লোকপরম্পরায় দেশ ও সমাজ

জয়নুল-কামরুল

সিলভিয়া নাজনীন

পাইন্যার মা, জয়নুল আবেদিন, উঁকি, কামরুল হাসান, বাঙালি নারী, জয়নুল আবেদিন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পৃথিবীতে যে পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল তার ধারাবাহিক প্রভাব আমরা বৈশ্বিক শিল্পকলায় দেখতে পাই। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা শিল্পী, বুদ্ধিজীবী সমাজসচেতন মানুষের মধ্যে নানাবিধ মানসিক মানবিক তাড়না তৈরি করে। চিত্রশিল্পীদের প্রকাশভঙ্গি স্বাধীন, বাধাহীন, অবারিত। বাস্তবিক পরিস্থিতি যেমন করে উপস্থিত হয়, সেই প্রকাশগুলো দেখা যায় শিল্পীর ক্যানভাসে। শিল্পীদের আমরা দেখি যেকোনো দুঃসময়ে সাধারণ মানুষের কাতারে এসে প্রতিবাদী কণ্ঠ হয়ে উঠতে। বাঙালির প্রতিটি সংকটে শিল্পীদের সংশ্লিষ্টতা আমাদের আশাবাদী করে তোলে, নতুন দিনের সম্ভাবনাকে উন্মোচন করে। একজন শিল্পীর মধ্যে তার সময়ের আর্থসামাজিক অবস্থা, রাজনৈতিক মতাদর্শ ব্যক্তিস্বাধীনতার যে গুরুত্ব তা নানা ভঙ্গির মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। এসব বিবেচনায় আমরা বাংলাদেশের দুজন শিল্পীকে দেখতে পাই যারা দেশচিন্তা, লোকচিন্তা, সামাজিক মানবিক দিকগুলো নিয়ে বিশেষভাবে সরব থেকেছেন এবং শিল্পকর্ম নির্মাণ করেছেন।

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন (১৯১৪-৭৬)

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ১৯৩৩ সালে কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে ভর্তি হন। সময়ে তিনি নানাবিধ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিয়মিত অংশ নিতে শুরু করেন। বলা যায়, তার মধ্যে ব্যাপকভাবে সমাজ রাষ্ট্রের কাঠামোগত উন্নতি, ব্যক্তির অধিকার, সাম্যচিন্তা ইত্যাদি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ তাড়না নিয়ে হাজির হয়। এক্ষেত্রে আমরা উল্লেখ করতে পারি জয়নুল আবেদিনের দুর্ভিক্ষের চিত্রমালার কথা। তিনি কলকাতার পথে পথে মানবতার যে অবক্ষয় প্রত্যক্ষ করেছেন তা তিনি তার চিত্রপটে তাত্ক্ষণিকভাবে তুলে ধরেছিলেন। মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ, তার প্রতিদান দিয়েছে লাখ লাখ মানুষ জীবন দিয়ে। ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা সব মানব-ইতিহাসেই বিরল। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সময়ে বেশকিছু ড্রইং করেছিলেন। ব্রাশ স্ট্রোক আর কালি দিয়ে যে কর্কশ ছবি তিনি এঁকেছেন তা বাঙালি জাতির ইতিহাসের কলঙ্কিত দলিল চিহ্ন হিসেবে স্মরণীয়।

শিল্পীমাত্রই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, রাজনৈতিক অবিচার তথা সামাজিক নৈরাজ্যকে সমালোচনা করেন। আবার ক্যানভাসে তার দেশমাতৃকা, তার ইতিহাস, সংস্কৃতি, চেতনা, অভিজ্ঞতা প্রভৃতি উপস্থাপন করেন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন তার দীর্ঘ শিল্পীজীবন কাটিয়েছেন নানাবিধ পরিকল্পনা আর সেসব বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে। তিনি কলকাতার শিল্পপাঠ শেষ করে, সেখানকার শিক্ষকতা জীবনকে ছেড়ে তত্কালীন পূর্ব বাংলা অর্থাৎ বাংলাদেশে এসেছেন একটি নতুন শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করতে এবং অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে ১৯৪৮ সালে একটি শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত করেছেন, যা বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ হিসেবে পরিচিত।

প্রতিষ্ঠান নির্মাণ আর পাশাপাশি নিজস্ব শিল্পচর্চাদুই বিষয় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে করে গিয়েছেন। তিনি আমাদের শিল্পের পরিমণ্ডল তৈরি করেছেন। তার শিল্পীজীবনে বেশ কয়েকটি পর্যায় আমরা দেখতে পাই। এখানে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য হলো, ইউরোপের একাডেমিক শিল্পশিক্ষা শিল্পচিন্তার সঙ্গে আমাদের এখানকার বৈশিষ্ট্য, লোক-ঐতিহ্য লোকশিল্পের মেলবন্ধন ঘটিয়ে তিনি অঞ্চলের শিল্পচর্চার আধুনিকায়ন ঘটিয়েছেন। ১৯৫১ সালে কমনওয়েলথ বৃত্তির অধীনে জয়নুল যখন লন্ডনের স্লেড স্কুলে শিক্ষাগ্রহণ করেছেন, আবার সে সময়ে ইউরোপের বিভিন্ন জাদুঘর, শিল্প প্রদর্শনীতে গিয়েছেন। নানা শিল্পী, শিল্প সমালোচক, লেখক, কলাতাত্ত্বিক প্রমুখের সঙ্গে তার শিল্প নিয়ে আলাপ-আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বাংলাদেশের শিল্পচর্চা নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে শুরু করেন। সময় তিনি প্রাচ্য পাশ্চাত্যরীতির সম্মিলন ঘটিয়েছেন তার নিজস্ব শিল্পকর্মে। তার সময়ের চিন্তায় তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তিত রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। কারণ সে সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতি বাংলায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। স্বভাবতই তখন বাঙালির ঐতিহ্য, বাঙালিত্বের পরিচয় প্রধান প্রশ্ন হয়ে উঠেছিল। শিল্পী সেই বাঙালি ঐতিহ্যকে আধুনিক শিল্পচর্চায় উত্তরণ ঘটিয়েছেন।

শিল্পাচার্য লোকশিল্পের উপাদান সংগ্রহ করে তার ছবি নির্মাণ করেছেন। লোকশিল্পের উজ্জ্বল রঙ, রেখা সে সময়ে বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। মৌলিক রঙকে সমতলভাবে ব্যবহার, আলংকারিক রেখা, অবয়বের সরলীকরণ, নারীদেহের সহজাত ভঙ্গি, মাধুর্য, খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি শিল্পাচার্যের সময়ের ছবিতে বিশেষভাবে দেখা গিয়েছে। পর্যায়ের কাজের বিষয় নির্বাচনে নারী মুখ্য ছিল, জয়নুলের নারী কমনীয় বা উর্বরা শক্তির প্রতীক হিসেবে উপস্থিত হয়নি। তার নারী পরিশ্রমী, উদ্যমী, একহারা গড়ন, লম্বা গ্রীবার অধিকারী। তার ছবিগুলোয় জ্যামিতিক কাঠামোর বিভাজন, গড়নের সুষম অনুপাত, রঙের সুষম বিন্যাস দেখা যায়। অঞ্চলে তিনিই প্রথম শিল্পী যিনি পাশ্চাত্যের একাডেমিক রীতির আদর্শিক ভঙ্গির সঙ্গে স্থানীয় লোক-ঐতিহ্যের সঠিক সন্নিবেশ ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন।

শিল্পী কামরুল হাসান (১৯২১-৮৮)

শিল্পী কামরুল হাসান গুরুসদয় দত্ত প্রতিষ্ঠিত ব্রতচারী আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন ১৯৩৯ সালে। গুরুসদয় দত্ত আর ব্রতচারী আন্দোলনদুই বিষয়কে লক্ষ করলে দেখা যায় এর অন্তর্নিহিত দেশাত্মবোধ শিল্পীর ওপর তার প্রভাব। দেশ, দেশের মানুষ, দেশজ সংস্কৃতি, দেশাত্মবোধ প্রভৃতিকে সংশ্লেষণ করে একজন শিল্পী তার শিল্পচর্চায় কীভাবে উপস্থাপন করেন তা সম্বন্ধে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। আবার শুধু চিত্রকর্মই নয়, এখানে একজন সমাজসচেতন শিল্পী হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায়ও ব্রতচারী আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে মূর্ত হয়ে ওঠে। ব্রতচারী আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ রায়বেঁশে নৃত্য। ব্রিটিশ শাসনামলে রাজার সেনাবাহিনী রায়বেঁশে পদ্ধতিতে শরীরচর্চা করত বাঙালি সংস্কৃতি, শুদ্ধ জাতীয়তাবাদ এবং প্রত্যেকে বাঙালির জীবনগঠনে স্বকীয়তা রক্ষা করতে, মূলনীতি কামরুল হাসান তার পরবর্তী জীবনে প্রতিফলিত করেন।

কামরুল হাসান বলেছিলেন, ব্রতচারী কেবল নৃত্য নয়, বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে সত্যিকারের বাঙালি হিসেবে গড়ে তোলার জন্য যারা ব্রত গ্রহণ করেন এবং বাস্তব জীবনে প্রতিফলনের অনুশীলন করেন তারাই ব্রতচারী। ব্রতচারী পরিপূর্ণ বাঙালি গড়ার আন্দোলন। আন্দোলনের আবির্ভাব ঘটে প্রায় ৪০ বছর আগে। বাংলার মাটি, বাংলার জীবন, বাংলার সংস্কৃতি তথা বাংলার গৌরবময় অতীতকে স্মরণ করে ততোধিক ভবিষ্যতের দিকে যাতে বাংলার মানুষ এগিয়ে যেতে পারে তারই সাধনাক্ষেত্র ব্রতচারী। চিন্তার ধারাবাহিকতা তার জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত প্রতিফলিত হয়েছে। আমরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে শিল্পী কামরুল হাসানের অঙ্কিত এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে শীর্ষক ইয়াহিয়া খানের মুখচ্ছবিসংবলিত জনপ্রিয় পোস্টারের কথা স্মরণ করতে পারি। শিল্পী বাঙালি জাতির সংকটকালে সাধারণ মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে সমস্ত বিশ্বের সামনে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার ইতিহাস উন্মোচন করেন একটি মাত্র পোস্টারের মাধ্যমে।

কামরুল হাসানের শিল্পকর্মে লোকশিল্পের বৈশিষ্ট্য প্রভাব ব্যাপকভাবে দেখা যায়। তার ড্রইং, রঙ, রেখা, নির্মাণ-কৌশল ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রে তা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। তিনি পটুয়াদের মৌলিক রঙ ব্যবহারের পদ্ধতি, দ্বিমাত্রিক চিত্রবৈশিষ্ট্য প্রভৃতি সম্পর্কে ব্রতচারী আন্দোলনের সময়ে ধারণা লাভ করেছেন। তিনি বাঙালির গৌরবের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে নিজেকে পটুয়া হিসেবে পরিচয় দিতে ভালোবাসতেন। তিনি শিল্পাচার্যের লোকশিল্পের প্রতি ভালোবাসা থেকে প্রেরণা গ্রহণ করেন এবং আদর্শের অভিন্ন যাত্রী ছিলেন।

পঞ্চাশের দশকে তিনি তার চিত্রচর্চার ধারায় পরিবর্তন আনেন। লোকশিল্পের বিভিন্ন মোটিফ ভাষা তার চিত্রপট দখল করে নেয়। একই সঙ্গে লোকশিল্পের দ্বিমাত্রিকতার বৈশিষ্ট্য গ্রহণ করে সেটার মধ্যে ত্রিমাত্রিকতা নির্মাণের প্রচেষ্টা ছিল তার। তিনি রঙের মাধ্যমে প্রেক্ষিত সৃষ্টি করেছেন, যা দ্বারা ছবির মধ্যে দূরত্ব, দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ইত্যাদি বিষয় বোধগম্য হয়। তিনি পট-চিত্রকরদের মতো পার্শ্ব-অবয়ব অঙ্কনের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। তিনি পশ্চিমের বিভিন্ন রীতিকে নিরীক্ষার মাধ্যমে ব্যবহার করেছেন। এক্ষেত্রে পূর্ণ অবয়বের পরিবর্তে কেটে কেটে অবয়ব নির্মাণ করেছেন। পার্শ্ব সম্মুখ অবয়বের সমন্বয় করেছেন একটি ছবিতেই, এসবই তার সফল নিরীক্ষার অংশ ছিল। তিনি লোকজ ধারাকে পাশ্চাত্যের ধারার সঙ্গে সংশ্লেষ ঘটিয়ে অঞ্চলে চিত্রকলায় নতুন রূপ দিতে সক্ষম হয়েছেন।

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন পটুয়া কামরুল হাসানদুজন বাংলাদেশের শিল্পচর্চায় গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। নাগরিক জীবনযাত্রায় লোকশিল্প, লোক-ঐতিহ্য বা লোকসংস্কৃতিকে বিলীন হয়ে যেতে দেননি। সমকালীন জীবনকে তারা সমৃদ্ধ করেছেন ঐতিহ্যবাহী শিল্প-বৈশিষ্ট্য দ্বারা। তাদের সাধারণ জনজীবন, স্বদেশ চিন্তা, শিল্পবোধ তাদের সৃষ্টিকে মহত্ত্বের ব্যঞ্জনায় প্রস্ফুটিত করেছে।

 

লেখক: শিল্পী গবেষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন