কলকাতার বিড়লা একাডেমিতে প্রদর্শনী

’৭১-এর চিত্রকর্ম

বীরেন সোম ছবি: সালাউদ্দিন পলাশ

১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর। কলকাতার বিড়লা একাডেমিতে শুরু হয় এক্সিবিশন অব পেইন্টিংস অ্যান্ড ড্রয়িংস বাই আর্টিস্টস অব বাংলাদেশ শিরোনামের প্রদর্শনী। অভিপ্রায় তহবিল সংগ্রহের সঙ্গে আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে তুলে ধরা। অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন বীরেন সোম, যিনি ছাত্র আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে শিল্পীসমাজ নামে একটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেন। সাক্ষাত্কার রুহিনা ফেরদৌস

কলকাতায় আপনারা শিল্পীরা কীভাবে একত্রিত হয়েছিলেন?

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের ডিজাইনার হিসেবে কাজ করি আমি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে দলে দলে নারী-পুরুষ ভারতে আশ্রয় নেয়। আমরা শিল্পীরাও সে দলে শামিল হই। সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নিই। কিছুদিনের মধ্যেই শিল্পীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর নৃশংসতার জবাবে আমরা প্রত্যেক শিল্পীই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ  করতে ভীষণ তাড়না বোধ করছি। সময় কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয় যে বাংলাদেশ থেকে আসা শিল্পীরা যেন কলকাতা আর্ট কলেজের অধ্যক্ষ চিন্তামণি করের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ওখানে গিয়ে দেখলাম শিল্পী কামরুল হাসান, মুস্তাফা মনোয়ার, নিতুন কুন্ডু, দেবদাস চক্রবর্তী, নাসির বিশ্বাস, প্রাণেশ মণ্ডল, রণজিত নিয়োগী, কাজী গিয়াসউদ্দিন, চন্দ্রশেখর দে, হাসি চক্রবর্তীসহ আরো অনেক শিল্পী এসেছেন।

প্রদর্শনী ঘিরে শিল্পীদের মধ্য থেকে কে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং আয়োজনের শুরুটা কীভাবে হয়?

বাংলাদেশে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বর্বর অত্যাচার গণহত্যার চিত্র বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে চিন্তামণি কর কামরুল হাসানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের শিল্পীদের আঁকা ছবি নিয়ে প্রদর্শনী আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয়। এরপর উদ্যোক্তা হিসেবে এগিয়ে আসে বিভিন্ন শিল্পী সংস্থা কলকাতার বাংলাদেশ সহায়ক শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সমিতি। প্রদর্শনী শুরু হয় ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর। কিন্তু আমরা কাজ শুরু করি তারও প্রায় দুই মাস আগে। প্রদর্শনীর ক্যাটালগে ১৭ জন শিল্পীর ৬৭টি শিল্পকর্মের কথা উল্লেখ ছিল। কিন্তু প্রদর্শিত হয় ১৬ জনের ৬৬টি চিত্রকর্ম। ক্যাটালগে শিল্পী আবুল বারক আলভীর নাম থাকলেও শেষ পর্যন্ত তিনি অংশ নিতে পারেননি। কেননা প্রদর্শনীর আগে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে তিনি ধরা পড়েন এবং ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হন। তবে লোক মারফত তিনি তার আঁকা ছবি পাঠিয়েছিলেন কলকাতা আর্ট কলেজের অধ্যক্ষ চিন্তামণি করের কাছে, কিন্তু তা প্রদর্শনীতে ছিল না।

তখন সবাই মিলে কোথায় মিলিত হতেন এবং ছবি আঁকার কাজ করতেন?

কলকাতা আর্ট কলেজের ক্যান্টিনে আমাদের ছবি আঁকা থাকার ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া সাময়িকভাবে বিভিন্নজনের বাসায় শিল্পীদের আশ্রয় দেয়া হয়েছিল। আর্ট কলেজ ছুটির পর আমরা ওদের ক্যান্টিন ব্যবহার করতাম। রঙ-তুলি-কাগজ-ক্যানভাসসহ ছবি আঁকার জন্য সব উপকরণ সরবরাহ করা হয় আমাদের। আর্থিকভাবে সহায়তা দেয় বিড়লা একাডেমি অব আর্ট অ্যান্ড কালচার। পৃষ্ঠপোষকতায় ছিল মেসার্স জিমি লাহা প্রাইভেট লিমিটেড, আদভানি প্রাইভেট লিমিটেড, ক্যামলিন প্রাইভেট লিমিটেড, কোরেস প্রাইভেট লিমিটেড প্যাপিরাস প্রাইভেট লিমিটেড।

পর্যায়ে চিত্রকর্মের বিষয়বস্তু প্রদর্শনী উদ্বোধন সম্পর্কে জানতে চাই।

বিড়লা একাডেমিতে ভারতের খ্যাতনামা ভাস্কর শ্রী দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন। থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর সোমবার ছাড়া প্রতিদিন বেলা ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত প্রদর্শনী উন্মুক্ত থাকত। চিত্রকর্মগুলো তেলরঙ, জলরঙ, কালি-কলম মিশ্র মাধ্যমে আঁকা হয়। যেহেতু আমরা শিল্পীরা সবাই মুক্তিযুদ্ধ পরিস্থিতিকে তুলে ধরতে চেয়েছিলাম, তাই চিত্রকর্মের বিষয়বস্তু হিসেবে ঘুরেফিরে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা, নিপীড়ন, নারী নির্যাতন আর ধ্বংসযজ্ঞের স্বাক্ষর তুলে ধরা হয়। আমরা প্রতিবাদী, বিমূর্ত, সমবিমূর্ত, রিয়েলিস্টিক ধাঁচে ছবিগুলো এঁকেছিলাম।

প্রদর্শনীতে কার কার চিত্রকর্ম ছিল? কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্ম নিয়ে বলবেন কি?

শুরুতে শিল্পী কামরুল হাসানের কাজ নিয়ে বলি। তার পাঁচটি কাজ ছিল কম্পোজিশন-, কম্পোজিশন-, বাংলাদেশ-গণহত্যার আগে, বাংলাদেশ-গণহত্যার পরে এবং এপ্রিলের পূর্ণ চাঁদ শিরোনামে। এর মধ্য দিয়ে তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র ফুটিয়ে তোলেন। তিনি তার নিজস্ব শৈলীর ড্রয়িং আর ফর্মের ব্যবহারে হালকা রঙ দিয়ে দ্বিমাত্রিকভাবে ছবি এঁকেছিলেন। মুস্তাফা মনোয়ার মূর্ত ঘরানার শক্তিশালী শিল্পী। তার আটটি কাজ ছিল। তার উইম্যান অ্যান্ড বিস্ট   বাংলাদেশ (, )-এর কথা উল্লেখ্য। জলরঙ, তেলরঙ কালি-কলমে এঁকেছিলেন চিত্রকর্মগুলো। প্রদর্শনীতে দেবদাস চক্রবর্তীর কাজ ছিল দুটি। তার আঁকা হিউম্যানিটি ক্রুসিফায়েড ছবিটি দেখলে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মমতা আঁচ করা যায়। প্রাণেশ মণ্ডলের চারটি ছবিতে গণহত্যা নির্যাতনের চিত্র ফুটে ওঠে। তিনি সরাসরি বলিষ্ঠ রঙ রেখার মাধ্যমে গণহত্যার বর্বরতাকে প্রকাশ করেছেন। স্বপন চৌধুরী সবচেয়ে বেশি কাজ দিয়েছিলেন প্রদর্শনীতে। বাংলাদেশ শিরোনামে তিনটি এবং স্কেচ শিরোনামে ১০টি। স্বপন চৌধুরীর কাজগুলো ছিল বিমূর্ত ধারায় আঁকা, বিশেষ করে তার প্রতীকী উপস্থাপনার কাজগুলো দর্শকসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এছাড়া অঞ্জন বণিক, কাজী গিয়াস উদ্দিন, গোলাম মোহাম্মদ, চন্দ্রশেখর দে, নাসির বিশ্বাস, নিতুন কুন্ডু, বরুণ মজুমদার, বিজয় সেন, হাসি চক্রবর্তী, রঞ্জিত নিয়োগী আমার কাজ ছিল। প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের মধ্যে প্রাজ্ঞ প্রতিভাবান শিল্পী যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন উদীয়মান নবীন শিল্পীরা। জয়নুল আবেদিন তখন কলকাতায় আসতে পারেননি। বুদ্ধিজীবীদের তালিকায় তার নাম ছিল। পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে তিনি তখন ঢাকার কেরানীগঞ্জ, ডেমরাএসব জায়গায় কখনো তার শুভাকাঙ্ক্ষি ছাত্র কখনো তার আত্মীয়দের বাড়িতে গোপনে অবস্থান করেন। শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ তখন আগরতলায় অবস্থান করছিলেন মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠিত শিল্পীর কাজ এখানে ছিল না, কারণ অনেকেই তখন বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছিলেন।

প্রদর্শনীতে আপনার কয়টি চিত্রকর্ম ছিল?

আমার চারটি ছবি ছিলকান্না, দুঃস্বপ্ন, স্কেচ-, স্কেচ-২। ছবিগুলো এঁকেছিলাম তেলরঙ কালি-কলমে। এর মধ্যে কান্না দুঃস্বপ্ন ছবি দুটিতে কোথাও ড্রয়িং, কোথাও একটু ফর্ম, আবার কোথাও ভাঙা ফর্মের মূর্ত ব্যবহার করেছিলাম। বিশেষ করে দুঃস্বপ্ন ছবিতে একটি ঘোড়ার মুখ ওপরের দিকে ওঠানো, যেন সে চিত্কার করে গণহত্যার প্রতিবাদ জানাচ্ছে। বিশ্ববাসীকে বলছে, গণহত্যা বন্ধ করো। আর কান্না ছবিটিতে আমি নিপীড়িত মানবতার তীব্র ক্রন্দন প্রতিধ্বনিত করে তুলতে চেয়েছি।

প্রদর্শনীর মাধ্যমে কেমন সাড়া পড়ে?

প্রথমে কলকাতায়, পরে দিল্লি মুম্বাইয়ে একই ছবির প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। মনে আছে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ প্রদর্শনী দেখতে আসত। সব দিক থেকে দেখলে আয়োজনটি সার্বিক অর্থেই সফল হয়েছিল। আমাদের আঁকা চিত্রকর্ম দেখে দর্শকরা আবেগতাড়িত হয়েছে। কারণ একদিকে যুদ্ধের ভয়াবহতা, অন্যদিকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েই আমরা শিল্পীরা ছবিগুলো এঁকেছি, যেখানে বাংলাদেশের অগ্নিগর্ভ সময়ের অভিজ্ঞতা চিন্তাধারার আশ্চর্য প্রতিফলনের যুগলবন্দি ঘটেছিল।

পরবর্তী সময়ে আপনি বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে শিল্পীসমাজ নামে একটি বই লেখেন। কী আছে সেখানে?

বইটির প্রথম সংস্করণ ২০১৫ দ্বিতীয় সংস্করণ ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয়। এতে বাংলাদেশের শিল্পীদের আঁকা ওই প্রদর্শনীর ১৬টি ছবি আছে। মুহূর্তে বইটির তৃতীয় সংস্করণের কাজ চলছে। একুশের বইমেলায় আসবে। আগেই উল্লেখ করেছিলাম যে শিল্পী আবুল বারক আলভীর নাম থাকলেও শেষ পর্যন্ত তিনি অংশ নিতে পারেননি। লোক মারফত তিনি তার আঁকা ছবি পাঠিয়েছিলেন কলকাতা আর্ট কলেজের অধ্যক্ষ চিন্তামণি করের কাছে, কিন্তু তা প্রদর্শনীতে ছিল না। আবুল বারক আলভীর চিত্রকর্মটি খুঁজে পেয়েছি আমরা। তার চিত্রকর্মটিসহ তৃতীয় সংস্করণে প্রদর্শনীতে থাকা নতুন ১৫টি চিত্রকর্ম যুক্ত করেছি। মূল চিত্রকর্ম সব এখন পাওয়া যায় না। তবে কিছু চিত্রকর্মের প্রিন্ট কপি জাতীয় জাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আছে। একাত্তরে বাংলাদেশের শিল্পীদের চিত্র প্রদর্শনীর পাশাপাশি বইটিতে ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা, একাত্তরে পথেপ্রান্তরে, মুক্তিযুদ্ধে শিল্পীসমাজ, এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে শোণিতরেখায় অরুণোদয় নামের পরিচ্ছেদ রয়েছে। শেষ পরিচ্ছদটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের বাংলাদেশের শিল্পীসমাজের অংশগ্রহণ নিয়ে। এখানে মুক্তিযুদ্ধের ওপর ৫০ জন শিল্পীর আঁকা চিত্রকর্ম রয়েছে। শুরুটা করা হয়েছে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ছবি দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধে চারুশিল্পীদের অবদান অপরিসীম। আমরা পোস্টার, ব্যানার, মঞ্চসজ্জা, পেছনের দৃশ্যপট আঁকার কাজসহ বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছি। ধরনের পোস্টার, ব্যানারসহ কিছু কাজ রয়েছে বইটিতে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন