ইয়াহিয়া খানের জেনারেল রানী

সাইফুল ইসলাম

স্বাধীনতার ৫০তম বর্ষে পদার্পণ করেছে বাংলাদেশ। উপলক্ষে বিজয়ের মাসজুড়েই স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন প্রেক্ষিত সম্পর্কে নানা আয়োজন থাকছে বণিক বার্তায়। আজকের উপস্থাপনাটি আকলিম আখতারকে নিয়ে

ষাটের দশকের শুরুতেও সাধারণ এক পাকিস্তানি গৃহবধূর জীবনযাপন করেছেন পাঞ্জাবের গুজরাটের (ভারতের উপকূলীয় প্রদেশ গুজরাট নয়) সচ্ছল পরিবারের কন্যা আকলিম আখতার। স্বামী ছিলেন পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। ১৯৬৩ সালে স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর আকলিম আখতার বসবাস করতে থাকেন রাওয়ালপিন্ডিতে।

ছয় সন্তানের জননী নিঃসঙ্গ নারী কয়েক বছরের মধ্যেই হয়ে ওঠেন পাকিস্তানের অন্যতম শীর্ষ ক্ষমতাধর ব্যক্তিত্ব। সেনাবাহিনীর কেউ না হয়েও সামরিক শাসনামলে হয়ে ওঠেন জেনারেলদের চেয়েও বেশি দাপুটে। পরিচিতি পান জেনারেল রানী হিসেবে।

আকলিম আখতারের মধ্যকার উচ্চাভিলাষী দিকগুলো প্রকাশ পেতে থাকে বিবাহবিচ্ছেদের পরই। ওই সময় তার রাওয়ালপিন্ডির ফ্ল্যাটে নিয়মিত নাচের আসর পার্টির আয়োজন করা হতো। তত্কালীন সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনের আমোদপ্রিয় কর্মকর্তারা ছিলেন এসব আসরের নিয়মিত অতিথি। এমনই এক আসরে ১৯৬৭ সালে পাকিস্তানের তত্কালীন সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে পরিচয় হয় আকলিম আখতারের।

আকলিম আখতার ইয়াহিয়া খানকে সম্বোধন করতেন আগা জানি নামে। দুজনের ঘনিষ্ঠতা এক পর্যায়ে স্ক্যান্ডালে রূপ নেয়। ইয়াহিয়া খানের মদের প্রতি আসক্তি নারীলিপ্সা ছিল সে সময়কার পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যমের চর্চার অন্যতম বিষয়বস্তু। এর মধ্যে আকলিম আখতারের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি মিডিয়ার বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।

১৯৬৯ সালে ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নেন আইয়ুব খান। ইয়াহিয়া প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী হিসেবে আকস্মিকভাবেই পাকিস্তানের রাজনীতি রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন আকলিম আখতার। গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়গুলোয় ইয়াহিয়া খানের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে থাকেন তিনি। গণমাধ্যমও তাকে অভিহিত করতে থাকে জেনারেল রানী হিসেবে।

কথিত রয়েছে, আকলিম আখতার শুধু ইয়াহিয়াকে সঙ্গই দিতেন না, তার সঙ্গে অন্য অনেক নারীর ঘনিষ্ঠতাও করিয়ে দিয়েছিলেন। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে যাদের তিনি ঘনিষ্ঠতা করিয়ে দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নাম পাকিস্তানের কোকিলকণ্ঠী হিসেবে পরিচিত গায়িকা অভিনেত্রী নূরজাহান।

জেনারেল রানী পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানি সাংবাদিক আয়েশা নাসিরকে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে জানিয়েছেন, ইয়াহিয়া খান আগেই নূরজাহান সম্পর্কে তার কাছে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। পরে আয়করসংক্রান্ত এক ঝামেলা এড়াতে গিয়ে আকলিম আখতারের কাছে তদবির করতে এসেছিলেন নূরজাহান। এর সুবাদেই নূরজাহান ইয়াহিয়া খানের মধ্যে পরিচয় করিয়ে দেন আকলিম আখতার।

বিষয়টি গণমাধ্যমে অনেক স্ক্যান্ডালের জন্ম দিলেও ওই সময়ে ঘটনা ইয়াহিয়া খানের কাছে আকলিম আখতারের কদর বাড়িয়ে দিয়েছিল অনেকখানি। এর মধ্য দিয়েই মোহাচ্ছন্ন ইয়াহিয়ার ওপর তার প্রভাব অনেকখানি বেড়ে যায়।

ওই সময় ইয়াহিয়া খানের অনুগ্রহ পাওয়ার আশায় জেনারেল রানীর কাছে ভিড় করতে থাকেন রাজনীতিবিদ, শীর্ষ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা ব্যবসায়ীরা। আকলিম আখতারের কাছে ধরনা দেয়া এসব ব্যক্তির মধ্যে ছিলেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) প্রধান পরবর্তীকালের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোও।

ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণের সময়ে জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ১৯৭০ সালেই নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে পাকিস্তানে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনবেন তিনি। ওই নির্বাচনেই প্রথম অংশ নেয় সে সময়ের নবগঠিত রাজনৈতিক দল পিপিপি। নির্বাচনে জয়লাভের জন্য পাকিস্তানের আমলাতন্ত্র সামরিক বাহিনীর সমর্থন আদায়ে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন দলটির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো। এজন্য সে সময় প্রায়ই দলের তরুণ নেতা মুস্তাফা খারকে সঙ্গে নিয়ে আকলিম আখতার তথা জেনারেল রানীর কাছে ধরনা দিতেন তিনি।

আকলিম আখতার নিজেও পরবর্তী সময়ে বলেছেন, মুস্তাফা খার জুলফিকার আলী ভুট্টো আমার কাছে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেন শুধু জেনারেলের সঙ্গে একবার কথা বলিয়ে দেয়ার জন্য।

বিভিন্ন মাধ্যমে উঠে আসা তথ্য বলছে, মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে ইয়াহিয়া ভুট্টোর মধ্যে যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল, তার ভিত্তিটি গড়ে দিয়েছিলেন জেনারেল রানী। আকলিম আখতার নিজেও বলেছেন, আমি আগা জানির জন্য যতগুলো পার্টি আয়োজন করেছিলাম, তার চেয়েও বেশি করেছিলাম ভুট্টো খারের জন্য।

১৯৭৭ সালের নভেম্বরে এক সংবাদ সম্মেলনে আকলিম আখতার দাবি করেন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে ভুট্টোর দলের নির্বাচনী ব্যয়ভারের বড় একটি অংশ তিনি বহন করেছিলেন। এমনকি তিনি সে সময় ভুট্টোর ব্যক্তিগত ব্যয়ও বহন করেছেন। এর প্রতিদানে ভুট্টো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, নির্বাচনে জয়লাভ করলে আকলিম আখতারকে পাঞ্জাবের গভর্নর বানাবেন তিনি।

ইয়াহিয়া খান যতদিন ক্ষমতায় ছিলেন, জেনারেল রানীর প্রতাপ প্রভাবও ততদিন ছিল। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় ইয়াহিয়া খানের মতো আকলিম আখতারের সৌভাগ্যের দিনগুলোরও ইতি ঘটিয়েছিল। সৌভাগ্য আর কখনই ফিরে পাননি তিনি।

১৯৭১ সালের ডিসেম্বরেই পাকিস্তানের ক্ষমতা হারান ইয়াহিয়া খান। ক্ষমতায় আসেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের কারণ বাংলায় দেশটির সামরিক-রাজনৈতিক নেতাদের কার্যকলাপ নিয়ে তদন্তের জন্য গঠন করা হয় হামুদুর রহমান কমিশন।

জেনারেল রানীর দাবি, ওই সময়ে পাকিস্তানের পরাজয়ের জন্য ইয়াহিয়া খানকে দায়ী করে কমিশনে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করেছিলেন ভুট্টো। কিন্তু আকলিম আখতার তাতে অস্বীকৃতি জানান। কারণে চোরাচালান রেড লাইট জোন পরিচালনার অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করান ভুট্টো।

১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত পাঁচ বছর পর্যায়ক্রমে গৃহে কারাগারে বন্দি করে রাখা হয় আকলিম আখতারকে। এর মধ্যে লাহোর দুর্গের কারাগারে বন্দি থাকাকালে তাকে বেশ নির্যাতনও করা হয় বলে অভিযোগ তুলেছিলেন জেনারেল রানী।

অন্যদিকে পাকিস্তানের এক নামজাদা উকিলের ভাষ্যমতে, ভুট্টো আকলিম আখতারকে আটকে রেখেছিলেন, কারণ তিনি অনেক কিছুই জানতেন।

১৯৭৭ সালে জুলফিকার আলী ভুট্টো ক্ষমতাচ্যুত হলে আকলিম আখতারের বন্দিত্বেরও অবসান ঘটে। এরপর পুরোপুরি লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান তিনি। ১৯৮০ সালে ইয়াহিয়া খানের মৃত্যুর পর আবার সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হন তিনি। এরপর দীর্ঘদিন তাকে জনসম্মুখে আর দেখা যায়নি। জেনারেল রানীর মৃত্যু হয় ২০০২ সালে, ক্যান্সারে ভুগে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন