লড়াইটা ক্যানভাসে রঙ-তুলিতে

ওয়াহিদ সুজন

স্বাধীনতার সব ময়দানে রক্ত ফুল হয়ে ফোটে না, ফোটে মানুষের হূদয়ে। যূথবদ্ধ হয় হূদয়ছেঁড়া আর্তনাদ আশাবাদ। সে লড়াইয়ে জায়গা করে নেন শিল্পী-লেখকরা। ভাবগত নানান অমিল সত্ত্বেও মুক্তির আকাঙ্ক্ষা তাদের একই ভাষার কাছাকাছি নিয়ে যায়। আমরা গানে, কবিতায়, আলোকচিত্রের মাধ্যমে তুলে আনতে পারি যুদ্ধদিনের নৃশংসতা-নির্মমতা। তবে পেনসিল, তুলি, রঙ বা ক্যানভাসের পরিসর আরো বিস্তৃত। যেমন চিত্রকলাই এখন পর্যন্ত মানুষের সর্বপ্রাচীন মননশীল নিদর্শন। যুদ্ধ-আন্দোলন-সংগ্রাম আশ্রিত চিত্রকলা মূর্ত-বিমূর্ত ফর্মে অদেখার রূপান্তর ঘটায়। ফর্মের ভাঙাগড়ার ভেতরই ইতিহাসের ওঠানামা।

স্বাধীন বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে কলকাতার বিড়লা একাডেমিতে পূর্ববঙ্গের শিল্পীদের অংশগ্রহণে আয়োজিত প্রদর্শনীর কথা আমরা সহজে মনে করতে পারি। প্রদর্শনীতে অংশ নেয়া ১৬ শিল্পীর ৬৬টি চিত্রকর্ম শুধু যুদ্ধের নির্মমতার কথা বলে না। বরং ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে উঠে আসে একটি জনপদের গল্প। যাদের নিজস্ব শিল্পদৃষ্টি আছে, বলার মতো অনেক গল্প আছে। যদি না- থাকে, তবে আমাদের লড়াইটা আসলে কিসের!

এক্সিবিশন অব পেইন্টিংস অ্যান্ড ড্রয়িংস বাই আর্টিস্টস অব বাংলাদেশ শীর্ষক ওই প্রদর্শনীতে অংশ নেন কামরুল হাসান, মুস্তাফা মনোয়ার, দেবদাস চক্রবর্তী, নিতুন কুন্ডু, প্রাণেশ মণ্ডল, বীরেন সোমের মতো শিল্পীরা। জলরঙ, তেলরঙ, কলম, কালি, পেনসিল বা মিশ্র মাধ্যমে তারা অ্যাবস্ট্রাক্ট, সেমি-অ্যাবস্ট্রাক্ট রিয়েলিস্টিক ধারার ছবি এঁকে বিশ্ববিবেকের সামনে দাঁড়ান।

প্রদর্শনীটি মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধিকার-স্বাধীনতা আশ্রিত চিত্রকলার অনন্য একটি অংশ। ওই সময় অনেক অগ্রগণ্য শিল্পী স্থানিক বিচ্ছিন্নতার কারণে অংশ নিতে পারেননি। কিন্তু বৃহত্তর অর্থে মুক্তিযুদ্ধের নৃশংসতা বা গৌরবের দুই দিক ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে এক হয়েছেন। প্রত্যেকে স্বতন্ত্র হলেও তাদের চিত্র-আশ্রয় মূলত এই মাটি মানুষ; তা আরো স্পষ্ট করেছে স্বাধীনতার লড়াই।

পূর্ববঙ্গের চিত্রকলা প্রসঙ্গে প্রথমে নাম আসবে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের। ব্রিটিশ ভারতে দুর্ভিক্ষের ছবি এঁকে ততদিনে তিনি বিখ্যাত। লোকজ ধারাকে ধারণ করা জয়নুল আবেদিনের চিত্রকল্প এই ভূভাগের শৈল্পিক প্রকাশ। যার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে স্বাধীনতার যুদ্ধে। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সব আন্দোলনে তার নেতৃত্বে তরুণ শিল্পীরা পোস্টার, ব্যানার, ভাস্কর্য তৈরি করেছেন। জনগণের দাবি তারা ধারণ করেছিলেন ক্যানভাসে।

জয়নুলের কাছে স্থানীয় সংস্কৃতিই কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের হাতিয়ার। তার সহজ-সরল ফর্ম, মেটে রঙ বা লোকজ ধাঁচের রেখার বিন্যাসই যেন মানসিক স্বাধীনতার প্রতীক। ফিগারের ব্যবহার বাস্তবের কাছাকাছি। তবে আরো সূক্ষ্মভাবে দ্বন্দ্বটুকু উঠে আসে। যুদ্ধ যেন তার ফিগারেটিভ আর্ট ফর্মে নতুন জ্বালানি হিসেবে হাজির হয়। জয়নুলের বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা চিত্রকর্মটির সঙ্গে দুর্ভিক্ষ চিত্রমালার সংযোগ পাওয়া যায়। যেখানে শিল্পসৌন্দর্য হতাশা নিয়ে এলেও এবার নতুন সূর্য উদয়ের সরাসরি ইশারা পাওয়া যায়। আবার সিভিল ওয়ার- রেখা বিমূর্ত ধারার বিন্যাসে ফসলের মাঠে ফিগারগুলো আগের ছবির চেয়ে স্বতঃস্ফূর্ত। রাইফেল বাংলার পতাকা বলে দিচ্ছে দীর্ঘ সংগ্রাম তার ফসল ঘরে তোলার কথা। অন্যদিকে লিবারেশন ওয়ার শিরোনামের চিত্রকর্মে ফিগারগুলো বিমূর্ত আকার ধারণ করে। এর আবহে স্পষ্ট হয়ে উঠে নতুন একটি দেশের অভ্যুদয়।

তেলরঙে মাস্টার পেইন্টার শাহাবুদ্দিন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধে প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে অংশ নেন। ময়দানের সেই অভিজ্ঞতা ক্যানভাসে ভিন্ন রূপ পেল। ফিগারেটিভ ইমেজ ভেঙে বিমূর্ত করে তোলায় তার জুড়ি নেই। যুদ্ধক্ষেত্রের মনোজাগতিক অনুবাদও ঘটে তার আঁকা ছবিতে। যেখানে সবকিছু ভেঙে পড়ছে। গতিশীলতার মাঝেই পৌরুষোচিত মানব শরীরের আগ্রাসী চিত্র একই সঙ্গে গর্ব যন্ত্রণার যৌথ অনুভূতি দেয়। তার উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্মের মধ্যে আছে ফ্রিডম ফাইটার, প্লাটুন বাংলাদেশ। বাংলাদেশ-এর বিষয়বস্তু পতাকা; গাঢ় সবুজ মাঠে উঠছে লাল সূর্য। নতুনের আবির্ভাবকে স্বাগত জানাচ্ছে। তার মাঝে ঝাপসা হয়ে আসা মানুষের ফিগার। আবার সবুজ-লাল-বাদামি রঙে আঁকা প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধাদের এগিয়ে যাওয়া তুলে ধরেছে। যেখানে লক্ষ করা যায় পশ্চিমা শিল্পধারার সঙ্গে চমত্কার বোঝাপড়া।

লোকজ ধারাকে প্রতিবাদের অস্ত্র হিসেবে তুলে ধরার ক্ষেত্রে অন্যতম বাংলার মুখ কামরুল হাসান। যার নামের পাশে আমরা পটুয়া ব্যবহার করি। তার রাজনৈতিক চিত্রগুলোয় সবসময় সরলতা প্রশ্রয় পেয়েছে। দুটি ঐতিহাসিক মুহূর্তের বর্ণনা এসেছে তার বিখ্যাত গণহত্যার আগে গণহত্যার পরে চিত্রকর্মে। প্রথমটিতে তার মাস্টারপিস তিনকন্যা মতো তিনজন নারী উপস্থিত, পরের ছবিতে তিন নারীর স্থানে তিনটি কঙ্কাল দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। দ্বিতীয় ছবিতে লোকজ ধারার সঙ্গে কিউবিজমের স্পষ্ট প্রভাব দেখা যায়। কিন্তু ফর্মের বাইরে গিয়ে এই ছবির বার্তা অমূল্য, যুদ্ধ মানুষের কঙ্কালটুকুও অক্ষত রাখে না। স্বাধীনতা আন্দোলনে কামরুলের প্রভাব নিয়ে বলতে গেলে সহজ উদাহরণ হলো জেনারেল ইয়াহিয়ার মুখের ছবি দিয়ে আঁকা এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে পোস্টারটি।

জয়নুল কামরুলের মিলিত প্রভাব দেখা যায় আরেক মাস্টার চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর কাজে। তিনিও চিত্রকর্মে মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষের ওপর জোর দিয়েছেন। তার শিরোনামহীন মুক্তিযোদ্ধাদের বিখ্যাত চিত্রকর্মটি এর ভালো উদাহরণ।

স্বাধীনতার প্রতিটি লড়াইয়ে মানুষ খুঁজেছে মানবতা, সাম্য মুক্তি, জন্মগত অধিকার। যে অধিকার মাটির ওপর তার, তার ওপর মাটির। পরাধীনতা মূলত মানুষকে তার মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়। তা যে সম্ভব না, তার ভালো উদাহরণ বাংলার চিত্রকর্মগুলো। যেখানে সব নিপীড়িতের ভাষা চিহ্ন এক। লড়াইয়ে মানুষ যূথবদ্ধ হয়েছে এমন একই বাংলার রূপকল্পে, যাকে শিল্পের আশ্রয় ছাড়া পুরোপুরি ধরা সম্ভব নয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন