আমি ‘না’ মেনে নিইনি কখনো

মারিনা আব্রামোভিচ

মারিনা আব্রামোভিচ গত চার দশকে পারফরম্যান্স আর্টকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন। শিল্পী আর দর্শকের মধ্যবর্তী সম্পর্ককে সংজ্ঞায়িত করেছেন নতুন সমীকরণে। ছাপিয়ে গিয়েছেন শরীরের সীমাবদ্ধতা মনের সম্ভাব্যতা নিয়ে প্রথাগত ধারণা। তাকে বলা হয় গ্র্যান্ডমাদার অব পারফরম্যান্স আর্ট রিদম সিরিজ, সেভেন ইজি পিসেস দি আর্টিস্ট ইজ প্রেজেন্ট তার শিল্পীসত্তার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ। শিল্পীর প্রকাশিত বিভিন্ন সাক্ষাত্কার থেকে লেখাটি তৈরি করেছেন আহমেদ দীন রুমি

সেই অর্থে আমার কখনই স্টুডিও ছিল না। স্টুডিও মানুষকে অলস আরামপ্রিয় করে তোলে। সেখানে চলে কেবল পুনরাবৃত্তি। আমি প্রকৃতি আর বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ নিয়ে আগ্রহী। আগ্রহী নিজেকে জীবনের কাছে মেলে ধরতে। শিল্পের আইডিয়াগুলোও সেভাবেই পাই। সহজ সুলভ শিল্পও টানে না। বরং যে শিল্প গতানুগতিকতার বাইরে নিয়ে যায়, সেটাতে আমি অনায়াসে ডুবে যেতে পারি। প্রসঙ্গে জন কেইজের একটা বক্তব্য আমার খুব প্রিয়। তিনি বলেছিলেন, দর্শকের কাছে গৃহীত হওয়ার পর প্রতিবার আমি কাজের ক্ষেত্র বদল করি। এমন কিছু করতে চেষ্টা করি, যেখানে এখনো স্বীকৃতি পাইনি।

প্রথমবার যখন দর্শকের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের আইডিয়া পরিবেশন করলাম, সেদিনই বুঝে গিয়েছি এটাই আমার জন্য শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। স্বীকৃতির জন্য রীতিমতো সংগ্রাম করতে হয়েছে। ক্যারিয়ারের প্রথম দিকটা ছিল ভয়াবহ। পুরো সময় একটা ভিত্তি তৈরি করতে হয়েছে আমাকে। তার জন্য আত্মবিশ্বাস প্রয়োজন। সবাই ভুল সাব্যস্ত করলেও আপনাকে নিজের প্রতি আস্থা রাখতে হবে।

আমি না মেনে নিইনি কখনো। কোনো কিছুকে নিজের কাছে ঠিক মনে হলেই করে ফেলতাম। শিল্পী হতে চাইলে এতটুকু দৃঢ় বিশ্বাস থাকতে হবে। না হলে অনেক আগেই শিল্প থেকে সরে দাঁড়াতাম। সত্তরের দশক শেষেই সব পারফরম্যান্স আর্টের শিল্পী সরে যেতে থাকেন। মনোযোগ দিতে থাকেন চিত্রকলা, ভাস্কর্য স্থাপত্যে। তখন পারফরম্যান্স ছিল অনেক কঠিন। তবু হাল ছেড়ে দিইনি।

আমার বাবা-মা দুজনই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বীরোচিত অবদানের সম্মাননা পাওয়া।  শৈশবজুড়ে আমাকে শেখানো হয়েছে ত্যাগের কথা। প্রয়োজনে নিজের ব্যক্তিগত জীবন অনেক কিছু বিসর্জন দেয়ার কথা। আমাকে বেড়ে উঠতে হয়েছে কঠিন প্রশ্নের সঙ্গে। তুমি জগতের এখানটাতে কেন? তোমার কাজ কী? তোমার দায়বদ্ধতা কীসে? প্রশ্নগুলো প্রভাব ফেলেছে আমার বেড়ে ওঠায়। নির্ধারণ করেছে কর্মপরিক্রমা।

নিজেকে প্রস্তুত করতে অনুশীলন করতে হয়। প্রয়োজন পড়ে নিয়মিত শারীরিক প্রশিক্ষণ পুষ্টি জোগান দেয়ার। দূরে থাকতে হয় মদ কিংবা যেকোনো প্রকার ড্রাগ থেকে। আমি বিষয়গুলো শিখেছি তিব্বতি বৌদ্ধ ভিক্ষু, মধ্য অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী ব্রাজিলের শামানদের জীবন থেকে। দি আর্টিস্ট ইজ প্রেজেন্ট- যে চেয়ারে বসে থাকার দৃশ্য, তার জন্য পুরো এক বছর নিয়ে আমাকে চর্চা করতে হয়েছে। আমি দুপুরে খেতাম না। ফলে শরীরে অ্যাসিড তৈরি অসুস্থ করে দেয়নি। শুধু রাতে পানি পান করতাম।

মন আমাদের বড় শত্রু। সবসময় আপনি নিজের গণ্ডিকে ছাপিয়ে যেতে চাইবেন, মন বাধা দেবে। অথচ সবার শরীরেই নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার অতিরিক্ত শক্তিটুকু রয়েছে। যেকোনো প্রতিকূল সময়ে আমরা সেই শক্তি ব্যবহার করতে পারি। কোথাও আটকে গেলে, বিমান দুর্ঘটনায় কিংবা আগুন লাগলে সেই শক্তি নিয়েই আমরা দৌড়ে বের হতে সক্ষম হই। তাহলে অন্য সময় কেন পারি না? রকম কোনো পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা না করে শক্তিটাকে স্বাভাবিকভাবেও কাজে লাগানো যায়।

আপনি বিখ্যাত হওয়ার পর যারা আপনাকে এতদিন ভালোবাসত তারা ক্রমে ঘৃণা করতে শুরু করবে। কোণঠাসা করে রাখবে সবাই। চাইবে আপনি গরিব থাকুন। দুর্ভোগ পোহান সংগ্রাম করে জীবনযাপন করুন। ৫০ বছর বয়স অবধি আমি আমার বিদ্যুৎ বিল দিতে পারতাম না। কিন্তু এখন পারি।

যত বেশি পরাজিত হবেন, তত বেশি বুঝতে পারবেন আপনার ব্যর্থ হওয়ার কারণ। আপনার পরবর্তী কাজ তত বেশি সফল হবে। কোনো একটা কিছুতে স্থির না থাকার মানে হলো আপনি ঝুঁকি নিয়েছেন, রয়েছেন নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কারে।

 

সূত্র: হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ দ্য গার্ডিয়ান

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন