আক্রান্তদের অর্ধেকই থাইরয়েড রোগ সম্পর্কে জানে না

জনসচেতনতা বাড়াতে কার্যকর পদক্ষেপ নিক স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

বর্তমানে দেশে থাইরয়েড অন্যতম জনস্বাস্থ্য সমস্যায় পরিণত হয়েছে। হরমোনজনিত রোগের ক্ষেত্রে ডায়াবেটিসের পরই এর অবস্থান। দিন দিন বাড়ছে রোগের প্রকোপ। বিশ্ব থাইরয়েড দিবসের আলোচনায়ও রোগটির ব্যাপকতার চিত্র উঠে এসেছে। তথ্য বলছে, দেশের জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ কোনো না কোনোভাবে থাইরয়েডে আক্রান্ত। কিন্তু আক্রান্তদের অর্ধেকই রোগটি সম্পর্কে জানে না। প্রজাপতি সদৃশ থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমোন মানুষের বৃদ্ধি, মানসিক বিকাশ, বিপাক ক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সুতরাং সুস্থ থাকার জন্য প্রতিটি মানুষের শরীরে হরমোনের মাত্রা ঠিক রাখা অপরিহার্য। মানুষের অজ্ঞতায় নীরবে  যেভাবে থাইরয়েড  রোগ  বেড়ে চলছে, সেটি  ভীষণ উদ্বেগের। তাই এর বিস্তার রোধে ব্যাপক জনসচেতনতা বাড়ানো জরুরি।

থাইরয়েডজনিত সমস্যার নানা ধরন আছে। থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে থাইরক্সিন হরমোন কম নিঃসৃত হলে সেটি হাইপোথাইরয়েডিজম। এটি থাইরয়েডের সবচেয়ে পরিচিত সমস্যা। নারীদের ক্ষেত্রে এটি পুরুষদের তুলনায় প্রায় আট গুণ বেশি হয়। আর থাইরক্সিন হরমোন অতিরিক্ত পরিমাণে নিঃসৃত হলে সেটিকে বলা হয় হাইপারথাইরয়েডিজম। আবার থাইরয়েড গ্রন্থিতে প্রদাহ হলে তাকে বলা হয় থাইরয়েডাইটিস। এছাড়া আছে থাইরয়েড গ্রন্থিতে ক্যান্সার বা টিউমার। মূলত আয়োডিনের অভাব, বংশগত জিনগত প্রভাব, থাইরয়েড চিকিৎসায় কারো রেডিও আয়োডিন খাওয়া এবং গলার সার্জারি প্রভৃতি কারণই থাইরয়েড সমস্যার জন্য দায়ী। সময়ান্তরে বিভিন্ন থাইরয়েড জটিলতার আপেক্ষিক সংখ্যায় পরিবর্তন এসেছে। আগে আয়োডিন ঘাটতিজনিত থাইরয়েড সমস্যা বেশি দেখা যেত। বিশেষ করে উত্তরের জেলাগুলোয় এর প্রকোপ ছিল বেশি। পরে সরকার লবণে আয়োডিন সংমিশ্রণ বাধ্যতামূলক করে। ফলে গত শতকের নব্বই দশক থেকে আয়োডিন ঘাটতির সমস্যা অনেকটা কমে আসে। তবে একবিংশ শতকের শুরুর দিক থেকে দেশে হাইপোথাইরয়েডিজম, গ্রেভ ডিজিজ, থাইরয়েডাইটিস এবং থাইরয়েড ক্যান্সার সাধারণ থাইরয়েড সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত। আয়োডিনজনিত ঘাটতির সমস্যা এখনো স্বল্প মাত্রায় থাকলেও উল্লিখিত ধরনগুলো ক্রমেই বাড়ছে। এসব ধরনের বিস্তার রোধই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।

বর্তমানে থাইরয়েড গ্রন্থির নানা সমস্যা বিশ্বে অন্যতম হরমোনজনিত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত। সমস্যা মোকাবেলায় অনেক দেশ প্রাথমিক শনাক্তকরণে জোর দিয়েছে। যার মধ্যে নবজাতকের হাইপোথাইরয়েডিজম (সিএইচ) স্ক্রিনিং অন্যতম। ১৯৭০-এর দশকে মূলত নবজাতকের সিএইচ স্ক্রিনিংয়ের শুরু। অধিকাংশ উন্নত দেশ এটি এখন বাধ্যতামূলক করেছে। এছাড়া অন্য বয়সগোষ্ঠীকে স্ক্রিনিংয়ের আওতায় আনা হচ্ছে। আমেরিকান থাইরয়েড অ্যাসোসিয়েশনের পরামর্শ হলো, ৩৫ বছরের শুরুতে প্রতিটি ব্যক্তিকে থাইরয়েড স্ক্রিনিং করতে হবে এবং তার পর থেকে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সেটি করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রসহ আরো কিছু দেশে এটি বিবেচনায় নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।

চিকিৎসকরা বলছেন, থাইরয়েডের রোগ একেক বয়সে একেক রকমের উপসর্গ জটিলতা তৈরি করে। যেমন নবজাতকের হাইপোথাইরয়েডিজম হলে দৈহিক মস্তিষ্কের গঠন বিকাশ ব্যাহত হয়। নানা শারীরিক জটিলতার পাশাপাশি বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা দেখা দেয়। কিশোর বয়সের কিছু আগে বা কিছু পরে অনেকেরই হাইপোথাইরয়েডিজম ধরা পড়ে। তাদের ক্ষেত্রেও বিকাশজনিত সমস্যা, যেমন খর্বতা, কৈশোরপ্রাপ্তিতে বিলম্ব, কিশোরীদের মাসিকের সমস্যা, মানসিক ধীরতা, পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়া ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। শিশু-কিশোরদের স্থূলতার পেছনেও এর প্রভাব বিদ্যমান। বয়সে ধরনের অনেক উপসর্গকেই সাধারণত আমলে নেয়া হয় না। ফলে সেই কিশোর-কিশোরী পরবর্তী সময়ে নানা জটিলতায় পড়ে, লেখাপড়া পেশাজীবনেও অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে যায়। এদিকে প্রজননক্ষম নারীদের হাইপোথাইরয়েডিজমের হার জটিলতা আরো বেশি। ফলে হঠাৎ ওজন বাড়তে থাকা, অনিয়মিত মাসিক বা দীর্ঘদিন অতিরিক্ত মাসিক, সন্তান ধারণে অক্ষমতা, চুল ত্বকের সমস্যা, কোষ্ঠকাঠিন্য, শীত শীত ভাব বা জ্বর জ্বর লাগা, ক্লান্তি, অবসাদ, মনোযোগ কমে যাওয়া বা কাজকর্মে ধীর হয়ে যাওয়া ইত্যাদি নানা সমস্যা দেখা দেয়। আবার বয়স্কদের সাধারণত স্থূলতা, শুষ্ক ত্বক, স্মৃতিভ্রংশ, হূত্স্পন্দন জটিলতা, পা ফুলে যাওয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি উপসর্গ থাকে। যথাযথ সময়ে হাইপোথাইরয়েডিজমের চিকিৎসা না করা হলে এর কারণে ওজন বৃদ্ধি, হূদরোগ, রক্তের চর্বি বাড়া, হূত্স্পন্দনের সমস্যা, বারবার গর্ভপাত, বন্ধ্যত্ব ইত্যাদি নানা জটিলতা তৈরি হয়। উল্টো দিকে হাইপারথাইরয়েডিজমে ওজন কমা, গরম লাগা, অতিরিক্ত ঘাম, পাতলা পায়খানা, দ্রুত হূত্স্পন্দনের মতো উপসর্গ প্রকট হয়ে ওঠে। আবার প্রদাহ বা থাইরয়েডাইটিস হলে থাইরয়েড ফুলে যাওয়ার সঙ্গে ব্যথাও করে। বলতে গেলে বয়স লিঙ্গ নির্বিশেষে বিভিন্ন ধরনের থাইরয়েড রোগের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি সুদূরপ্রসারী। সুতরাং এটিকে ন্যূনতম অবহেলারও সুযোগ নেই।

আমরা দেখছি, বৃহত্তর ময়মনসিংহ (বিশেষ করে শেরপুর জামালপুর) জেলার একটা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী পুরুষ আয়োডিনের অভাবজনিত গলগণ্ড রোগে ভুগছে। এদের জন্য পর্যাপ্ত আয়োডিনের ব্যবস্থা করতে পারলেই ব্যাপক জনগোষ্ঠী গলগণ্ডের হাত থেকে রেহাই পাবে। সরকারিভাবে খাবার লবণে নির্দিষ্ট মাত্রার আয়োডিন মেশানোর নির্দেশ দেয়া থাকলেও আমাদের অভিজ্ঞতা বিরূপ। বেশির ভাগ লবণেই আয়োডিন নেই কিন্তু এর দাম নেয়া হচ্ছে আয়োডিনযুক্ত লবণ হিসেবে। সুতরাং খাবার লবণে আয়োডিন নিশ্চিতে তদারকি আরো বাড়াতে হবে। এত দিন দেশে বিচ্ছিন্নভাবে থাইরয়েডের চিকিৎসা চলছিল। -সম্পর্কিত হালনাগাদ গাইডলাইন ছিল না। সম্প্রতি থাইরয়েড চিকিৎসার একটি গাইডলাইন প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি। এটি ভালো পদক্ষেপ। এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের আশা, গাইডলাইনটি সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীরা অনুসরণ করবেন এবং এর ভিত্তিতে থাইরয়েড রোগীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করবেন। অনেক জায়গায় থাইরয়েড পরীক্ষায় বেশি অর্থ নেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে, যা নিম্ন আয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য অনেকটা পীড়নমূলক। সারা দেশে থাইরয়েডসংক্রান্ত পরীক্ষাগুলোর অভিন্ন ফি নির্ধারণ করে দেয়া যায় কিনা সেটিও ভেবে দেখা যেতে পারে। যেকোনো রোগের ক্ষেত্রে আগে শনাক্তকরণ গুরুত্বপূর্ণ। অন্য দেশের মতো নবজাতকের সিএইচ স্ক্রিনিং করা হলে শুরুতেই রোগটি শনাক্ত হবে এবং এর বিস্তার রোধও সহজতর হবে। কাজেই বিষয়টি বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে।

থাইরয়েড রোগের প্রভাব বহুমাত্রিক। সুতরাং রোগ সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। কারণ আগামী প্রজন্মের মেধা, প্রতিভার বিকাশের জন্য বর্তমান প্রজন্মকে, বিশেষ করে মেয়েদের থাইরয়েডের সুস্থতা দরকার। কাজেই সরকারিভাবে প্রচার-প্রচারণা যেমন চালাতে হবে, ব্যক্তিক সচেততাও জরুরি। আসুন, সুস্থ সুন্দর জীবনের জন্য নিজের থাইরয়েডকে জানি, এর উপসর্গ জটিলতা সম্পর্কে সচেতন হই।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন