![](https://bonikbarta.net/uploads/news_image/news_330825_1.jpg?t=1720073046)
গ্যালারিতে ঢোকার সময় প্রস্তুত ছিল চোখ, সহসা কানও খাড়া করতে হয়। সাবেক আমলের বেতার ভাষ্য আজকাল খুব একটা শোনা যায় না; তবে ভীষণ পরিচিত। করোনাকালের সহায়তার আশ্বাসবাণী শোনা যাচ্ছিল। সেই সময় নিয়ে ‘অন্তর্বর্তী’
নামের প্রদর্শনী। নিজেদের ২৪ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজনটি করেছে আলোকচিত্রের স্কুল পাঠশালা। ঢাকা গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকটি বড় আয়োজনের সাক্ষী। এ প্রদর্শনী সে তুলনায় হ্রস্ব, স্বভাবতই!
সমসাময়িক ১২ জন আলোকচিত্রীর কাজ স্থান পেয়েছে ‘অন্তর্বর্তী’-তে, কভিডের সময়ে যারা ঘরে বা বাইরে সময় কাটিয়েছেন। যেহেতু তারা শিল্পী, ধান ভানতে গেলেও সেই গীতটাই গাইবেন। সে সময়ে অন্যকে দেখেছেন, আবার দৈনন্দিনতার মাঝে আত্মনিরীক্ষণ করেছেন। স্থিরচিত্র-গতিশীল দৃশ্য বা অডিওগ্রাফি ও কোলাজে উঠে এসেছে সে অন্তর্বর্তীকাল। গতকাল শেষ হওয়া আয়োজনটির কিউরেটর ছিলেন আলোকচিত্রী ও ভিজ্যুয়াল আর্টিস্ট সরকার প্রতীক।
‘উইন্ডোজ অ্যান্ড মিররস’
নামের ভঙ্গিকে প্রাধান্য দিয়েছেন তিনি। গত শতাব্দীর মাঝামাঝিতে আলাপটি সামনে আনেন মার্কিন আলোকচিত্রী, কিউরেটর ও তাত্ত্বিক জন সারকায়োস্কি। সে হিসেবে ছবি কখনো জানালা, আবার কখনো যেন আয়না। জানালা দিয়ে বাইরের জগৎ দেখার মতো করে অন্যকে দেখায়। একইভাবে আয়নায় নিজেকে দেখার মতো, ছবির অন্তরালে বা সমান্তরালে আলোকচিত্রী তার মনস্তাত্ত্বিক জগত্টাকে প্রতিফলিত করান। সব মিলিয়ে ‘অন্তর্বর্তী’
মূলত আন্তঃযোগাযোগের নথি। নিরন্তর কথা চালাচালি।
কিউরেটর ও গবেষক তানজিম ওয়াহাব একজন আলোকচিত্রীও। বাবা ডাক্তার আব্দুল ওয়াহাব ২০২০ সালে কভিডে মারা যান, বাবার দুনিয়াবি সফর ও শেষ দিনের কথা তুলে ধরেছেন তানজিম নিজের তোলা ছবির সূত্রকথায়। তার মন্তব্য, ‘মৃত্যু দূরত্ব কমায় আর অনুপস্থিতি কাউকে আরো তীব্রভাবে হাজির করতে পারে সেটা আগে জানতাম না।’
তানজিমের ছবিতে কোনো মানুষ নেই, কিন্তু এই অনুপস্থিতি কত কথা বলে দেয়।
তসলিমা আখতারের সিরিজ ‘কভিডকালে নতুন বাস্তবতা ও পোশাক শ্রমিকরা’। শ্রমিক আন্দোলনের নেত্রী হিসেবেও তিনি পরিচিত। স্থিরচিত্রের পাশাপাশি যুক্ত করেছেন ভিডিও কথোপকথন। ঘরবন্দি থেকে অর্থনীতির চাকা সচল করতে ঝুঁকি নেয়া শ্রমিক ও অন্যদের সঙ্গে আলাপ করেছেন। আন্তরিকভাবে পোশাক শ্রমিকদের জীবন পাঠ করেছেন তিনি। যেখানে শ্রমিকদের রয়েছে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। বেঁচে থাকার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টার চেয়ে স্বতঃস্ফূর্ত আর কী-ইবা হতে পারে।
এও মনে হতে পারে, স্থিরচিত্রের সঙ্গে সচল চিত্র-শব্দের মেলবন্ধনের চেষ্টা কোথাও যেন মাধ্যম হিসেবে ক্যামেরার অপর্যাপ্ততা নির্দেশ করে। ব্যক্তিভেদে এ বিচার নিশ্চয় আলাদা। কিন্তু দাগিয়ে দিয়ে দেখানোর চেষ্টাটা প্রবল। ছোট পরিসরে ভিন্ন ভিন্ন কোণ থেকে আলাদা অডিও প্রক্ষেপণ মনোযোগ বিক্ষিপ্ত করে। হ্যাঁ, তা যদি প্রদর্শনীর লক্ষ্য হয়, অন্য কথা।
করোনাকালে আটজন তরুণ শিল্পীকে নিয়ে কাজ করেছেন সালমা আবেদিন পৃথ্বী। ‘ডায়েরি অব করোনা’
নামের সিরিজে লকডাউনের নিঃসঙ্গতা এসেছে ভীষণভাবে। রোজকার জীবন ও আশপাশের পরিবেশটা ফুটে উঠেছে। একই ধরনের সিরিজ ‘হোম’। এর কারিগর মো. ফজলে রাব্বী ফটিক। সম্প্রতি ঢাকা আর্ট সামিটে ‘মরীচিকা’
সিরিজ দিয়ে পুরস্কার জিতেছেন। ‘হোম’ সেই তুলনায় আলাদা। জগেক ক্ষুদ্রভাবে ভেঙে বড় আসপেক্ট থেকে দেখা। যেন সেই দর্শনই করছেন, প্রতিটি অণুতে আঁকা আছে পুরো বিশ্বের ছবি। মাছের ছবি। তবে পুরোটা নেই, একটা টুকরো অথবা মাথা। জাম্বুরা। তবে পুরোটা নয়, কয়েকটি কোয়া। কভিডকালীন আমাদের বাকি দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজের দিকে বা অস্তিত্বের ভঙ্গুরতার দিকে ফিরিয়েছে, আরো নিবিড় করে দেখাদেখি উঠে এসেছে। শুরুতে কান খাড়া হওয়ার কথা বলেছিলাম। বিষয় ‘বাবা বেতার’। মূলত কভিডকালীন রেডিও শো পুনরায় সাজানো হয়েছে। ওই প্লাটফর্মে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন আঞ্চলিক অনুষ্ঠান প্রচার হয়। প্রদর্শনীর জন্য আরেক দফা গুছিয়েছেন আরফান আহমেদ।
নতুন করে বলার নয় যে দুনিয়াকে দেখার মাধ্যম কখনো আলাদা করে পাঠের বিষয় নয়। সময় ও তার রাজনীতি এবং ভবিষ্যৎ থেকে পাঠের বিষয়ও তাই। সেদিকে ‘বাবা বেতার’
গুরুত্বপূর্ণ নথি। অথবা অন্য সিরিজগুলোও। সেখানে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অ্যাক্টিভিজম সামনে এসেছে। প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। শিল্প তো মানুষেরই জন্য।
বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ না থাকায় বাকি আয়োজনের শিরোনাম উল্লেখ করি শেষকালে। মাহফুজ মাহবুব তূর্যর ‘হ য ব র ল’, হাবিবা নওরোজের ‘টাং টাইড’, শৌণক দাশের ‘ইডেটিক ইমাজিনেশন’, দেবাশীষ চক্রবর্তীর ‘স্ট্রেঞ্জ এনটিটিজ’, শুভ্র কান্তি দাসের ‘মাই জার্নি অ্যাজ আ উইটনেস’ ও সাব্বির আহাম্মদের ‘সারফেস’।