১৯তম দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী বাংলাদেশ ২০২২

মহাজাগতিক নৈঃশব্দ্যে আত্ম-আবিষ্কার

ওয়াহিদ সুজন

ছবি: মাসফিকুর সোহান

বাতাসে শীত জমে আসার আভাস আর কুয়াশার ঘ্রাণ। এমন এক সন্ধ্যায় প্রাঙ্গণজুড়ে গান-বাজনা, পিঠাপুলি আর হস্তশিল্পের আয়োজন। মাঠের মধ্যিখানে আস্ত পদ্মা সেতুর প্রতিকৃতি। সবকিছু ছাপিয়ে যে আয়োজন ঘিরে জাতীয় চিত্রশালা সরগরম১৯তম দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী বাংলাদেশ ২০২২। নির্ধারিত সময় থেকে পিছিয়ে বসেছে দেশের সবচেয়ে বড় শিল্প আয়োজনের ১৯তম আসর। কোনো ব্যতিক্রম ছাড়াই করোনার কারণে বিলম্ব। আর সেই আঁচ লেগেছে পুরো আয়োজনে। যেহেতু করোনা প্রসঙ্গ এসেছে সে উপলক্ষে বলে নেয়া যাক, সামগ্রিকভাবে প্রদর্শনীর সুনির্দিষ্ট কোনো থিম নেই। দেশী-বিদেশী, প্রতিযোগিতা বা আমন্ত্রিত বিভাগ মিলিয়ে বিভিন্ন বিভাগে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবারের প্রদর্শনী। কিছু অংশ নির্দিষ্ট কিউরেটরের অধীনে প্রদর্শিত হচ্ছে। তবে প্রদর্শনীতে হাজির হলেই একটা দমবন্ধ বিষয় টের পাওয়া যাবে। বিষয়টা সয়ে এলে নৈঃশব্দ্য নৈঃসঙ্গে মানুষের আপন জগতের হদিস পাওয়া যায়। খোঁজ মেলে এক মহাজাগতিক আত্মার।

দ্বিতীয় তলায় গ্যালারি - ঢুকতেই ধাক্কা দেয় আবদুস সাত্তার তৌফিকের কাজ দিস টাইম চারটি ভিন্ন ভিন্ন ক্যানভাসে মিলিয়ে করোনা পরিস্থিতি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। রোগের বিভীষিকার সঙ্গে আগে-পরের পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে যেমন, তেমনি যেন কোনো এক ট্র্যাজেডির খোপে ঢুকে পড়ি আমরা। সেই রেশ থেকে যায় গ্যালারি থেকে গ্যালারিতে। করোনার অভিঘাতে মানুষ বন্দি হয়েছে চার দেয়ালে। সে কতক নিজেকে চিনেছে বা কতক আন্তরিক অসহায়তা টের পেয়েছে। মোটের ওপর এক অস্তিত্ববাদী অনুসন্ধান ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, যেখানে মানুষ আছে। তার ভূগোল পরিপার্শ্ব, নানা ধরনের চরিত্র আছে। কিন্তু ঠিক মানুষ কোথায়, সে প্রশ্ন নানাভাবে উঠে এসেছে নানা ফর্মের শিল্পকর্মে। আধুনিক মানুষের মনে বিচার চলেছে যেন ক্যানভাসে ক্যানভাসে। এসব দেখাশোনার মাঝে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন দুই তরুণ-তরুণী। তারা জানালেন, এবারের প্রদর্শনীতে গাইড হিসেবে কাজ করছেন। দুজনই চারুকলায় পড়েন, বিষয় আর্ট হিস্ট্রি। তারা প্রশ্নের মুখে ফেললেন বারবার। দর্শকের চোখ পরখ করতে চাইলেন। কয়েকটি শিল্পকর্মের বিষয় ধরিয়ে দেয়ার আগে প্রশ্নের সুর, আমরা বলার আগে আপনার ভাবনাটা শুনি। অনুভব যখন কথায় ছড়ায় কথার পিঠে আসে আরো কথা। কোন গহিন থেকে, মানুষ হয়তো ঠিকঠাক জানে না। তবে কথা দিয়ে দুনিয়াকে দেখা ভাবার চেষ্টা নিরন্তর। সেই যাত্রায় বোঝাবুঝি মন্দ কী। দুই শিক্ষার্থীর মাধ্যমে কয়েকটি শিল্পকর্মকে সামনে রেখে খানিক বোঝা হলো শিল্পের উদ্দেশ্য-বিধেয় টেকনিক। কথায় কথায় বোঝা গেল, শিল্পী আর ভোক্তার দেখার দৃষ্টিভঙ্গি কত আলাদা।

প্রদর্শনীতে প্রথম পুরস্কার পেয়েছে চারুকলার শিক্ষক সুশান্ত কুমার অধিকারীর আত্ম-উপলব্ধির ভেতর বাহির কাগজের ওপর টেম্পারা কাচের মিশ্র মাধ্যমের কাজে ২১টি চিত্রকর্মের পাশাপাশি দুটো আয়না স্থাপন করা হয়েছে। শিল্পীর আত্মপ্রতিকৃতির পাশাপাশি নিজের চেহারাটা এক পলকে দেখে নেন দর্শক। শিল্পী নিজেকে নানা মেজাজে তুলে ধরেছেন। সবকিছুতে ঘরবন্দি মানুষের গল্প, যেখানে তিনি ভাবছেন, নিজেকে মুক্ত করতে চাইছেন বা নির্ভরতার সন্ধান করছেন। এমনকি নিজের ভাস্কর্যের মাঝেও প্রাণের দেখা পেতে চাইছেন।

একই ফ্লোরে রয়েছে কয়েকটি ইনস্টলেশন। প্রাচীন মাদার আর্থ থেকে শুরু করে শহরের উঁচুতলার ভবন নির্মাণে প্রকৃতির বিনাশ কোয়ারেন্টিনকে বাবুই পাখির বাসার সঙ্গে তুলনা করা শিল্পকর্ম। আবার মানুষের দৈনন্দিনতাকে এক ইটারনাল জার্নি হিসেবে দেখার প্রবণতা আছে। আছে প্রাচীন মিসরীয় হায়ারোগ্লিফিকসের আদলে বাংলার পটচিত্র পুরাণকে তুলে ধরার চেষ্টা। এভাবে ঘুরে দেখতে দেখতে বাংলার হাল আমলের শিল্পচর্চার মাঝে চমত্কার এক ভ্রমণ হয়ে যাবে, যেখানে শিল্পী শুধু নিজেকে আবিষ্কার করছেন না, আত্মবিধ্বংসী প্রবণতাও উঠে আসে।

ইয়াসমিন জাহান নূপুরের ইনস্টলেশন দ্য টাইম কুডন কেপ্ট অ্যাট বে পেয়েছে গ্র্যান্ড প্রাইজ। এটি দেখতে পেরিয়ে আসতে হবে বেশ কয়েকটি গ্যালারি। দৃশ্যত বিহ্বল করে তোলা আয়োজনে সাদা স্বচ্ছ কাপড়ে অনুভূতিজ্ঞাপক নানা শব্দ, সাদা-কালো ছবিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ বিষয়াদি। আপাতত সরল-সিধে ভাবনার ভেতর এক ধূসর জগৎ। সেখানে আশা আর নিরাশার নিরন্তর আসা-যাওয়া। একটু নীরবতা সঙ্গে নিয়ে স্বচ্ছ অবগুণ্ঠনের ভেতর খানিক চলাচল নিমগ্ন করবে, ভাবাবে।

ইনস্টলেশনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো পর্তুগালের শিল্পী এনা সিলভিয়া মালহাডোর সম্মানসূচক পুরস্কারপ্রাপ্ত ওড টু লাইফ টি-ব্যাগের পাতলা কাগজে ফুল, পাখি, গাছপালা এঁকে সারিবদ্ধভাবে ঝুলিয়ে দিয়েছেন সুতোয়। সব ছবিই উজ্জ্বল, স্বচ্ছ দৃষ্টিনন্দন, যেখানে কোনো মানুষ নেই; কিন্তু মানুষের দেখার চোখটা রয়েছে ভীষণভাবে। গ্র্যান্ড প্রাইজ পাওয়া নেদারল্যান্ডসের চিত্রশিল্পী হ্যারল্ড স্কোলের আন্ডারলাইন আবার সেই চোখের ভাষা পড়তে চায়। চোখ যে মনের আয়না, তা বোধহয় বাক্যের অনুবাদের অন্তরালে গিয়েও ভীষণ সত্য। দৃশ্য থেকে দৃশ্যে মনোজাগতিক নানা মুহূর্ত তুলে ধরেছেন। ফটো, ড্রইং, সি-প্রিন্টের মাধ্যমে সাজানো সাদা-কালো আটটি ছবিতে চোখ সমান্তরালের দৃশ্যের বুনট। পরিসরে একটু তথ্য দেয়া যাক। এবারের দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীর ১৩টি গ্যালারিতে রয়েছে ১১৪ দেশের ৪৯৩ জন শিল্পীর ৬৪৯টি চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য, স্থাপনা শিল্প, নিউমিডিয়াসহ নানা মাধ্যমের শিল্পকর্ম। এর মধ্যে ১৫৬টি শিল্পকর্ম বাংলাদেশের ১৪৯ জন শিল্পীর।

পুরো আয়োজনে নানা ধরনের বিভাগ থাকলেও বিষয়গতভাবে করোনার পাশাপাশি মানুষ আত্ম-আবিষ্কারের পাশাপাশি প্রকৃতির প্রতি দায়বদ্ধতা, সেভাবে বৃহত্তর এক জগেক খোঁজার চেষ্টা উঠে এসেছে। আবার ফর্মের দিক থেকে দেশী শিল্পীদের বেশির ভাগ কাজই নিরীক্ষাপ্রবণ। মাধ্যমের ক্ষেত্রে অ্যাক্রেলিক বা অয়েল পেইন্টিংয়ের চেয়ে মিশ্র মাধ্যমে মুখর তারা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মনে হতে পারে আত্মনিরীক্ষণের ধূসর ডামাডোলের মাঝে হয়তো আমরা পারিপার্শ্বিক অনেক প্রশ্ন থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। ব্যক্তি যে সমষ্টির অংশ, তাকেও আমরা ভুলতে বসেছি। নতুন সম্ভাবনা বা বাস্তব পরিস্থিতিকে ছেঁকে দেখার চেষ্টা নেই, সেখানে পরস্পরকে কাছাকাছি আবিষ্কার করি আমরা। এটায় সময়কে ঠিকঠাক করে ধরে দেখা। আবার বিদেশী চিত্রগুলোয় রঙের ব্যবহার অনেক উজ্জ্বল গতিশীলতায় ভরপুর।

শত শত ছবির আয়োজনে একবারে দেখার চেষ্টা একটু কঠিনই বটে। তা সত্ত্বেও সংস্কৃতি, আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, ভূ-প্রকৃতি মনস্তাত্ত্বিক ভেদাভেদ ছাড়িয়ে বরাবরই মানুষের কাছে মানুষকে আসতে বলে, যেখানে মানুষের অন্তর্গত নৈঃশব্দ্য সময়ের বেদনা, উদযাপন ছড়িয়ে পড়ে সম্মিলিত কণ্ঠে। আত্ম-অবিষ্কার, আত্মার আবিষ্কার আত্মোপলব্ধির পথে এসে মানুষ দেখে শিল্পের জয়গান। দর্শকেরও আত্ম-আবিষ্কারের সফর হয়ে ওঠে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন