ব্যাহত জীবনচক্র ও বাস্তুসংস্থান

উন্নয়নযজ্ঞে বিপদে সাড়ে তিনশ প্রজাতির পাখির আবাস

ফেরদৌস সিদ্দিকী I রাজশাহী

পলাশের ডালে এক সোনালি পিঠ কাঠঠোকরা ছবি : নাজমুল কামাল রনী

দেশের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহর বলা হয় রাজশাহীকে। সরু পথ হয়েছে প্রশস্ত। দৃষ্টিনন্দন সড়ক বিভাজকে বসানো হয়েছে উজ্জ্বল আলোর হরেক রকমের আধুনিক বাতি। আলোকিত করা হয়েছে নদীর ধার। শহর সম্প্রসারণের সঙ্গে নির্মাণ হয়েছে নতুন সড়ক। যদিও এমন সব উন্নয়নযজ্ঞে কাটা পড়েছে শহরের অধিকাংশ গাছপালা। আবাস হারিয়েছে অসংখ্য পাখি। ব্যাঘাত ঘটছে বাস্তুসংস্থান ও জীবনচক্রে।

পাখিপ্রেমীদের কাছে রাজশাহী মূলত ‘বার্ডশাহী’ নামে পরিচিত। কারণ দেশে থাকা ৭১৪ প্রজাতি পাখির মধ্যে প্রায় সাড়ে তিনশরই দেখা মেলে এ অঞ্চলে। আর নগরঘেঁষা পদ্মার চর তো পাখির নিরাপদ আবাস। বিপন্ন পাখিও ঠাঁই খুঁজে নিয়েছে সেখানে। নিরাপদে ফিরত পরিযায়ী পাখিও। কিন্তু শহরের ঝলমলে সে আলো আজ তাদের দিক ঘুরিয়েছে। দিন দিন কমছে পাখির সংখ্যা। বিষয়টি উদ্বেগজনক বলছেন পরিবেশবিজ্ঞানীরা। কিন্তু সেদিকে দৃষ্টি নেই নগর কর্তৃপক্ষের।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতাল এলাকায় কলোনি গড়ে পরিযায়ী পাখি শামুকখোল। কিন্তু বিষ্ঠায় পরিবেশ নষ্টের অজুহাতে ২০২০ সালে গাছের ডালপালা কেটে পাখি তাড়ানোর চেষ্টা চালায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তাদের এ কাণ্ডের প্রতিবাদ জানান পরিবেশকর্মীরা।

তাৎক্ষণিক বিষয়টি চাপা পড়লেও ২০২১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর হাসপাতালের প্রশাসনিক ভবনের সামনের একটি অর্জুন গাছ কেটে ফেলা হয়। গাছটিতে আশ্রয় নেয়া পাখির বাসায় তখন ওড়ার অপেক্ষায় ছিল শত শত শামুকখোল ছানা। গাছের সঙ্গে পড়ে মারা যায় তার কিছু, আবার কিছু ছানা ধরে জবাই করে স্থানীয় লোকজন। পাখি হত্যা ও তার আবাসস্থল ধ্বংস এবং পরিবেশের ক্ষতির অভিযোগে মামলা করা হয়। কিন্তু কারো শাস্তি হয়নি আজও। 

সামাজিক বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রামেক হাসপাতাল এলাকায় ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে ছোট-বড় মিলিয়ে ২৩৮টি গাছ কাটা হয়েছে। সম্প্রতি কোপ পড়েছে মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাস মাঠের গাছেও। দীর্ঘদিন ধরে যেখানে ছিল পাখপাখালির আবাস। এর বাইরে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ‘রাজশাহী নগরীর সমন্বিত নগর অবকাঠামো উন্নয়ন’ প্রকল্পের আওতায় নগরীর তালাইমারী-কাটাখালী, বন্ধগেট-সিটিহাট, ভদ্রা-পারিজাত লেক-নওদাপাড়া বাস টার্মিনাল, পোস্টাল একাডেমি-ম্যাচ ফ্যাক্টরি, ভেড়িপাড়া-হাইটেক পার্ক-ঢালুর মোড় এবং বক্ষব্যাধি ক্লিনিকের সামনের সড়কসহ বিভিন্ন রাস্তার উন্নয়নে কাটা পড়েছে বহু বছরের পুরনো ২ হাজার ২৭৮টি গাছ। রাজশাহী-নওহাটা-চৌমাসিয়া আঞ্চলিক মহাসড়ক উন্নয়নে গাছ কাটা পড়েছে ৪৪৫টি। গাছের জায়গায় বসেছে বাহারি সড়কবাতি।

তালাইমারী-সাহেববাজার-কোর্ট, তালাইমারী-ভদ্রা-রেলগেট সড়কে কিছু গাছ রয়ে গেলেও এর ভেতর দিয়ে বসানো হয়েছে ‘রাজমুকুট’খ্যাত ১৩টির গুচ্ছ সড়কবাতি। এছাড়া নগরীর প্রধান প্রধান সড়কের মোড়ে মোড়ে বসানো হয়েছে উচ্চক্ষমতার গুচ্ছ ফ্লাড লাইট। যেগুলো সন্ধ্যা থেকে আলো ছড়াচ্ছে ভোর অবধি। ফলে দিন আর রাতের পার্থক্য বুঝতে না পারায় শহরে আর আগের মতো পাখির কলকাকলি নেই।

গবেষকরা বলছেন, উজ্জ্বল আলোয় রাত-দিন গুলিয়ে ফেলছে পাখি। অস্বাভাবিকতা দেখা দিচ্ছে পাখির মধ্যে। স্বাভাবিক জীবনচক্রে বিঘ্ন ঘটছে। অস্তিত্ব রক্ষায় পাখি ছুটছে অন্য ঠিকানায়। তাই এখন আর দিনের বেলায় কাক, চড়ুই, শালিক ছাড়া তেমন কোনো পাখি চোখে পড়ছে না।

এদিকে রাজশাহী নগরীর উজানে টি-গ্রোয়েন থেকে ভাটিতে শ্যামপুর পর্যন্ত পদ্মায় প্রায় ১১ কিলোমিটার উঁচু চরভূমি। চওড়ায় এক কিলোমিটারেরও বেশি। এ চরেও চোখ পড়েছে নগর কর্তৃপক্ষের, গড়তে চায় রিভার সিটি। যেখানে থাকবে আবাসিক ও বাণিজ্যিক স্থাপনা। গড়ে তোলা হবে নদীবন্দরও। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সুনসান পদ্মায় নেমে আসবে চাঞ্চল্য। তাতেও পাখপাখালি বিপন্ন হবে বলে জানান পরিবেশবাদীরা।

গবেষকরা জানিয়েছেন, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের পদ্মার চরে এখন পর্যন্ত ২৭৯টি পাখি দেখা গেছে। এর মধ্যে ১৩২টি আবাসিক, ১২৬টি পরিযায়ী, ২১টি যাযাবর, নয়টি বিপদগ্রস্ত ও পাঁচটি অতিবিপন্ন। এছাড়া চোখে পড়েছে পাঁচটি মহাসাগরীয় অঞ্চলের পাখি। এখন পদ্মার চরে ‘রিভার সিটি’ বাস্তবায়ন হলে হুমকিতে ফেলবে চরের এসব পাখির আবাস।

পদ্মার চরে ১৫ বছর ধরে পাখি শনাক্ত করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. আমিনুজ্জামান মো. সালেহ রেজা। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘এ শতকের প্রথম দিকে মনে করা হতো, মেটে তিতির পাখি আমাদের দেশ থেকে হারিয়ে গেছে। তবে ২০১৮ সালে সেটি দেখা যায় পদ্মায়। এখন অনেক মেটে তিতির এখানে দেখা যায়। তবে সব পাখি এখন আর পদ্মার চরে ও রাজশাহীতে ব্রিড করতে পারছে না। ফলে এরা অন্য কোথাও গিয়ে আর ফিরছে না নতুন ঠিকানায়। আবার কিছু পাখি প্রজাতিরও হ্যাবিটেড নষ্ট হয়েছে। কারণ সড়কের বড় গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এছাড়া পদ্মার চরে খাবারের প্রাচুর্য থাকেলেও বাসা তৈরির জন্য উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় পাখির প্রজনন সম্ভব হচ্ছে না।’ নিরাপত্তা, ফুড সিকিউরিটি ও বাসা তৈরির মতো পরিবেশ না পেলে অনেক পাখিই বিপন্ন তালিকায় যুক্ত হবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন এ পাখি গবেষক।

অধ্যাপক ড. আমিনুজ্জামান মো. সালেহ রেজা আরো জানান, রাতের বেলা যেকোনো আলো পাখিদের জন্য ক্ষতিকর। প্রভাব পড়ে তাদের জীবনচক্রেও। ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাদের প্রজনন। ফলে জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশেরও ক্ষতি হয়। রাতচরা ও পরিযায়ী পাখি আলোয় বিভ্রান্ত হয়। তবে শহরের এ আলো ও পদ্মায় উন্নয়ন পরিকল্পনা চরের পাখির ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলবে তা সমীক্ষা না করে বলা মুশকিল বলে জানান এ গবেষক।

এদিকে পাখি সুরক্ষা উপেক্ষা করে গাছ কাটার বিষয়টি স্বীকার করেছেন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর ইসলাম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে পরিবেশগত সমীক্ষা করা হয়েছে। তবে সেখানে পাখি সুরক্ষার বিষয়ে কিছু আছে কিনা সেটি আমার জানা নেই।’ তবে তিনি দাবি করেন, শহরের যেসব এলাকায় পাখির বাস ছিল সেখানকার গাছপালা এখনো আগের মতোই আছে। আবার যেসব এলাকায় উজ্জ্বল আলোর সড়কবাতি বসানো হয়েছে, সেসব এলাকায় কখনই পাখির আবাস ছিল না। 

প্রকৌশলী নূর ইসলাম অবশ্য জানান, রাজশাহীতেই তার শৈশব, কৈশোর কেটেছে। আগে নগরীর রাস্তায় নানা জাতের পাখির দেখা মিলত। কিন্তু এখন কাক, চড়ুই, শালিক ছাড়া আর তেমন পাখির দেখা মেলে না।

দীর্ঘদিন ধরে পদ্মার চরে পাখির ছবি তোলেন পাখিপ্রেমী নাজমুল কামাল রনী। তিনি বলেন, ‘রাজশাহী পাখির হটস্পট। বিশেষ করে পদ্মার চরে সবচেয়ে বেশি পাখপাখালির আবাস। এটি তথ্যগতভাবে প্রমাণিত। এজন্যই পাখিপ্রেমীদের কাছে রাজশাহী আজ বার্ডশাহী নামে পরিচিত। বিষয়টি আমাদের জন্য গর্বের। তাই নীতিনির্ধারকদের উচিত পাখির আবাস ধ্বংস হয়, এর জীবনচক্র বিঘ্নিত হয় এমন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন না করা।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন