প্রতি ১০ জনে পাঁচ নারীর ওভারিতে সিস্ট পাওয়া যায়

ডা. ছাবিকুন নাহার

ডা. ছাবিকুন নাহার

শরীরে যেকোনো তরল পদার্থ দিয়ে পূর্ণ স্যাক বা থলেকে সিস্ট বলে। সিস্ট যখন নারীর ডিম্বাশয় বা ওভারিতে হয় তখন তাকে ওভারিয়ান সিস্ট বলে। এটা খুবই কমন একটা কন্ডিশন। দশজন নারীকে টেস্ট করলে পাঁচজনের মধ্যে কম-বেশি কোনো না কোনো সিস্ট পাওয়া যাবে।

সাধারণত দুই ধরনের সিস্ট পাওয়া যায়। এর মধ্যে একটি ফাংশনাল বা ফিজিওলজিক্যাল বা শারীরবৃত্তীয় সিস্ট। আর অন্যটি প্যাথলজিকাল বা রোগের কারণে সৃষ্ট সিস্ট। 

ফাংশনাল সিস্ট

বেশির ভাগ সিস্টই ফিজিওলজিক্যাল বা স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় ধরনের হয়। হরমোনের তারতম্যের জন্য এটা হয়ে থাকে। হরমোনাল ব্যালান্স ঠিক হয়ে গেলে তা আবার সেরেও যায়। যেমন—

I ফলিকুলার সিস্ট বা ফিজিওলজিক্যাল সিস্ট

I থিকা লুটেইন সিস্ট

I করপাস লুটিয়াল সিস্ট ইত্যাদি

প্যাথলজিক্যাল সিস্ট

প্যাথলজিক্যাল সিস্ট কোনো না কোনো রোগের জন্য হয়ে থাকে। যেমন— 

I এন্ডোমেট্রিওসিস 

I পিসিওএস—পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম 

I ডারময়েড সিস্ট

I প্যারাওভারিয়ান সিস্ট

I নেবোথিয়ান সিস্ট

I ম্যালিগন্যান্ট ওভারিয়ান টিউমার—ক্যান্সার জাতীয় সিস্ট। পার্টলি সিস্টিক পার্টলি সলিড ধরনের হয়ে থাকে

I গার্টনার ডাক্ট সিস্ট ইত্যাদি

এদের চিকিৎসা লাগে।

আমি আগেই বলেছি, সিস্ট তরলজাতীয় পদার্থ দিয়ে পূর্ণ থাকে। কী জাতীয় তরল তার ওপর নির্ভর করে নামকরণ করা হয়। সিস্টে সিম্পল পানি বা প্লাজমা থাকলে সিম্পল সিস্ট বা ফিজিওলজিক্যাল সিস্ট বা ফলিকুলার সিস্ট বলে। রক্ত থাকলে হেমোরেজিক সিস্ট। 

এন্ডোমেট্রিওসিস নামক এক ধরনের রোগে সিস্ট হয়। এতে রক্ত দিনের পর দিন জমে চকোলেট কালারের ধারণ করে বলে চকোলেট সিস্ট বলে। এটা মারাত্মক রোগ। এ রোগে আক্রান্তরা বন্ধ্যাত্বে ভোগে শতকরা চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ ভাগ। ফলে চিকিৎসা জরুরি। 

অনেক ছোট ছোট সিস্ট ডিম্বাশয়কে মালার মতো জড়িয়ে রাখলে পলিসিস্টিক ওভারি বলে। পিসিওএস নামক রোগে হয়। এ রোগে আক্রান্তদের নানাবিধ সমস্যা থাকে। অনিয়মিত পিরিয়ড, মুটিয়ে যাওয়া, এক্সেসিভ হেয়ার অ্যাবনরমাল গ্রোথ, বন্ধ্যাত্ব ইত্যাদি। চিকিৎসা জরুরি। 

ডারময়েড নামক এক ধরনের সিস্ট হয়, যাতে মানুষের শরীরের চুল, দাঁত, হাড় পাওয়া যায়। এটা টরশন বা প্যাঁচ খেয়ে যেতে পারে। ফলে মারাত্মক ব্যথা হতে পারে। ক্যান্সারও হতে পারে, তবে মাত্রা খুব কম। চিকিৎসা জরুরি। 

ক্যান্সারজাতীয় সিস্টে তরলের সঙ্গে সলিড জিনিসও থাকে। থাকে আরো অনেক কিছু। সাধারণত বয়স্ক নারীদের হয়। চিকিৎসা দ্য মাস্ট। ক্যান্সার বলে কথা। 

উপসর্গ

এসবের সাধারণত তেমন কোনো উপসর্গ থাকে না। তবে রোগভেদে বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দিতে পারে। যেমন তলপেটে ব্যথা, মাসিকের সময় ব্যথা, অনিয়মিত মাসিক, তলপেটে ভারী লাগা, বন্ধ্যাত্ব ইত্যাদি। 

ডায়াগনোসিস

ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং আল্ট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে সিস্ট ডায়াগনোসিস করা যায়। কিছু টিউমার মার্কার করা হয় সিস্টটা ক্যান্সার জাতীয় কিনা বোঝার জন্য। যেমন সিএ-১২৫, সিএ-১৯৯, সিইএ।

চিকিৎসা

সিস্টের চিকিৎসা নির্ভর করে অনেক কিছুর ওপর। সিস্টের ধরন, সিস্টের সাইজ, রিলেটেড ডিজিজ, বয়স ইত্যাদি। যদি স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় সিস্ট হয়, সাইজ যদি ছোট হয়। কোনো চিকিৎসা লাগবে না। শুধু ফলোআপ করতে হবে। সাইজ বড় হলে, আপটু ৬ সেন্টিমিটার পর্যন্ত ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা যায়। সাধারণত খাবার পিল তিন মাস দিলেই চলে। অন্যান্য সিস্ট চিকিৎসা করা হয় রিলেটেড রোগ অনুযায়ী। চকোলেট সিস্ট হলে ওষুধের পাশাপাশি সার্জারিও লাগে। এ রোগীদের বন্ধ্যাত্ব হতে পারে। পিসিওএস হলে ওষুধের পাশাপাশি জীবনযাপনের ধরনে পরিবর্তনও আনতে হবে। ওজন কমানো, ব্যায়াম, খাবার নিয়ন্ত্রণ ও হরমোনাল ব্যালান্সও জরুরি।

ডারময়েড সিস্টের ক্ষেত্রে সিস্ট পেডিকল লম্বা থাকে। ফলে টরশন বা প্যাঁচ লেগে যেতে পারে। যা একটা মারাত্মক কন্ডিশন। এতে রোগী বাঁচাতে ইমার্জেন্সি অপারেশন লাগে। ক্যান্সার জাতীয় সিস্ট হলে ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করার সুযোগ নেই। সার্জারি হলো মূলধারার চিকিৎসা। এসব ক্ষেত্রে ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ এবং বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা লাগবে। বয়স্ক রোগী, পরিবার কমপ্লিট হলে এবং রিপিটেড সিস্ট হলে এবং ওষুধে কাজ না হলে সার্জারি করতে হয়।

জটিলতা

সিস্ট চিকিৎসা না করলে নানা জটিলতা হতে পারে। যেমন রাপচার বা ফেটে যাওয়া, টরশন বা প্যাঁচ লেগে যাওয়া, ক্যান্সারে রূপান্তরিত হওয়া ইত্যাদি। আশার কথা হচ্ছে স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় সিস্টে এসব কিছু সাধারণত হয় না।

সিস্ট নিয়ে এত কিছু লিখে আপনাদের মাথায় চাপ সৃষ্টি করতে চাই না। শুধু এটুকু বলতে চাই, সিস্ট ছোট হোক বা বড়, ভালো হোক বা মন্দ প্যানিক হবেন না, আবার রিলাকট্যান্টও থাকবেন না। একজন নির্ভরযোগ্য গাইনি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাবেন। তার পরামর্শমতো প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা নেবেন। প্রয়োজনে ফলোআপ করবেন, ব্যস! মনে রাখবেন সুস্থতা সকল সুখের মূল। সুস্থ থাকেন সুখে থাকেন। শুভকামনা রইল।

লেখক: গর্ভবতী, প্রসূতি, স্ত্রী ও গাইনি রোগ বিশেষজ্ঞ ও রেসিডেনশিয়াল সার্জন, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন