একজন সামাজিক শিল্পীর সংগ্রাম

মোস্তফা জামান

শিল্প যে সামাজিক ভাষা, জয়নুল আবেদিন তার চর্চার মধ্য দিয়ে এ সত্য প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। দেশ বিভাগ-পূর্বকালে যখন ঔপনিবেশিক আধুনিকতার বিপরীতে তাত্ত্বিক কুমারস্বামী এবং শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতীয় জাতীয়তাবাদের একটি ধর্মভিত্তিক চরিত্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে ‘‌প্রাচ্যবাদী’ দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারস্থ হলেন, এ জাতীয়তাবাদী শৈল্পিক মুহূর্ত কৃষক, সমাজের সঙ্গে বিযুক্ততা তৈরি করল (বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, জয়নুল আবেদিনের জিজ্ঞাসা, পৃ. ৫৮)। যে ধর্মাশ্রয়ী জাতীয়তাবাদের তত্ত্ব ও চর্চার পরিণতি হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা ও দেশভাগ; তারই সমালোচনা হিসেবে জয়নুলের কৃষি-সমাজভিত্তিক শিল্পচর্চা শহর ও গ্রামের যোগসূত্র তুলে ধরেছে তার দেশভাগ-পূর্ববর্তী শিল্পচর্চায়। দুর্ভিক্ষ চিত্রমালা শহরবাসী উচ্চশ্রেণীর সঙ্গে গ্রামবাসী নিচু শ্রেণীর সম্পর্কের মধ্যে যে অবহেলা তা তুলে ধরে। গ্রাম ও গ্রামীণ মানুষ ঔপনিবেশিক শাসনের মধ্য দিয়ে সর্বপ্রথম প্রান্তিক হয়ে ওঠে। মূলধারার মানুষের প্রতীকীকরণের যে অর্থনীতি তা নাকচ করে জয়নুল গ্রামীণ জীবনের চিত্রে মনোযোগী হয়ে ওঠেন। এ সূত্রেই জয়নুলের চর্চা রাজনৈতিক। চর্চার মধ্য দিয়েই আধুনিকতার শহরকেন্দ্রিকতার সমালোচনা গড়ে তোলেন। দৃঢ় ও রুক্ষ রেখায় আঁকা সমাজবাস্তবতা এ কারণেই একটি তাত্ত্বিক মাত্রা লাভ করে—শিল্পী জয়নুল চর্চার সূত্রে সমাজতত্ত্বের দিকনির্দেশক হয়ে ওঠেন। 

১৯৪৬ সালের ক্যালকাটা কিলিং—দুই ধর্মগোষ্ঠীর মধ্যকার অবর্ণনীয় হানাহানি বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীকে দুই দেশের নাগরিকে পরিণত করে। ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর জয়নুল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ার উদ্যোগ নেন। ১৯৫১ সালে তিনি বিলাতে স্লেড স্কুল অব আর্টসে এক বছর শিক্ষা গ্রহণ করেন। 

বিলাত থেকে ফিরে জয়নুল ফর্ম নিয়ে নিরীক্ষায় হাত দেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই জ্যামিতিক সংঘবদ্ধতা থেকে তিনি সরে যেতে থাকেন। গ্রামীণ নারীর চুল বাঁধা বা মুখাবয়ব নির্মাণে ক্রমে রেখার স্বাধীনতার প্রয়োগ লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। রেখার ঋজুতা ফিরে আসে। জয়নুলের শিল্পদর্শনের রেডিক্যাল মাত্রাটি যেমন বাস্তবকে বাস্তব হিসেবে উপস্থাপনায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তেমনি রেখার সচল ব্যবহার তার চিত্রকে আদর্শায়িত অঙ্কন পদ্ধতি থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করেছে। যেকোনো আদর্শায়িত পদ্ধতি উচ্চ মানের আভাস দেয়, যেখানে নিম্নশ্রেণীর মানুষের যেমন প্রবেশ নিষেধ, তেমন খর ভাবের প্রকাশও সম্ভব নয়। জয়নুলের প্রকাশবাদী চরিত্র গঠনে খর রেখা বিশেষ ভূমিকা রেখেছে, যা পেলবতার বিপরীতে বাস্তববাদী মেরুর শিল্পীর সাধনার ফল। মনে রাখা জরুরি যে জয়নুল কলকাতায় যে খর রেখা-নির্ভর বাস্তববাদিতার জন্ম দেন তা কলকাতার রাস্তায় দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মানবেতর অবস্থা তুলে ধরতে জন্ম নেয়।

সমাজের সত্য তুলে ধরতে যে সামাজিক শিল্পধারা জয়নুল কলকাতায় চাক্ষুষ করে তোলেন, তা তার সারা জীবনের চর্চার মূলধন হিসেবে গণ্য করা চলে।

মনে রাখা জরুরি যে জয়নুল ময়মনসিংহের কৃষি সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে কলকাতায় বাস্তবতার নিরিখে একপ্রকার ‘সহজ দৃষ্টি’ উৎপাদন করেন। কলকাতায় অর্থাৎ শহরে এমন সহজ দেখার প্রচলন ছিল না। মন্বন্তরের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে যে প্রদর্শনী কলকাতায় আয়োজন করা হয় তার শিরোনাম ছিল ‘দায়’। এ থেকে স্পষ্ট হয় যে নাগরিকের চোখে গ্রামীণ মানুষ বা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বিপর্যয়ের বাস্তবতা অনুধাবনের কোনো স্বাভাবিক বা স্বতঃস্ফূর্ত উপায় নেই। দায়বদ্ধতা দিয়ে এ যোগাযোগ তৈরি করতে হয়। জয়নুলের জন্য গ্রামীণ বাস্তবতা অনুধাবন করা, মানব বিপর্যয়ের অধ্যায়গুলোকে ছবির মূল বিষয়ে পরিণত করা—এর কোনোটাই অস্বাভাবিক কোনো প্রক্রিয়া ছিল না। তিনি তার আপন মানুষদের ওপর আলোকপাত করেছেন। স্বতঃস্ফূর্ত স্বাভাবিকতায়।

জয়নুলের স্বাভাবিক দর্শন বা দেখার ক্ষমতা ও তার রেখার ক্ষমতা ব্যবহার করে স্বাভাবিক বাস্তববাদ—এই দুই মাত্রা তার ঢাকার জীবনের চিত্রকলা শাসন করেছে। এর পাশাপাশি মনে রাখা দরকার জয়নুলের কর্মবিষয়ক নিরীক্ষা—যা তার জীবনের শেষ ছবিতে দুই মুখাবয়বের কনটুর ড্রইংয়ে রেখার দর্পযোগে নতুন মাত্রা পেয়েছে।

দেশভাগের পর জয়নুলের কাজে রেখা আরো স্বাধীন হয়ে ওঠে। স্বাধীন বলতে কনটুর বা সার্বিক আকার গঠনে এর ব্যবহার অনেক বেশি স্বতঃস্ফূর্ত ও জঙ্গম। ২০২২ সালে সংগ্রাম শিরোনামের প্রদর্শনীতে ‘বিদ্রোহী গরু’ মাস্টারপিসের যে কয়টি প্রদর্শনী লক্ষ করা গেছে তার কয়েকটিতে রেখা দ্রুত অঞ্চলের তালে স্বাধীন হয়ে উঠেছে। ১৯৭১-এ আঁকা ‘ফেরা’ শিরোনামের ক্ষেত্রে রেখা এতটাই গতিশীল যে একদল গরুর ছুটে চলাই মুখ্য হয়ে ওঠে। আর গরুর গঠন গৌণ হয়ে পড়ে।

মূল চিত্রকল্প সৃষ্টির পেছনে জয়নুলের স্টাডি বা স্কেচের কয়েকটি ধাপ লক্ষ করা যায়। তার বহুল পরিবেশিত ‘সংগ্রাম’—যেখানে গরুর গাড়ির চাকা ঘোরাতে মানুষ প্রাণীকে সাহায্য করতে উদ্যোগী—কয়েকটি ধাপে গড়ে উঠেছে। ছোট ছোট কাগজে তিনি ছবির পরিকল্পনা স্কেচ করে তার মূল দৃষ্টির কম্পোজিশন ও মেজাজ নির্ধারণ করেছেন। রেখার জঙ্গমতা এগুলোকে জয়নুলীয় চরিত্র দিয়েছে।

জয়নুল অনুশীলনের পর্ব বাদ দিয়ে যে হঠাৎ করে মাস্টারপিস এঁকে ফেলতে পারতেন তার প্রমাণও অঢেল। পঞ্চাশের দশকে আঁকা ‘মই দেয়া’ চিত্রের কেবল একটি পেনসিলে আঁকা খসড়া পাওয়া যায়।

তার বৃহদাকার মাস্টারপিস ‘‌মনপুরা ৭০’ স্ক্রলে আঁকা শুরু করার আগে কিছু দ্রুত করা পেনসিল ও পেন স্কেচ দেখে অনুভব করা যায় যে শিল্পী বিষয়বস্তু স্মরণে রাখার প্রক্রিয়া হিসেবে এমন খসড়া এঁকেছেন। শিল্পী রফিকুন নবীর বয়ানের সূত্রে আমরা জানতে পারি যে জয়নুল কর্ণফুলী স্ক্রলে তিন ধাপে মনপুরা শেষ করেছিলেন, ‘‌সংগ্রাম’ প্রদর্শনী উপলক্ষে যে বইটি ছাপা হয়, তার সূত্রে আমরা যে তুলির কিছু স্কেচ বা খসড়া পেলাম, তা তার হালকা থেকে গাঢ় লাইন বা রেখা অঙ্কনের ধরনটি নির্ধারণের সূত্র আবিষ্কারের তাগিদে করা হয়েছে বলে ধরে নেয়া যায়। ফলে বিষয়বস্তু এখানে তেমন স্পষ্ট করে তোলা হয়নি।

প্রত্যক্ষ জীবন জয়নুলের আরাধ্য ছিল। যা তিনি দেখেননি, যা কিছুর অভিজ্ঞতা তার ছিল না, তেমন বিষয়ে তিনি ছবি আঁকেননি। এ সূত্রেই তিনি আদর্শবাদী শিল্পীদের মতো ধর্মীয় বিষয় বা মিথ অনুসরণে ছবি আঁকেননি। চোখের অভিজ্ঞতাকে জয়নুল চিত্রের অভিজ্ঞতায় পরিণত করতে এমন এক উপায় গ্রহণ করলেন, যা অঙ্কনের ছবি এবং সহজাত উপায়ে গড়ে তোলা তত্ত্বের আশ্রয়ে জুতসই ভাষায় বা প্রতীকে রূপান্তরিত। বৃহত্তর সমাজে ঘটে যাওয়া বিশেষ মুহূর্তগুলো বাংলাদেশের শিল্পের ইতিহাসের বিশেষ মুহূর্তে পরিণত করতে পারাই জয়নুলের অর্জন। আধুনিক বিশ্বের বিশ্বজনীন কিছু বিষয় গ্রহণ করে নিয়ে, এর বহুবিধ ধারা ও ধারণা অর্জন করে ময়মনসিংহের এই শিল্পী-তারকা পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতিপ্রবণ সাংস্কৃতিকতার বিপরীতে পূর্ববঙ্গের মানবিক দৃষ্টি দিয়ে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রতীকী চর্চা চালিয়ে গেছেন। তবু দুটি বৃহৎ ঘটনা নিয়ে শিল্পীর বড় কোনো শিল্পের অনুপস্থিতি হয়তো নবীন প্রজন্মের মাঝে প্রশ্নের জন্ম দিতে পারে। দেশভাগের ওপর জয়নুলের কোনো চিত্র দেখা যায় না। কলকাতায় যে রক্তবন্যা দেশভাগের ভিত তৈরি করল, তার ওপর জয়নুলের কোনো চিত্রের হদিস মেলে না। নয় মাসজুড়ে যে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো তার ওপরও বড় কোনো চিত্র তিনি এঁকে রেখে যেতে পারেননি। দ্বিতীয় বিষয়ে তার সাংগঠনিক পর্যায়ে কাজ, জার্নালে পাকিস্তানি মিলিটারির অভাবনীয় অত্যাচার ও খুনখারাবি নানান স্কেচ ও ছোট কাজের মধ্য দিয়ে যুদ্ধের বাস্তবতা ধরে রাখার স্পষ্ট প্রয়াস লক্ষণীয়।

আগেই বলা হয়েছে যে জয়নুল দায়বদ্ধতা থেকে ছবি আঁকেননি। রোমান্টিকতার বিপরীতে দাঁড়ানো এ শিল্পী বাংলাদেশ জন্মের সঙ্গে জড়িত সংগ্রামী নেতাদের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়িয়ে কাজ করেছেন। পলাশীর যুদ্ধ থেকে শুরু করে তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা ও নবান্ন কিংবা মনপুরা—এসবই বড় আকারে তিনি এঁকে গেছেন। তিনি যে স্বাধীনতার আন্দোলনে শামিল হয়েছেন, এমনকি মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর আদর্শকে মান্য করেছেন তার প্রমাণ হিসেবে মওলানার দুটি মুখাবয়বও তিনি এঁকেছেন। ছবিতে মওলানাকে পতিত পাবনের ভূমিকায় তুলে ধরেছেন। ১৯৭০-৭১-এ আঁকা চিত্র দুটি বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। ১৯৭১ সালের ৯ মার্চ মওলানা ভাসানীর আয়োজিত সভায় যোগ দেন জয়নুল এবং তাকে দেয়া সরকারি খেতাব হিলাল-ই-ইমতিয়াজ বর্জন করেন।

সবকিছু বিচার করে জয়নুলকে মজলুমের শিল্পী বলে আখ্যায়িত করা যায়। অত্যাচারিত, নির্যাতিত মানুষ, কৃষি সমাজের শক্তি যে মানুষ তারাই জয়নুলের চোখে এ সভ্যতার অন্দরের কর্মবীর। কিন্তু অনেক বড় দুর্ঘটনার চিত্র শিল্পে উঠে আসে না। কেন উঠে আসে না, এ প্রশ্নের সুরাহা হাজির করা কঠিন নয়। ঔপন্যাসিক এলি উইজেল, যিনি কিশোর বয়সে আউশভিৎজে বন্দি ছিলেন এবং তার ভাইবোন ও মাকে সেখানে হারিয়েছেন—উইটনেসিং বা সাক্ষ্যপ্রমাণের এক অদ্ভুত দৃষ্টান্ত রেখেছেন তার ‘‌ওথ’ শিরোনামের উপন্যাসে। তার পোটাগনিস্ট তার জনগোষ্ঠীর বিলোপ দেখেছেন কিন্তু এ বিষয়ে নীরব থাকার পণ করেছেন। অর্থাৎ এমন অনেক বিষয় আছে যা মানুষকে এতটাই আক্রান্ত করে যে তার কোনো প্রকার শৈল্পিক উপস্থাপনা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এ কারণেই কলকাতার জয়নুল-পরবর্তী আধুনিক শিল্পীরাও কলকাতার ভয়াবহ দাঙ্গার ওপর কোনো ছবি আঁকেননি।

বিপর্যয়বিষয়ক ছবি নিয়ে কবি ব্রাত্য রাইসুর তর্কটিও প্রণিধানযোগ্য—যদি কোনো ব্যক্তি সামাজিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হন, তার দায়িত্ব হবে বিপর্যস্ত মানুষের উদ্ধারকল্পে কাজ করা, ছবি আঁকা নয়। 

পরিশেষে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বঞ্চনার শিকার মানুষের সহযোদ্ধা এ শিল্পীর কথা নিয়ে তার মনঃকাঠামো আরো স্পষ্ট করে তোলা যায়: ‘‌আমার অনুভূতি একজন সামাজিক মানুষ হিসেবে অভিজ্ঞতা থেকে উৎসারিত। আমি পরিবার, সমাজ ও পার্থিব কাজকর্ম থেকে নিজেকে সরিয়ে নিই না।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন