উত্তরার
গ্যালারি কায়ায়
৩ থেকে
১৪ ফেব্রুয়ারি
শিল্পী নাজিব
তারেকের অষ্টম
একক চিত্র
প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত
হলো। প্রায়
৫৭টি ছাপচিত্র
দিয়ে সাজানো
ছিল এ
প্রদর্শনী। কোয়ার্টার
সাইজের ছবিগুলো
ছিল মূলত
ছাপা ছবি।
ক্যাটালগের মুখবন্ধে
শিল্পীর আত্মকথন
থেকে জানা
যায়, চারুকলা
পাঠের তার
একমাত্র পছন্দের
মাধ্যম ছিল
এ ছাপচিত্র।
আর পছন্দের
কারণটি হলো
এটি জনবান্ধব
শিল্প। অর্থাৎ
মধ্যযুগ থেকে
শুরু করে
আধুনিক যুগেও
এসে দেখা
যায় ছাপচিত্র
জনশিল্প হিসেবে
সমান গুরুত্বপূর্ণ।
মূলত উনিশ
শতকেই কলকাতাকেন্দ্রিক
ছাপচিত্রের বাজার
তৈরি হয়
এ ভারতবর্ষে।
বটতলার ছাপা
ছবি থেকে
শুরু করে
কলকাতা আর্ট
স্টুডিও—ছাপচিত্রের
এক যুগান্তকারী
ব্যুত্পত্তি দেখা
যায় এই
বঙ্গে। আর
এ ছাপচিত্রের
অনেকের মধ্যে
অন্যতম নাম
হচ্ছে ‘অন্নদা
প্রসাদ বাগচী’,
যিনি ছাপচিত্রী
হিসেবে মাধ্যমটির
আধুনিকতার পথ
দেখান। আধুনিক
ছাপা পদ্ধতি
লিথোগ্রাফ ও
ব্রডশিট কাগজে
ছাপা পদ্ধতির
মূল রূপকার
ছিলেন তিনি
এবং কলকাতা
আর্ট স্টুডিওর
কর্ণধাররা। সে
সময় মূলত
ছাপচিত্র চারুকলা
পাঠে অন্তর্ভুক্তির
অন্যতম কারণ
ছিল এ
বিভিন্ন সচিত্রকরণ
ও প্রিন্টিং
প্রেসের অর্থাৎ
মুদ্রণ শিল্পের
ছাপায় নান্দনিকতা
দান। এখানে
শিল্পীর আত্মকথন
থেকে ঠিক
সে রকমই
যোগসূত্রের সুর
খুঁজে পাওয়া
যায়। তার
শিল্পের যাত্রা
হয় সচিত্রকরণ
দিয়ে। নিছক
সচিত্রকরণে আটকে
থাকেন না,
শিল্পের দায়টি
তিনি সঠিক
বোঝেন। সাম্প্রতিক
সময়ের ছাপচিত্রে
দেখা যায়
আদি অকৃত্রিম
মাধ্যম রিলিফ
পদ্ধতির। অর্থাৎ
ছাপচিত্রের প্রথম
দিককার যে
পদ্ধতি, তার
মধ্যে একটি
হচ্ছে সারফেস
(জমিন) খোদাই
করে এবং
আরেকটি হচ্ছে
সারফেস থেকে
মূল বিষয়টিকে
জমিন থেকে
উঁচু করে
ধরা, অর্থাৎ
যাকে ইংরেজিতে
রিলিফ প্রসেস
বলা হয়।
শিল্পীর এ
সাম্প্রতিক প্রদর্শিত
সব ছবিই
হচ্ছে পিভিসি
বোর্ডে রিলিফ
প্রসেসে করা।
ছবির
বিষয় হিসেবে
দেখা যায়
মানব-মানবীর
অবয়ব, স্থির
জীবন এবং
পশু-পাখি
চিত্রণ ইত্যাদি।
সব ছবির
নাম হচ্ছে
‘আনটাইটেলড’
বা ‘শিরোনামহীন’।
ছাপচিত্র ছবির
বিশেষ সুবিধার
দিক হচ্ছে
মূল প্লেট
বা ফলক
থেকে অনেক
ছবির অনুকৃতি
করা যায়।
একাধিক অনুকৃতিতে
যদি শিল্পীর
স্বাক্ষর থাকে
তাহলেও মূল
প্রতিলিপি হিসেবে
ধরে নিতে
হয়। অনুকৃতির
কত সংখ্যার
ছবি প্রদর্শিত
হচ্ছে সেটি
ছাপচিত্রের বাজারের
জন্য বিশেষ
বিবেচ্য বিষয়,
যা এ
প্রদর্শনীতে উপেক্ষিত
থেকে গেছে
এবং নির্দিষ্ট
সময় মূল
প্লেট বা
ফলকটি ছাপার
অনুপযুক্ত হলে
তা নষ্ট
করে ফেলতে
হয়। ছবি
রসিকজনের কাছে
বিকোবার ক্ষেত্রেও
এ ছাপা
ছবির অনুকৃতির
সংখ্যা বেশ
গুরুত্বপূর্ণ।
নাজিবের
ছবির বিশেষ
দিক হচ্ছে
অতিপরিচিত বিষয়ের
কাব্যিক উপস্থাপন।
যেমন কাক,
বেড়াল, হাতি,
হাঁস, বক
ইত্যাদি বিষয়কে
তিনি একঘেয়েমি
রূপ থেকে
মুক্তি দেন
এবং নিজস্ব
রূপকল্প তৈরি
করেন, শিল্পাচার্য
জয়নুল আবেদিনের
কাকের যে
রূপকল্প তা
থেকে নজিবের
কাকের রূপ
একেবারে ভিন্ন।
শিল্পাচার্যের কাক
যেমন ক্যাপিটালিস্টদের
প্রতীক, যেটি
সবসময় ক্ষুধার্ত
মানুষের খাবারে
ভাগ বসায়।
নাজিব ঠিক
তার বিপরীতে
এ বায়সকে
আলংকারিক কাব্যিক
মহিমায় উদ্ভাসিত
করেন, আবার
কামরুল হাসানের
পশু-পাখির
চিত্রে রেখার
যে গতিময়তার
লালিত রূপ
দেখা যায়,
সেটির আলতো
আভা দেখা
যায় তার
ছবিতে। বহিরবয়ব
আকৃতির ছবিতে
অন্তর্বর্তী লালিত
রেখা দিয়ে
আকৃতির ত্রিমাত্রিকতা
দান করেন।
তিনি জানেন
ছবিতে কীভাবে
ভর তৈরি
করতে হয়,
আবার পশু-পাখির
চিত্রে গল্প
বলার ঢঙটিও
দেখা যায়
তার ছবিতে।
ভারতীয় পশু-পাখি
চিত্রের ঐতিহ্যগত
পরম্পরা সর্বজনবিদিত।
সেই মধ্যযুগের
বিদপাই রচিত
‘করটক
দমন কথা’
থেকে বৌদ্ধ
‘প
তন্ত্র’ হয়ে
মধ্যপ্রাচ্যের ‘কালিলা-ওয়া-দিমনা’র
পাণ্ডুলিপি চিত্রের
হিতোপদেশের গল্প
বলার রূপটি
ভেসে ওঠে
তার ছবিতে।
শুধু
বিষয় বৈচিত্র্য
নয়, নাজিবের
ছবিতে পদ্ধতিগত
মিশ্রণ বা
সিন্থেসিস ঘটেছে
বহিরবয়ব আকৃতিতে।
কখনো চিত্রের
বহিঃরেখা, বিন্দু,
এলোমেলো রেখার
মিশ্রণ ঘটিয়েছেন।
বেশির ভাগ
ছবিতে দেখা
যায় শিল্পী
মূল বিষয়কে
ফোকাস করেন।
অর্থাৎ মূল
বিষয়কে রেখে
বাকি শূন্য
স্পেস ছেড়ে
দেন। ‘শূন্যতাই
শিল্প’—চীন
ও জাপানের
দর্শনগত ভাব
সদাই বিরাজমান
ছবিতে। এখানে
পটের সাদা
জমিনের সঙ্গে
রঙের বা
বিষয়ের পরস্পর
ভাবের সংযোগ
ঘটে। শিল্পীর
এ সার
সংগ্রহকারী মনোভাব
চিত্রে আধুনিকতার
দ্যোতনা তৈরি
করে এবং
একই সঙ্গে
প্রাচ্যের আধ্যাত্মিক
ভাব ব্যঞ্জনাটিও
বজায় থাকে।
নাজিবের ছবিতে মানুষের অবয়ব এসেছে কিছু ভয়াল রূপে। হয়তো করোনাকালের ভয়াল, অন্ধকারের প্রকট প্রভাব পড়াটা অস্বাভাবিক নয়। কিছু ছবিতে রাগী অভিব্যক্তিও পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ Untitled-7, Untitled-13,
Untitled-19, Untitled-2, Untitled-3 ইত্যাদি রূপকল্পের কথা বলা যেতে পারে। নাজিবের ছবির বিশেষ গুণটি হচ্ছে, ছবির ভাস্কর্যগুণ দান, ছবি হাওয়ায় উড়ে যায় না। ছবি ভর ও ওজন নিয়ে কথা বলে। এখানেই শিল্পী নান্দনিকভাবে সার্থক।