বাংলার শিল্পের এক নিবিড় সাধক

সিলভিয়া নাজনীন

ছবি: সফিউদ্দীনআহমেদডটকম

বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পচর্চা ইউরোপিয়ান একাডেমিক রীতি এবং তার সঙ্গে কলকাতাভিত্তিক শিল্পশিক্ষা চর্চার সমন্বয়ের ভেতর দিয়ে নির্মিত হয়েছিল। ১৯৪৮ সালেগভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস্থাপনের মাধ্যমে দেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পচর্চা আরম্ভ করেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। তার উদ্যোগের সঙ্গী হয়েছিলেন শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ, আনোয়ারুল হক, খাজা শফিক আহমেদ, কামরুল হাসান প্রমুখ। শিল্পীরা চল্লিশের দশকে আত্মপ্রকাশ করেন এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশের শিল্পচর্চার ইতিহাসে অনিবার্য নাম হয়ে ওঠেন। শিল্পীদের নিজস্ব শৈলীচিন্তা, শিক্ষণচিন্তা তার পদ্ধতি বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকলার গতিপ্রকৃতি নির্মাণে কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে।

শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ ১৯২২ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩৬ সালে তিনি কলকাতা সরকারি আর্ট স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। সময়ে কলকাতা আর্ট স্কুলের প্রথম ভারতীয় অধ্যক্ষ ছিলেন মুকুল চন্দ্র দে, যার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অত্যন্ত স্নেহপ্রীতিমূলক সম্পর্কের কথা আমরা জানি। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহযাত্রী হিসেবে জাপান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং ছাপচিত্রের করণকৌশল নিয়ে লেখাপড়া করেন। পরবর্তী সময়ে অধ্যক্ষ মুকুল চন্দ্র দেই আর্ট স্কুলে প্রথমবারের মতো ছাপচিত্র শেখানোর উদ্যোগ নেন এবং রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে সেখানে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ দুই শিল্পীর মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়ে ছাপচিত্রের জগতে প্রবেশ করেছিলেন।

জলের নিনাদ-১/ ছবি:  সফিউদ্দীনআহমেদডটকম


ছাপচিত্র তখন চিত্রাঙ্কনের সহায়ক বিদ্যা হিসেবে বিবেচিত হতো। সেভাবেই আর্ট স্কুলে শেখানো হতো। এক্ষেত্রে সফিউদ্দীন আহমেদের অবদানের জায়গা হলো ছাপচিত্রে তার বিশেষ রকম দক্ষতা সৃজনশীলতা দিয়ে তিনি আপাত গৌণ বিষয়টিকে একটি সমৃদ্ধিশালী শিল্পমাধ্যম হিসেবে এখানকার শিল্পজগতে পরিচিত করে তোলেন। কাঠ খোদাই বা উড এনগ্রেভিং মাধ্যমে তিনি সারা ভারতেই একজনসর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পীহিসেবে বিবেচিত হতেন। শিল্পী সফিউদ্দীন ১৯৪৬ সালে কলকাতা আর্ট স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। তার উত্তরসূরি হিসেবে ভারতের ছাপচিত্রের প্রথম সারির শিল্পী সোমনাথ হোরের নাম উল্লেখ করা যায়। সোমনাথ হোর ভারতের ছাপচিত্রকে এক অনন্য পর্যায়ে উন্নীত করেছেন।


দেশভাগের পর শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন যখন তৎকালীন পূর্ব বাংলায় শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণের ব্যাপারে উদ্যোগী হন তখন শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদও অন্যান্য মুসলিম শিক্ষকের মতো বাংলাদেশে চলে আসেন। কলকাতায় সে সময়ে ধর্ম, পুরাণ আর ঐতিহ্যকে আশ্রয় করে এক ধরনের শিল্পচর্চা চলছিল। অন্যদিকে বাংলাদেশের চল্লিশ দশকের শিল্পীদের মধ্যে স্বদেশচেতনা, প্রকৃতি, সাধারণ জনজীবন ইত্যাদি বিষয়বস্তু হিসেবে প্রাধান্য পেয়েছিল এবং একটি স্বতন্ত্র সমৃদ্ধ শিল্পধারার প্রচলন ঘটেছিল। বাংলাদেশে আসার আগে শিল্পী সফিউদ্দীনের ছবির অভিজ্ঞতা কলকাতার নাগরিক পরিবেশ থেকে শালবন বা দুমকা ইত্যাদি গ্রামের ল্যান্ডস্কেপ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, কিন্তু পূর্ব বাংলায় আসার পরে এখানকার গভীর প্রকৃতিময়তা, অবারিত জলরাশি, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা তাকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে। এরপর তার চিত্রকর্মের বিষয়বস্তুতে বাংলার নিসর্গ, জল, মাছ, নৌকা ইত্যাদি প্রাধান্য পেতে থাকে। একই সঙ্গে তার ছবিচোখপ্রতীকায়িত হতে শুরু করে।


সময়ে সফিউদ্দীনের ছবিতে আকারগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা আলো-ছায়ার বিন্যাসের ব্যাপারে আগ্রহ লক্ষণীয় ছিল। ধীরে ধীরে তিনি আলো-ছায়াকে বর্জন করতে থাকেন এবং তার ছবিতে বিমূর্ততার প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়। ১৯৫৮ সালে তিনি লন্ডনের সেন্ট্রাল স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটসে ছাপচিত্র বিষয়ে ডিস্টিংশনসহ ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করেন। সময়ে তিনি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গ্যালারি জাদুঘরে ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং একই সঙ্গে তার নিজস্ব ছবির রসদ সংগ্রহ করেছেন। সময়ে তার ছবিতে আরো কিছু পরিবর্তন দেখা গিয়েছে। বিশেষত তার চিত্রপটের রঙ জ্যামিতিক নকশায় পরিবর্তিত হয়ে ওঠার ব্যাপারটি উল্লেখযোগ্য। একই সময়ে তিনি পূর্ব বাংলার বন্যার অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। ফলে দেশ-প্রকৃতি-মানুষ-সমতলকে প্লাবিত করা জলরাশির ছবিও তাকে আমরা আঁকতে দেখি।


পশ্চিমবঙ্গের রাঢ়বঙ্গ ঝাড়খণ্ডের নিসর্গ দৃশ্যের যে রোমান্টিকতা, যে রকম আকর্ষণীয় রঙ, রেখা, মাধুর্য অনুভূতির ব্যবহার আমরা তার ছাপচিত্রে দেখতে পাচ্ছিলাম, নদীমাতৃক গাঙ্গেয় বদ্বীপে এসে সে স্থলে মানুষের জীবন, প্রকৃতি, নৌকা-মাছ-জল ইত্যাদির প্রকাশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা নিশ্চিতভাবেই শিল্পী সফিউদ্দীনকে গুরুত্বপূর্ণ একজন বাঙালি শিল্পীতে পরিণত করেছিল। নৌকা-মাছ-জাল-জল শিল্পী সফিউদ্দীনের কাছে শুধুই নকশা বোনার রূপসূত্র ছিল না, বরং এসব কিছু প্রতিবিম্বিত হয়েছিল সূক্ষ্ম আর গভীর কারুকার্যে। তার রেখাঙ্কনে নৌকার গলুই ত্রিভুজ আকার পেয়েছে, কখনো একটি জাল কয়েকটি চতুর্ভুজে পরিণত হয়েছে। তার আকারগুলো পুরোপুরি জ্যামিতিকও নয়। তার রেখা আকারগুলো জৈবতা সঞ্চার না করলেও এক ধরনের গতিময়তা তৈরি করে। জলের তরঙ্গ, জলের ঢেউ টেক্সচারে রূপান্তরিত হয়ে প্রায়ই প্রাণ স্পন্দনের অনুভূতি নির্মাণ করে। বাংলার প্রকৃতি আর জীবনকে সফিউদ্দীন আহমেদ যেভাবে অনুভব করেছিলেন, সেটাই শিল্পকে তারআধুনিক শিল্পভাষাউন্নীত প্রকাশ করার সাধনা।

জলের নিনাদ-২/ ছবি:  সফিউদ্দীনআহমেদডটকম


তিনি ড্রয়িং, তেলরঙ, উড এনগ্রেভিং, এচিং, অ্যাকুয়াটিন্ট, মেটাল এনগ্রেভিং ইত্যাদি মাধ্যমে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে এক সার্থক শিল্পীর জীবন অতিবাহিত করে গেছেন, নির্মাণ করে গেছেন সার্থক সব চিত্রকর্ম। ছাপচিত্রে তার নিরীক্ষাপ্রবণতার সবচেয়ে সার্থক প্রকাশ আমরা দেখতে পাই শিল্পকর্মজলের নিনাদ’-, (১৯৮৫) ছবিতে তিনি ছাপচিত্রের প্রায় সব মাধ্যমকে একত্রে ব্যবহার করেছেন। পরিকল্পনাটি তার এসেছিল অর্কেস্ট্রার ধারণা থেকে, যেভাবে অর্কেস্ট্রায় সব যন্ত্রকে একসঙ্গে বাজানো হয় সেখান থেকে। এক অপূর্ব সমন্বয় সাধনের যে অসাধারণ দক্ষতা অর্কেস্ট্রায় দেখা যায় সেটাকে তিনিজলের নিনাদেব্যবহার করতে চেয়েছেন। একটি ছবির ভেতরেই এচিং, অ্যাকুয়াটিন্ট, সুগার অ্যাকুয়াটিন্ট, মেজোটিন্ট, লিফটগ্রাউন্ড, এনগ্রেভিং, ডিপ এচ, ড্রাই পয়েন্টসহ প্রভৃতি মাধ্যমের সমন্বিত রূপ দৃষ্টিগোচর হয়।


শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ অনেক সময় একটি মাধ্যমের বৈশিষ্ট্যকে অন্য একটি মাধ্যমের চিত্রে সফলভাবে প্রয়োগ করেছেন। অনেক সময় দেখা গেছে, ছাপচিত্র তৈলচিত্রের বৈশিষ্ট্যগুলোকে তিনি রেখাচিত্রের মধ্য দিয়ে উপস্থাপন করেছেন। এচিংয়ের সূক্ষ্ম সরু রেখা, এনগ্রেভিংয়ের গতিশীল রেখা, ড্রাই পয়েন্টের মাধুর্যময় রেখা তার চিত্রে এক ধরনের আন্তঃযোগাযোগ তৈরি করে। তেমনই অ্যাকুয়াটিন্টের মিহি দানাদার বৈশিষ্ট্য, তেলচিত্রের নানা রকম বিন্যাস, রঙের প্রলেপ, মসৃণতা ইত্যাদি তার চিত্রপটকে আকর্ষণীয় করে তোলে। এনগ্রেভিংয়ের গুণাগুণ তৈলচিত্রে এবং তৈলচিত্রের টেক্সচার তিনি ছাপচিত্রে রেখাচিত্রে বিস্তৃত করেছেন।


শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদকে আমরা স্মরণ করতে পারি এক নিভৃতচারী শিল্পসাধক হিসেবে। শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে তার একাগ্রচিত্ততা, মাধ্যমগত জায়গায় তার নিবিড় পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বিষয়গত বৈচিত্র্যের দিকে তার স্বভাবজাত আকাঙ্ক্ষার এসব কিছুই তাকে আমাদের মাঝে আরো বহুদিন জীবন্ত রাখবে। বাংলাদেশে শিল্প বিস্তারের ভূমিকায় শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদের নাম অগ্রগণ্য সর্বাধিক উজ্জ্বল।

 

সিলভিয়া নাজনীন: শিল্পী গবেষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন