain, Matisse ও Vlaminck তিনজনে মিলে একটি প্রদর্শনী করেন যা দেখে দর্শক, সমালোচক সবাই হতভম্ব। তাদের, বিশেষ করে মাতিসের ক্যানভাসে, রঙের এমন বেহিসেবি, ব্যাকরণহীন ব্যবহার দেখে তারা তাদের উন্মাদ ঠাওরালেন, আখ্যা দিলেন Les Fauves বা বন্য জন্তু। এমন উজ্জ্বল রঙ আর রূপকল্পের এমন ঠাস বুনট, এর আগে কেউ প্রত্যক্ষ করেনি। মাতিস জানালেন, তিনি ছবি এঁকে তাতে রঙ ভরার চেয়ে সরাসরি রঙ দিয়েই গোটা ছবিটা আঁকছেন যাতে খোদ রঙই ছবির ভাষা হয়ে ওঠে। তার এই পর্যায়ের এবং পরবর্তীকালেও ছবির আনাচে-কানাচে যে বিচিত্র আলোর খেলা লক্ষ করা যায়, তাও তার অমন প্রগাঢ় রঙ প্রয়োগেরই ফল। মাতিসের ভাষায় তিনি রঙ ব্যবহার করে কোনো নির্দিষ্ট আলোকে নিছক অনুকরণ করেন না, বরং তার নিজস্ব প্রয়োজনে নতুন নতুন আলো তৈরি করে নেন রঙের বিচিত্র বিন্যাসের দ্বারা।

মাতিস সারা জীবনই উজ্জ্বল রঙের প্রতি পক্ষপাত দেখিয়েছেন। মাঝখানে স্বল্পকালের জন্য তা ফিকে হয়ে এলেও শেষ জীবনে তার অভিনব paper cutout গুলোর মধ্যে সেই রঙের বন্যাকে প্রবল তোড়ের মতো বয়ে যেতে দেখি আমরা। প্রদর্শনীর অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ছিল তার এ উজ্জ্বল বর্ণিল কাগজ কেটে বানানো আশ্চর্য সুন্দর ও বাঙ্ময় কাটআউটগুলো, যার মধ্যে ছিল নির্মলেন্দু গ ণের কবিতা ও অমীমাংসিত রমণী গ্রন্থের প্রচ্ছদপটে ব্যবহৃত সেই নীল মানবীর ছবিখানিও। প্রদর্শনীতে তার বিখ্যাত প্রায় সব ছবিরই উপস্থিতি ছিল। মস্কো থেকে এসেছিল তার বহুল আলোচিত Dance সিরিজের ছবিগুলো। আরো ছিল Le Luxe ও Bathers নামক চিত্রমালা দুটি। পারস্যের মিনিয়েচার দ্বারা প্রভাবিত তার Interior পর্যায়ের অসংখ্য ছবিতে অলংকরণের এক নতুন মাত্রা লক্ষ করা যায়। বস্তুত এ অলংকরণপ্রিয়তা, প্রাকৃতিক সারল্য আর বহুবর্ণিল ঔজ্জ্বল্যের জন্য বিখ্যাত মাতিসকে তার সামগ্রিকতায় পাওয়া গিয়েছিল এ প্রদর্শনীতে। এছাড়া মালার্মের কবিতার বইয়ের Illustration এবং তার নিজের লেখা ও আঁকা Jazz গ্রন্থের মূল ছবিগুলোও ছিল প্রদর্শনীতে। আরো ছিল বেশকিছু ভাস্কর্য, যার মধ্যে দুই নারী নামক কাজটিতে নারীশরীরের অঙ্গসংস্থানের আশ্চর্য বিন্যাস বিস্মিত করে দর্শকদের। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আঁকা তার সবক’টা Still life জোগাড় করেছিল জাদুঘর কর্তৃপক্ষ, যার মধ্যে কক্ষ উজ্জ্বল করে ফুটে ছিল তার বহু বিখ্যাত আপেলের দুখানা ছবি। আর অবশ্যই ছিল, মাতিসের অবসেশন, বিচিত্র ধরনের সবুজ রঙের মেলা। 

এই বহুবিধ রূপ আর আলোর সরল স্বতঃস্ফূর্ত প্রয়োগে, মাতিস সারা জীবন তার ভাষায়, বস্তুর যে Essential Character ফুটিয়ে তোলার সাধনা করে গেছেন, তারই এক সপ্রাণ স্বরূপ প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছিল এ লেখকের, বিশাল ও বর্ণাঢ্য সেই দুর্লভ প্রদর্শনীটিতে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন