হিট স্ট্রোক

হিট স্ট্রোকে মৃত্যুও হতে পারে

শর্মিলা সিনড্রেলা

প্রতীকী ছবিতে মডেল হয়েছেন আত্তিন আখি ছবি: মাসফিকুর সোহান

সকালে বাড়ি থেকে যখন বেরিয়েছিলেন তখন পুরোপুরি সুস্থ ছিলেন মোহাম্মদ আলম। দুপুর হতে না হতেই পরিবারের সদস্যদের কাছে ফোন। অসুস্থ হয়ে তিনি হাসপাতালে। পরিবারের মানুষজন কোনোভাবে দৌড়ে হাসপাতালে পৌঁছে ডাক্তারের কাছ থেকে জানলেন, তিনি হিট স্ট্রোকের শিকার হয়েছেন।

ছয় বছরের ছেলেকে নিয়ে বের হয়েছিলেন রেহানা। বাইরে রোদের তেজ তীব্র, সঙ্গে ছাতা নেই, এর সঙ্গে যুক্ত হয় দীর্ঘক্ষণ কোনো যানবাহন না পাওয়ার যন্ত্রণা। এ অবস্থায় দীর্ঘক্ষণ রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ ছেলে পড়ে যায়। কী হলো বুঝতে পারেন না রেহানা। পরে জানা যায় শিশুটি হিট স্ট্রোকের শিকার। আবার গ্রামের খোলা মাঠে কাজ করছিলেন কৃষক আবদুস সালাম। হঠাৎ শরীর খারাপ হওয়ায় মাঠেই বসে পড়েন তিনি। কোনো রকমে তাকে বাড়ি নিয়ে আসা হয়। বাড়ির লোকজনের মতে, রোদ লেগে গেছে সালামের। 

এমন কিছু পরিস্থিতি আমাদের চেনা হলেও রোগটা সবার কাছে ‍খুব একটা চেনা নয়। তাই সচেতনতাও খুব একটা নেই। 

হিট স্ট্রোক কী

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের এ সময়ে সবচেয়ে তীব্রতর ও দীর্ঘতর তাপপ্রবাহের মুখোমুখি হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন অংশ। ফলে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যাও বাড়ছে। গবেষকরা বলছেন প্রতি বছর অনেক মানুষ মৃত্যুবরণ করছেন অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে। তবে এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে থাকেন ও অসুস্থ হয়ে পড়েন বয়স্ক ও শিশুরা। হিট স্ট্রোক কী? দ্য কনভারসেশনে প্রকাশিত এক লেখায় ব্রিয়ান ড্রামনড বলেন, ‘‌বাইরের তাপমাত্রা যদি শরীরের সহ্য করার মতো না হয় তাহলে কেউ কেউ হিট স্ট্রোকেরও শিকার হতে পারেন। শরীর যখন কোনোভাবেই বাড়তি তাপমাত্রায় মানিয়ে নিতে পারে না এবং নিজেকে ঠাণ্ডা রাখতে পারে না তখন এমন পরিস্থিতি দেখা যায়।’

সাধারণত পরিবেশের তাপমাত্রা অনেক বেড়ে গেলে শরীর ঘাম উৎপাদন বাড়িয়ে দেয় এবং ত্বকের ছোট ছোট রক্তনালি প্রসারিত করে দেয় যেন শরীরের  ভেতরের তাপমাত্রা উপরিত্বকে উঠে আসে। কিন্তু বাতাসে আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা বেশি হলে এ প্রক্রিয়া প্রশমিত হয়ে যায়। এর পরও ক্রমাগত রোদের মধ্যে থাকলে তাপমাত্রাজনিত অসুস্থতায় আক্রান্ত হতে পারে ব্যক্তি। এ অসুস্থতার প্রথম ধাপ হচ্ছে হিট ক্র্যাম্প। সেখানে ঘাম হওয়া, তৃষ্ণা পাওয়া বা মাংসপেশিতে ব্যথাও হতে পারে। তারপরে এক পর্যায়ে গিয়ে মানুষ হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক মো. শহীদুল্লাহ সবুজ বলেন, ‘‌দাবদাহের সময়ে বয়স্ক মানুষের মতো ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের শরীরে যদি বাড়তি তাপ যায় তাহলে কিছু শারীরিক সমস্যা হতে পারে। ফলে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়, সঙ্গে ব্রেনের কিছু ডিজফাংশন হয়। অনেকের কথাবার্তা জড়িয়ে আসে, খিটখিটে হয়ে যায়, এমনকি অনেক সময় অজ্ঞান হয়ে যায়। এ সময় হার্টবিট বা শ্বাসের গতি বেশি থাকে, প্রেসার কমে যায়। এসবই হিট স্ট্রোকের লক্ষণ। গ্রামের খোলা মাঠে কাজ করা কৃষকরা এর প্রবল ঝুঁকিতে থাকেন।’ 

তিনি যোগ করেন, হিট স্ট্রোকে কিডনি ফেইলিওর, লাঙস ফেইলিওর, লিভার ফেইলিওর, হার্টের সমস্যা, রক্তনালিতেও রক্ত জমাট বাঁধার সমস্যা হতে পারে। তাই কত সময় রোদে ছিলেন, কুলিং করতে দেরি হলো কিনা, আক্রান্তের শরীরের কোন অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হলো তার ওপর নির্ভর করবে মৃত্যুঝুঁকি কতটা রয়েছে। কেউ যদি রোদে অনেকক্ষণ থাকার পর অজ্ঞান হয় তাহলে বলি যে তার হিট স্ট্রোক হয়েছে। ঘরে থেকেও কারো হিট স্ট্রোক হতে পারে। এমন হলে আক্রান্তকে দ্রুত প্রাথমিক সেবা দিয়ে হাসপাতালে নিয়ে আসা জরুরি।

হিট স্ট্রোক থেকে বাঁচতে হলে কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ এ ডাক্তারের। তিনি বলেন, ‘‌হিট স্ট্রোক হয়ে গেলে দ্রুত শরীরকে ঠাণ্ডা করার ব্যবস্থা করতে হবে। তারপর হাসপাতালে আনা হলে আমরা প্রেসার বাড়ানোর চেষ্টা করি, শ্বাসকষ্ট হলে অক্সিজেন দিই। এসবই অত্যন্ত জরুরি। দাবদাহের সময়ে হিট স্ট্রোক প্রতিরোধে প্রচুর পানি খেতে হবে, ওরস্যালাইন খেতে হবে, সরাসরি রোদে না থেকে ক্যাপ পরতে হবে, মাঝে মাঝে ছায়ায় থাকতে হবে।’

ইউনিভার্সিটি অব অ্যারিজোনার ইমার্জেন্সি মেডিসিনের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ব্রিয়ান ড্রামনড এক লেখায় জানান, ‘‌হিট স্ট্রোক খুবই ভয়াবহ একটি সমস্যা। এর কারণে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এমনকি যদি যথাযথ চিকিৎসা না হয় তাহলে মৃত্যুও হতে পারে। এ সমস্যায় আক্রান্ত হলে শরীরের তাপমাত্রা তাৎপর্যপূর্ণভাবে বৃদ্ধি পায় এবং তা রোগীর মানসিক অবস্থাকে প্রভাবিত করে।’

হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে ব্যক্তি কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, খিটখিটে হতে পারে, হ্যালুসিনেশন করতে পারে, এমনকি কোমাতেও যেতে পারে। হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁটতে সমস্যা হতে পারে, পেশিতে কম্পন হতে পারে এবং হৃৎস্পন্দন মিনিটে ১৩০-এর বেশি হতে পারে, স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক দ্রুত শ্বাস নিতে পারে, শরীরের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের থেকেও বেড়ে যেতে পারে।

হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার বেশকিছু লক্ষণ রয়েছে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে, মনে হতে পারে আক্রান্ত ব্যক্তি কোকেন গ্রহণের মতো প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে, অ্যাসপিরিনের মতো ওষুধের প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, কোনো তীব্রতর সংক্রমণ হয়েছে বা অ্যালকোহল সরিয়ে নেয়ার প্রতিক্রিয়া হয়েছে। আবার হিট স্ট্রোকে আক্রান্তের শরীরের তাপমাত্রা খুব দ্রুত নেমেও যেতে পারে। সে বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে।

হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে প্রথমত ব্যক্তিকে একটি ঠাণ্ডা জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। এ সময়ে তার পুরো শরীরে ঠাণ্ডা পানি ঢালতে হবে। সরাসরি ঠাণ্ডা বাতাসের নিচে তাকে রাখতে হবে। উষ্ণ পানির ব্যবহার করলে শরীরের কম্পন বন্ধ হবে। এভাবে কম্পনের মধ্যে দিয়ে শরীর তাপমাত্রা তৈরি করে। এরপরে তাপমাত্রা আবার ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে গেলেই ঠাণ্ডা করার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিতে হবে। তা না হলে হাইপোথার্মিক পরিস্থিতি তৈরি হবে, যেখানে শরীরের তাপমাত্রা অনেক বেশি নেমে যায়।

হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত ব্যক্তিকে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে তার রক্তে ইলেকট্রোলাইটের পরিমাণ এবং হাইড্রেশন পর্যবেক্ষণ করার জন্য। পাশাপাশি অন্য কোনো অঙ্গ কার্যক্ষমতা হারাচ্ছে কিনা তাও বিশ্লেষণ করা জরুরি।

সবচেয়ে বড় কথা গরম তীব্র হলে মানুষের অসুস্থ হয়ে পড়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। তাই এ সময়ে সতর্ক থাকতে হবে অনেক বেশি। কোনো রকমের শারীরিক সমস্যা বোধ করলেই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে দ্রুত।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন