প্রাইভেট ইকুইটি

এক বছরে ৩০০ কোটি টাকার তহবিল সংগ্রহ

মেহেদী হাসান রাহাত

বিকল্প বিনিয়োগের উৎস হিসেবে সারা বিশ্বেই প্রাইভেট ইকুইটি ও ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বেশ জনপ্রিয়। প্রাইভেট ইকুইটির মাধ্যমে এক সময় নিজেদের ব্যবসার প্রয়োজনীয় মূলধন সংগ্রহ করেছিল ফেসবুক, উবার, টিকটকসহ বৈশ্বিক অনেক জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানই। দেশেও সরকারের পক্ষ থেকে প্রাইভেট ইকুইটি ও ভেঞ্চার ক্যাপিটালের মাধ্যমে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। গত বছর স্থানীয় ও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে এর মাধ্যমে ৩০০ কোটি টাকার তহবিল সংগ্রহ করেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। তবে নীতিগত সহায়তার পাশাপাশি সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এগোলে আগামীতে প্রাইভেট ইকুইটি ও ভেঞ্চার ক্যাপিটালের মাধ্যমে বাংলাদেশ আরো বেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সক্ষম হবে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তহবিল সংগ্রহের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৯ সালে অগমেডিক্স ১৬১ কোটি ১২ লাখ টাকা প্রাইভেট ইকুইটির মাধ্যমে সংগ্রহ করেছে। প্রতিষ্ঠানটির মূল বিনিয়োগকারী হচ্ছে রেডমাইল গ্রুপ। অভিযাত্রিক ট্যুরিজম প্রাইভেট ইকুইটির মাধ্যমে ১ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। প্রতিষ্ঠানটির মূল বিনিয়োগকারী হচ্ছে প্যারাগন গ্রুপ। সিওয়ার্ক মাইক্রোজব লিমিটেডে বিডি ভেঞ্চারের পক্ষ থেকে গত বছর ৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। চালডাল ডট কমে আইএফসি, আইডিএলসি এবং ওয়াই কো-অর্ডিনেটর ৪৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছে। ডেলিগ্রামে স্কাইক্যাচার ও এভারব্লু ম্যানেজমেন্টের পক্ষ থেকে গত বছর ১৬ কোটি ৯৬ লাখ টাকা প্রাইভেট ইকুইটি হিসেবে বিনিয়োগ করা হয়েছে। পার্কিং কই-এ গত বছর ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছে নাম অপ্রকাশিত একটি প্রতিষ্ঠান। শপআপে অমিদার নেটওয়ার্ক ১৩ কোটি ৭৩ লাখ টাকা প্রাইভেট ইকুইটি বিনিয়োগ করেছে। সিন্দাবাদ ডট কমে আবিষ্কার ফান্ডের পক্ষ থেকে ৩৫ কোটি ১৯ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। আর ট্রাক লাগবে-তে গত বছর ৮ কোটি ৪৮ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছে নাম অপ্রকাশিত একটি প্রতিষ্ঠান।

জানতে চাইলে ব্রামার্স অ্যান্ড পার্টনার্সের প্রধান উপদেষ্টা মুয়াল্লেম এ চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ভারত, শ্রীলংকা ও ভিয়েতনামের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে এক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। তবে আমাদের এখানে প্রাইভেট ইকুইটির মাধ্যমে আরো অনেক বেশি বিদেশী বিনিয়োগ আসার সুযোগ রয়েছে। এজন্য যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, সেগুলো দূর করতে হবে। বাংলাদেশে প্রাইভেট ইকুইটি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এক্সিট নেয়ার পথটি আরো মসৃণ করতে হবে। আইপিওতে আসার সময় যদি সে কোম্পানিতে প্রাইভেট ইকুইটি প্রতিষ্ঠানের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিনিয়োগ থাকে, তাহলে সেক্ষেত্রে উদ্যোক্তা-পরিচালকদের মতোই তিন বছরের জন্য লকইন আরোপ করা হয়। এতে কিন্তু তিন বছরের জন্য শেয়ার বিক্রির সুযোগ থাকছে না। এটি একটি প্রতিবন্ধকতা।

তিনি বলেন, অনেক দেশে আইপিওতে আসা কোম্পানির নিজেদের শেয়ারের পাশাপাশি ওই কোম্পানিতে প্রাইভেট ইকুইটি হিসেবে বিনিয়োগ করা প্রতিষ্ঠানের শেয়ারও বিক্রির সুযোগ থাকে। যেটি আমাদের এখানে নেই। এছাড়া বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াও খুব একটা মসৃণ নয়। এসব সমস্যার কারণে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হয়। তাই এগুলো সমাধানের পাশাপাশি আমরা যদি প্রতিযোগী দেশগুলোর চেয়ে আকর্ষণীয় সুযোগ-সুবিধা দিতে পারি, তাহলে অবশ্যই আরো অনেক বেশি বিদেশী বিনিয়োগ দেশে নিয়ে আসা সম্ভব।

গত বছর হংকংভিত্তিক প্রাইভেট ইকুইটি গ্রুপ ইকুরিয়ারে, ওএস ভেঞ্চারস ও ব্র্যাক অসিরিস ইমপ্যাক্ট ভেঞ্চারস গোজায়ানে, ইউনিভার্সাল ফিন্যান্সিয়াল সলিউশন্স লিমিটেড গোয়ালাতে, অ্যাভডেঞ্চার ক্যাপিটাল যাত্রীতে, ভোস্তক নিউ ভেঞ্চারের পক্ষ থেকে সহজে, বিডি অ্যাঞ্জেলস নেটওয়ার্ক ও সিঙ্গাপুরের অ্যাঞ্জেলসের মাধ্যমে যান্ত্রিকে ও ফ্রন্টিয়ার ফান্ডের পক্ষ থেকে জিরো গ্র্যাভিটি ভেঞ্চারস লিমিটেডে প্রাইভেট ইকুইটির মাধ্যমে বিনিয়োগ করা হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সংগৃহীত তহবিলের পরিমাণ প্রকাশ করেনি। একই সময়ে সেবা, হ্যালোটাস্ক, বঙ্গবিডি, ক্লদিও, বিটলস সাইবার সিকিউরিটি লিমিটেড, হ্যান্ডিমামা, ওয়াইএসআই বাংলা লিমিটেড, প্রিয়শপ ডট কম, আপস্কিল ডট কম ডট বিডি, শেয়ারট্রিপ, ডক্টরকই ও লুজলি কাপলড টেকনোলজিসও প্রাইভেট ইকুইটির মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করেছে।

বিডি ভেঞ্চার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিক উল আযম বলেন, গত বছর তুলনামূলকভাবে প্রাইভেট ইকুইটি বিনিয়োগের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে। যদিও এটি আরো বাড়ার সুযোগ ছিল। বিশ্বের অনেক দেশেই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাইভেট ইকুইটির মাধ্যমে বিনিয়োগ করে। কিন্তু আমাদের এখানে এখনো সেভাবে ব্যাংকগুলো এগিয়ে আসছে না, যদিও তাদের কাছে বিনিয়োগ করার মতো পর্যাপ্ত তারল্য রয়েছে। প্রাইভেট ইকুইটি বিনিয়োগের অন্যতম এক্সিট পয়েন্ট হচ্ছে আইপিও। তবে এখন পর্যন্ত আইপিওর মাধ্যমে দেশে কোনো প্রাইভেট ইকুইটি তহবিল এক্সিট নিতে পারেনি। আইপিও ছাড়া শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে বেশকিছু বিনিয়োগ প্রত্যাহার হয়েছে ও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মুনাফাও হয়েছে। প্রাইভেট ইকুইটির মাধ্যমে বিনিয়োগে উল্লেখযোগ্য হারে যে রিটার্ন পাওয়া যায় সেটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে আরো ভালোভাবে তুলে ধরতে হবে। এছাড়া অপ্রদর্শিত অর্থ প্রাইভেট ইকুইটিতে বিনিয়োগ করা হলে কর ছাড়ের সুযোগ দেয়া হলে এখানে বিনিয়োগের পরিমাণ আরো বাড়বে বলে জানান তিনি।

গত বছরের ধারাবাহিকতায় এ বছরও বেশকিছু প্রতিষ্ঠান প্রাইভেট ইকুইটির মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করেছে। এর মধ্যে শিখো অপ্রকাশিত প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ৮৪ লাখ ৮০ হাজার, এসওএল শেয়ার এডিপি ভেঞ্চারসের কাছ থেকে ৯ কোটি ৩২ লাখ, প্রিয়শপ প্রাইম ব্যাংকের কাছ থেকে ৫০ লাখ, অ্যাক্সেলারেটিং এশিয়ার কাছ থেকে আইফার্মার ৪ কোটি ২৪ লাখ এবং অ্যাঙ্করলেস বাংলাদেশের কাছ থেকে গেজ ৭ কোটি ৩ লাখ ও লুপ ৫ কোটি ৮ লাখ টাকার তহবিল সংগ্রহ করেছে। এছাড়া চলতি বছর তোগো মোগো, যাত্রী, আপস্কিল, ডাটাফুল ও আলো প্রাইভেট ইকুইটির মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করেছে, যদিও তাদের সংগৃহীত তহবিলের পরিমাণ প্রকাশ করা হয়নি।

ভেঞ্চার ক্যাপিটাল অ্যান্ড প্রাইভেট ইকুইটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ভিসিপিইএবি) ভাইস চেয়ারম্যান ও ভিআইপিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের চেয়ারম্যান ড. জিয়া উদ্দিন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ উদ্যোগের সঙ্গে সংগতি রেখে আমরা প্রযুক্তিভিত্তিক স্টার্টআপগুলোকে উৎসাহিত করা শুরু করি। আমাদের দেশে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ও প্রাইভেট ইকুইটির যাত্রা খুব বেশিদিনের নয়। ২০১৫ সালের জুনে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) অল্টারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট রুলস প্রণয়ন করার পর ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ও প্রাইভেট ইকুইটি নিয়ে কাজ করার আইনি কাঠামো তৈরি হয়। সে হিসেবে গত বছর দেশে প্রাইভেট ইকুইটির মাধ্যমে ৩০০ কোটি টাকার তহবিল সংগ্রহের বিষয়টি ইতিবাচকই।

তিনি বলেন, চলতি বছর হয়তো আমরা আরো ভালো করতে পারতাম, কিন্তু নভেল করোনাভাইরাসের কারণে বছরখানেক পিছিয়ে গেলাম। তবে করোনার ইতিবাচক দিক হচ্ছে মানুষের মধ্যে প্রযুক্তি ব্যবহার অনেক বেড়েছে। ফলে সামনের দিনগুলোতে প্রযুক্তিভিত্তিক স্টার্টআপগুলো ভালো সাড়া পাবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন